২০ বছরের মাথায় ফের আরেকবার কাবুলের দখল নিল তালিবানরা। ইতিমধ্যেই মিডিয়া জুড়ে বেশ কিছু ছবি ছড়িয়ে পড়েছে, দেখা গেছে সশস্ত্র তালিবান বাহিনী আশরফ গনির প্রাসাদে ঢুকে পড়েছে, শ’য়ে শ’য়ে তালিবানকে আফগানিস্তানের রাস্তায় বন্দুক হাতে টহলও দিতে দেখা যাচ্ছে। নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে আফগানিস্তানের মানুষজন ছুটে বেড়াচ্ছে শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। প্রবল বিস্ফোরণে প্রচুর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
২০২১-এর এই ছবি আমাদের আতঙ্কিত করে, মৌলবাদী আগ্রাসনের মুখে পড়া মানুষগুলোর আর্তনাদ আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। তবু কিছু প্রশ্ন থেকে যায়।
ইতিহাসের একটা লম্বা সময় জুড়ে আফগানিস্তান বিশ্ব রাজনীতিতে বেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছে। মূলত ৭০-৮০ দশক থেকে। আফগানিস্তানে রাজতন্ত্রের অবসান। সোভিয়েতের হস্তক্ষেপ এবং তারপর পি.ডি.পি.এ সরকার গঠন। নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠী সংঘর্ষ, তারপর সোভিয়েতের আফগানিস্তান টিকিয়ে রাখতে সেখানে সামরিক শাসন জারি করা এবং শেষমেষ বিদ্রোহের মুখে পড়ে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েতের বিদায়। এবং এই গোটা পর্বে সোভিয়েত বিরোধী সংগ্রাম গড়ে তোলায় আমেরিকা এবং তাদের সি.আই.এ-র ভূমিকাও আমাদের অজানা নয়। তবে যা আমাদের ভাবিয়ে তোলে তা হল, বিশ্ব রাজনীতিতে বারবার আফগানিস্তান প্রসঙ্গ কেন ফিরে ফিরে আসছে। কী এমন মণিমুক্তো লুকনো আছে আফগানিস্তানের ভূমিতে যা বারবার পৃথিবীর ‘সর্বশক্তিমান’-দের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হচ্ছে।
ভৌগলিক দিক থেকে আলোচনা শুরু করলে, আফগানিস্তানের অবস্থান মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার মাঝামাঝি। মূলত পাহাড়ি এবং খানিক মরুভূমির দেশ এই আফগানিস্তান। যার পূর্ব এবং দক্ষিণ দিক ঘিরে রয়েছে পাকিস্তান। পশ্চিমে ইরান। উত্তরে তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান। আর উত্তর-পূর্বে চিন।
পাহাড়ি মরুভূমির এই দেশে অনুর্বর জমি হওয়ায় চাষাবাদের বিকাশ তেমন ভাবে ঘটেনি। এবং এই বিকাশ না হওয়ার পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল, লাগাতার যুদ্ধ পরিস্থিতিকে টিকিয়ে রাখা। যার ফলে জনজীবনে উন্নতি, জনগণের দাবি মেটানোর দিকে কোন ‘জনদরদী’ দেশ, কোন সরকার-ই বিশেষভাবে নজর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। ৬৫২,৮৬৪ বর্গ কিমির এই দেশে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ৮০ লক্ষ হেক্টর। ২০২০-র সমীক্ষা অনুযায়ী আফগানিস্তানের জনসংখ্যা ৩,১৩,৯০,২০০। তার মধ্যে ৪৪.৩ শতাংশ মানুষ কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন দেশ থেকে উদ্বাস্তুদের ফিরে আসার ফলে জমির উপর চাপ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, অন্য দিকে আঞ্চলিক জমি মাফিয়াদের তাণ্ডব সামলাতেও ব্যর্থ হয়েছে প্রতিটা সরকার। এর ফলে জনসংখ্যার একটা বড় অংশ বাধ্য হয়েছে আফিম চাষ এবং ড্রাগ পাচারে অংশ নিতে। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে আফগানিস্তানের ৯০ শতাংশের কাছাকাছি মানুষ সরকার নির্ধারিত দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করে। এই তথ্যগুলো খানিকটা হলেও আফগানিস্তানের অর্থনীতি সম্পর্কে একটা ছবি আমাদের সামনে ফুটিয়ে তোলে।
এবার আসা যাক সেই প্রসঙ্গে, যে কিভাবে এই দেশটা, বারবার, বড়ো বড়ো শক্তিশালী দেশগুলোর দৃষ্টি নিজের দিকে টেনেছে। এর মূল কারণ হলো আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ। এই পাহাড়ি মরুভূমির নিচে রয়েছে বহু দামি খনিজ সম্পদ। ক্রোমাইট, তামা, আয়রন, সোনা, পেট্রল, লিড, জিঙ্ক, এমারেল্ড, রুবি, তেল এবং লিথিয়াম মৌল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভের তথ্য অনুযায়ী আফগানিস্তানের মাটির তলায় রয়েছে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের সমান খনিজ সম্পদ। এবং এই যুদ্ধ পরিস্থিতি টিকিয়ে রাখার পেছনে রয়েছে এই খনিজ সম্পদ লুঠের ভাবনা।
এ তো আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক হালচাল এবং সেখানকার অশান্ত পরিবেশ তৈরির কারণ নিয়ে আলোচনা, কিন্তু প্রশ্ন তো আজকের আফগানিস্তান নিয়ে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ আসরাফ গনি সরকারের পতন এবং ২০ বছর পর তালিবানদের কাবুল দখলের পিছনে ঠিক কী কী কারণ কাজ করেছে। ২০২১- এর এই ঘটনা নিয়ে আলোচনার আগে আমাদের একবার যেতে হবে ২০২০-তে।
