তাঁর প্রয়াণে ভারতের কোনো রাজনৈতিক দল এখনও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে প্রেস বিবৃতি দেয়নি। ভারতের বহু কমিউনিস্ট পার্টির কোনো পার্টিই তাঁর মৃত্যুতে তাদের লাল পতাকা অর্ধনমিত রাখেনি। তিনি ইয়ান মিরদাল। ৯৪ বছর বয়সের তরতাজা যুবক। সুইডিশ নোবেল দম্পতির সন্তান। এ সবের থেকে বড়ো পরিচয় তিনি লেখক। সাহিত্যের নানা বিষয়ে ইউরোপ সহ সারা বিশ্বে তিনি সমাদৃত। কখনও নাটক লিখেছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের যুদ্ধ সংক্রান্ত পোস্টারের বিশ্লেষণ করেছেন। কখনও নিজেকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন। ব্যঙ্গচিত্র বা ক্যারিকেচার আর্ট নিয়ে বই লিখেছেন। আবার কখনও মদ বা সুরা নিয়ে লিখেছেন। তাঁর বই ‘কনফেশন অফ এ ডিজলয়াল ইউরোপিয়ান’ তো বহুল আলোচিত।
গত বছর ১৪ এপ্রিল স্টকহোমে এক সেমিনারে তাঁর আরও একটি বই প্রকাশিত হয়। তাঁর লেখক জীবনের ৭৫ বছর পূর্তিতে ছিল সেই সভা। আয়োজন করেছিল ‘ফোকেট’ পত্রিকা। গত ৭০ বছর ধরে এই পত্রিকা এক বামপন্থী ঘরানার খবর পরিবেশন করে আসছে কোনো সরকারি বা বেসরকারি অনুদান ছাড়াই। মানুষের ভালোবাসায় এই পত্রিকা এখন বহুল প্রচারিত। উল্লেখ্য, এই সেমিনারের সহ আয়োজক ছিল নোবেল সুইডিশ একাডেমি। যাদের নোবেল প্রাইজ নিয়ে বহুবার মিরদাল সমালোচনা করেছেন। সেমিনারে প্রকাশিত বইয়ের বিষয় ছিল নিজের ব্যক্তিগত জীবনের অনালোচিত কথা। এটি ওঁর শেষ লেখা বই হলেও তারপর বহু সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ে মিরদাল ছিলেন সদা সক্রিয়।
ভারতবর্ষ নিয়ে তাঁর দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। ‘ইন্ডিয়া ওয়েটস’ ও ‘রেড স্টার ওভার ইন্ডিয়া: অ্যাজ দ্য রেচেড অফ দ্য আর্থ আর রাইজিং’। দুটি বই তিনি লিখেছেন প্রায় ২৫ বছরের ব্যবধানে। বই দুটি তিনি কোনো দলিল-দস্তাবেজ-বই সংগ্রহ করে বা কেবল পড়াশোনা করে লেখেননি। বইগুলির পেছনে আছে ভালোবাসা ও নিবিড় শ্রমের ইতিহাস। প্রথম বই লিখতে গিয়ে তিনি ৫ বার ভারতে এসেছেন। এ দেশের গ্রাম গঞ্জ শহরে ঘুরে মানুষের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ গড়ে তুলেছিলেন। ১০ বছর ধরে কাজ করার পর বই লিখতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছে ভারত সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আবার বেরিয়ে পড়েছেন। আবার গবেষণা- পথ কখনও আত্মীয়তার, কখনও বন্ধুর। কাঁটায় ভরা। ‘ইন্ডিয়া ওয়েটস’-এর মতো বই আবার আরেকটি কেউ লিখতে গেলে তাঁকে মিরদালের অধ্যবসায়কে ছাপিয়ে যেতে হবে। তিনি ভবিষ্যতের গবেষকদের জন্য একটি মান নির্ধারণ করে গিয়েছেন। ভারতের অর্থনীতি সমাজ সংস্কৃতি শিল্প রাজনৈতিক টানাপড়েন- তাঁর