২০২০র ফেব্রুয়ারি মাসের ২৯ তারিখে, তালিবান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি হয়। যার শর্ত ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে তার সমস্ত সেনা প্রত্যাহার করতে হবে এবং উল্টোদিকে তালিবানরাও আর হামলার পথে যাবে না। তবে এই চুক্তির এক বছর পেরতে না পেরতেই, ছবি সম্পূর্ণ বদলে গেল। ২০২১-এ ফের হামলায় নামল তালিবানরা। একের পর এক আফগান সৈন্যদের সাথে লড়াই চালিয়ে শেষে অগাষ্টে এসে তারা কাবুলের দখল নিল। আবার অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সেনা প্রত্যাহারের কাজ জোরকদমে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এবং সম্প্রতি তালিবান আক্রমণের ঘটনার পরও মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান জো বিডেন যে বক্তব্য রেখেছে তা থেকে স্পষ্ট তারা এই যুদ্ধ আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না। সে স্পষ্ট জানিয়েছে, ৩১ আগস্টের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সমস্ত মার্কিন সেনা সরিয়ে নেওয়া হবে। ভাসা ভাসা ভাবে বিডেনের বক্তব্য শুনলে মনে হবে সে তার নিজের দেশ ও তার জনগণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। এবং সে অন্য দেশের জন্য নিজেদের সেনার অকারণ প্রাণ বলিদানকে যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করছে না। তবে বিষয়টা ঠিক এতটা সরল নয়। এই যুদ্ধে আমেরিকার পিছিয়ে আসার পিছনে আরও বেশ কিছু বিষয় কাজ করেছে। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমেরিকার লাগাতার হস্তক্ষেপ সে দেশের জনগণ মেনে নিতে পারেনি। নিজেদের দেশে বিদেশি সেনার দাপাদাপি তাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছিল। এর ফলেই আমেরিকার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সে দেশের জনগণের মনে ক্ষোভ বাসা বাঁধছিল। অন্যদিকে ক্ষমতা হারানোর পরও গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ চালিয়ে গেছে তালিবানরা। আমরা জানি, কোনো দেশেই জনসমর্থন ছাড়া গেরিলা যুদ্ধ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় এবং আফগানিস্তানবাসীর তালিবানদের সমর্থন করার ক্ষেত্রে যে যুক্তিটা কাজ করেছিল, তা হল আফগানিস্তানে আমেরিকার হস্তক্ষেপ। তালিবানরা বারবার ফিরে এসেছে নতুন রণকৌশল নিয়ে, যাকে ঠেকানো আমেরিকার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠছিল। একের পর এক এলাকার দখল নিচ্ছিল তালিবানরা। যত সংখ্যক লোক প্রতি বছর আফগানিস্তানের সেনায় নিয়োজিত হচ্ছিল, তার থেকে বেশি প্রাণ হারাচ্ছিল এই যুদ্ধে। এই যুদ্ধ আমেরিকার হার খানিক নিশ্চিত করে দিয়েছিল। এছাড়াও ২০০৮-২০০৯ এর অর্থনৈতিক মন্দার পর, ২০১৬-র শেষদিক থেকে এবং বিশেষত এই করোনা কালের পর থেকে আমেরিকা ক্রমশ আরো আর্থিক সংকটের মধ্যে ডুবতে শুরু করেছে। বাজারের উপর আমেরিকার একচেটিয়া দখলও ভাঙতে শুরু করেছে। তাই আজ যুদ্ধ চালানোর জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় প্রয়োজন তা আমেরিকার কাছে একটা বাড়তি বোঝা। ফলত মাঝ মাঠ থেকে ধীরে ধীরে সাইডলাইনের দিকে আসা শুরু করেছে আমেরিকা। আর অন্যদিকে মাঝ মাঠে দাঁড়িয়ে চিন।
মাও সেতুং- এর মৃত্যুর পর থেকেই চিন তার মতাদর্শগত অবস্থান থেকে সরতে শুরু করেছে। অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও অনুপ্রবেশ করা শুরু করেছে। এবং সর্বোপরি এই বাজার দখলের লড়াইয়ে আমেরিকাকে জোর টক্কর দিচ্ছে। শেষ কয়েকদিনের খবরের দিকে নজর রাখলে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, তালিবানদের আফগানিস্তান দখলে চিন ঠিক কতটা উৎসাহী। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু তথ্য সামনে এসেছে, যাতে জানা যাচ্ছে কাবুল থেকে মাত্র ২৫ কিমি দূরে একটি তামা খনি ৩০ বছরের জন্য লিজে নিয়েছে চিন। অন্যদিকে আফগানিস্তানে তালিবান সরকারও বারবার চিনকে আশ্বাস দিয়ে চলেছে যে তারা চিনের কোনো প্রজেক্টে ব্যাঘাত ঘটাবে না উপরন্তু তাদের সহোযোগিতা করবে এবং তাদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে। গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, যে ইতিমধ্যেই চিন, রাশিয়া এবং পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন আলোচনায় জড়িয়েছে তালিবানরা। সাথে চলছে শুভেচ্ছা আদান প্রদানও।
হয়ত আগামীতে আফগানিস্তানের এই ঘটনাটাই আন্তর্জাতিক রাজনীতির পট পরিবর্তনের একটা কারণ হয়ে দাঁড়াবে।