বইতে এক অন্য মাত্রা পেয়েছে। এমন বই লিখতে গেলে ভালোবাসতে হয়। দেশের মানুষদের জন্য ক্ষতবিক্ষত হতে হয়। মিরদালের মতো এক বিদেশি লেখকের এই দরদ ছিল। এই বইয়ের প্রতিটি পাতা তার সাক্ষ্য বহন করে। ‘ইন্ডিয়া ওয়েটস’-এর সঙ্গে এই প্রাবন্ধিকের পরিচয় ১৯৮৯ সাল নাগাদ। অপার বিস্ময়ে তখন আমি দেখেছি, কীভাবে ভারতবর্ষের মানুষের এক ছোটো অংশ অনাবিল সম্পদ ভোগ করে আর বেশিরভাগ মানুষ তার যোগান দিয়ে চলে। লেখক জাঁ মিরদাল ভারতের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সংস্কৃতি, আমলাতন্ত্র ও বিচারব্যবস্থার বিচার বিশ্লেষণ করে পাঠকের সামনে এক অন্য ভারতের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেন। তাঁর বইতে কোথাও উদ্ধৃতির বাহুল্য নেই। আছে যুক্তি ও ভালোবাসার নিটোল মন্তাজ। এই ভারতের ছবিতে এ দেশের অসহায়তা অনুভব করে পাঠক কিন্তু হতাশায় নিমজ্জিত হবেন না। তাঁর আশাবাদ এক নতুন প্রত্যয়ের কথা বলে। বইটির আকর্ষণ এমনই ছিল যে, কলেজ স্ট্রিট থেকে ধর্মতলা যেতাম শুধু বইটা একবার দেখবো বলে। বহুদিন ধরে গ্র্যান্ড হোটেলের সামনে গিয়ে একটার পর একটা পাতা উলটিয়ে শেষ অবধি বইটি কিনেই নেওয়া গেলো। তখনকার সময়ে ১২০ টাকা দিয়ে বইটি কিনেছিলাম। এরপর বহু বন্ধু প্রিয়জনকে বইটি উপহার দিয়েছি।
সময় গড়িয়েছে। ২০০৩ সালে, আমি ও আমার চিরসাথী মিলে ‘সেতু প্রকাশনী’র মধ্য দিয়ে প্রকাশনায় আসা। আমরা রাজনৈতিক আন্দোলন বা সমাজ সম্পর্কিত অনেক বই প্রকাশ করেছি। কিন্তু একটা খোঁজ ছিল, ‘ইন্ডিয়া ওয়েটস’-এর পর কী? কীসের জন্য ভারবর্ষ অপেক্ষা করছে। সময় তো বয়ে যায়। খোঁজ ছিল বলেই হয়তো আমার এক বন্ধু পীযূষ জানতে চাইলো, আমরা জাঁ মিরদালের বই প্রকাশ করবো কিনা? সাল ২০১১। আমি তখনই জানতে চাইলাম যোগাযোগের উপায়। ই মেইলে যোগাযোগ করলাম। উনি দ্রুত উত্তর দিলেন। তারপরটা ইতিহাস। ‘ইন্ডিয়া ওয়েটস’-এর পর যে পাণ্ডুলিপি উনি আমায় মেইল করলেন, তার নাম, ওঁরই দেওয়া, ‘রেড স্টার ওভার ইন্ডিয়া: অ্যাজ দ্য রেচেড অফ দ্য আর্থ আর রাইজিং’। আমাদের তখন প্রিন্টারও ছিল না। কিন্তু সমগ্র পাণ্ডুলিপির এতটাই বাঁধুনি ছিল যে পুরোটাই কম্পিউটার স্ক্রিনে পড়ে ফেললাম। শিখলাম অনেক কিছু। অনুভব করলাম কিছুই জানি না। ‘ইন্ডিয়া ওয়েটস’-এ পরিবেশ, জাতপাত, নারী প্রশ্নে উনি যে সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তাই যেন ফিরে আসলো এই নতুন পাণ্ডুলিপিতে। কখনও দণ্ডকারণ্যের কথা বলতে গিয়ে মহাভারত রামায়ণের কথা বলেছেন, আবার কখনও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার পচনের কথা বলতে গিয়ে মাছের পচন যে মাথা থেকে শুরু হয়, তার কথা বলেছেন। ভাতেমাছে বাঙালির কতজন এর সারবত্তা জানি?
‘রেড স্টার ওভার ইন্ডিয়া…’ বই হিসেবে রাজনৈতিক সামাজিক বিতর্ক গড়ে ওঠার প্রেক্ষিতে বা জনপ্রিয়তার নিরিখে এক ছাপ রেখে যায়। তিনি নিজে একটি কপি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমকে পোস্ট করে দেন। এরপরই সংসদে বলা হয়, ওঁর ভারতে আসার ব্যাপারে সরকার সম্মতি দেবে না। মিরদালের এ নিয়ে কোনো ক্ষোভ ছিল না। উনি বারবার বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে কোনো পরামর্শ দেওয়ার মতো বোকামি তিনি কখনওই করেননি। তিনি কেবলমাত্র এক পর্যবেক্ষক, লেখক হিসেবে তাঁর মতামত ব্যক্তি করেছেন। প্রত্যয়ের সাথে বলেছেন, তিনি নিরপেক্ষ নন। তিনি মানুষের পক্ষে। এই মনোভাবের জন্যই তিনি অনন্য।
গতবছর তাঁর ভারবার্গের বাড়ির লাইব্রেরিতে বইয়ের সম্ভার দেখছিলাম। কী নিখুঁত ভাবে, কী মমতা, ভালোবাসায় বইগুলি অধ্যয়ন করেছেন। গত শতকের চারের দশকে সিপিআই প্রকাশিত ‘কমিউনিস্ট ইস্তাহার’ সম্বন্ধে উনি বললেন, কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস ইউরোপের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট ইস্তাহার লিখেছিলেন। ভারতের মতো একটি কৃষিভিত্তিক পিছিয়ে পড়া দেশে এক মেহনতি মানুষ- কৃষক বা শ্রমিকের কাছে ভারতীয় প্রেক্ষিত ব্যাখ্যা করা জরুরি ছিল। সেটাই সে সময় পার্টি করেনি। এটা একটা ব্যর্থতা। আমরা যারা চিন্তা-চেতনার দাসত্ব থেকে মুক্তির কথা বলি, তারা এই কথা এখনও বললাম না কেন? সত্যিই কি আমরা মানুষের কাছে দায়বদ্ধ? প্রশ্নটা থেকেই গেল।
মিরদালের বাড়ির লাইব্রেরিতে লেখক ও তাঁর পরিবার (ছবিটি লেখকের সংগ্রহ থেকে পাওয়া)
ভারবার্গে প্রথম যে দিন ওঁর লাইব্রেরিতে দেখা করতে যাই, তখন দেখি উনি সাতসকালে আমাদের জন্য স্ল্যাক্স-ড্রিংক্স টেবিলে নিয়ে তৈরি। উৎসাহ ভরে অনেক কথা বললেন। বারবার বলছিলেন, ‘আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি দ্যাট ইউ হ্যাভ কাম হিয়ার’। বাড়িতে উনি একাই থাকতেন। ওঁর সহযোগীরা মাঝেমধ্যে আসলে ছোটোখাটো বাজার নিজেই করতেন। ওঁর সর্বক্ষণের সাথি ছিল একটি ১৩ বছর বয়সি বিড়াল। সারাক্ষণ বিড়ালটি কিন্তু আমাদের ‘নজরে’ রেখেছিল। সারা লাইব্রেরি প্রায় ভরে রয়েছে বই আর বহু পুরনো সব পেপার কাটিং-এ। এমনকি লাইব্রেরিতে দেখেছি শান্তি স্কার্ফ যা পাবলো পিকাসো ওঁকে উপহার দিয়েছিলেন। বাড়ির দেওয়ালে বইয়ের প্রচ্ছদের ছবি, রাস্তায় ব্যারিকেডে ওঁর ছবি বা মাও সে তুঙের সঙ্গে ওঁর ছবি এক ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। আসার সময়ে বলেছিলেন, আবার দেখা হবে। লকডাউনের সময়েও ফোনে কথা হয়েছিল। ওঁর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে বললেন, বয়সের ভার ছাড়া কোনো সমস্যা নেই। কোভিড নিয়ে দেখলাম চিন্তিত নন। বাড়ির গুরুজনদের মতো আমার পরিবার, মেয়েদের কথা জানতে চাইলেন। তারপর মেলেও কথা হয়নি। ভেবেছিলাম হয়তো একটু অসুস্থ, পরে উত্তর দেবেন। ওঁর বন্ধু স্কানসেন জানিয়েওছিলেন যে উনি একটু অসুস্থ। হার্টের সমস্যা রয়েছে, বয়স তো আছেই। তবে মাথা সবল। মনটা একটু কু ডাকছিল। হঠাৎই ফেসবুক মারফত ওঁর চলে যাওয়ার খবর দেখলাম। এ ক্ষতি ভারতের মেহনতি মানুষেরও। তাঁদের লড়াইয়ের কথা নির্ভয়ে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার এক মানুষ চলে গেলেন।
পাখির পালক দেখেছি। থাই পাহাড় দেখিনি। কিন্তু অন্তর দিয়ে অনুভব করছি, ‘জন্মিলে মরিতে হবে, জানে তো সবাই/তবু মরণে মরণে ফারাক আছে ভাইরে/ সব মরণ নয় সমান’।