(কোভিড১৯ অতিমারি আদৌ কতটা বিপজ্জনক, তা নিয়ে দুনিয়া জুড়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য অনুযায়ী এই রোগে ৮০ শতাংশ মানুষ এমনি এমনি সেরে ওঠেন। বাকিদের ওষুধ খেতে হয় ও হাসপাতালে যেতে হয়। অতএব স্পষ্ট যে, এই মুহূর্তে বিশ্বে মোট যতজন আক্রান্ত বলে দেখানো হচ্ছে, তার ৯৮ শতাংশ কোনো না কোনো মাত্রায় অসুস্থ হয়ে চিকিৎসক বা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলেন। বাকি দু শতাংশকে হয়তো যথেচ্ছ পরীক্ষার মাধ্যমে খুঁজে বের করা হয়েছে। ফলে মৃতের সংখ্যা বলে যেটা দেখানো হচ্ছে, সেটা এই অসুস্থ মানুষদের মধ্যেই। বিশেষজ্ঞদের কথা অনুযায়ী বাকি প্রায় ৮০ শতাংশ এই হিসেবে নেই। অর্থাত মোট আক্রান্তের সংখ্যা দৃশ্যমান সংখ্যার ৫ গুন। সেটা হলে বর্তমান মৃতের সংখ্যার হিসেবে মৃত্যুহার ১ থেকে ১.৫ শতাংশ। যা নেহাতই কম। আসলে কোনো রোগকে অতিমারি ঘোষণার সঙ্গে স্বাস্থ্যব্যবসার জড়িয়ে থাকার অভিযোগ অনেক পুরনো। অনেকেই মনে করেন সার্স, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, কোভিড ১৯- সবকটি অতিমারিই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তৈরি করছে স্বাস্থ্যব্যবসায়ীদের স্বার্থে (যদিও ভিন্ন মতও আছে। তা তো থাকবেই।)। ২০১০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সোয়াইন ফ্লু অতিমারি বিদায় নিয়েছে ঘোষণা করার পর বহু প্রতিবেদন,গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় সোয়াইন ফ্লু-কেলেঙ্কারি নিয়ে। করোনার বাজারে এখন নতুন করে তা নিয়ে লেখালিখি চলছে। গবেষণাপত্রগুলিতে আপাতত নজর না দিয়ে আমরা ২০১০ সালে দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করলাম। বলে রাখা দরকার, করোনার মোকাবিলায় চিকিৎসকরা যে নির্দেশ দিচ্ছেন, তা অমান্য করতে বলা এই প্রতিবেদন প্রকাশের উদ্দেশ্য নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মসূচিও যে বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলিই ঠিক করে দেয় এবং সেটা যে সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার অঙ্গ- সে সম্পর্কে পাঠকদের ধারণা দেওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য। এই বিষয়ে নেটে খোঁজ করলে আরও মূল্যবান বহু প্রবন্ধের খোঁজ মিলবে। আগ্রহীরা পড়ে নিন।)
প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ফ্লু অতিমারির জন্য সরকারগুলিকে ওষুধ সঞ্চয় করার পরামর্শ দিয়ে যারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা তৈরি করেছিলেন, তারা এর আগে বিভইন্ন লাভজনক ওষুধ সংস্থার সঙ্গে আর্থিক সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন।
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল এবং ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের তদন্তে দেখা যাচ্ছে, ২০০৪ সালে হু-এর নির্দেশিকা যে তিনজন বিজ্ঞানী তৈরি করেছিলেন, তারা তার আগে রোচে (ট্যামি ফ্লু নির্মাতা) ও গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন(রেলেনজার নির্মাতা)-এর থেকে অন্য কাজের জন্য টাকা পেয়েছেন।
হিসেব মতো ওষুধ সংস্থাগুলো বিভিন্ন দেশের সরকারকে ৭ বিলিয়ন ডলারের ওষুধ বিক্রি করেছে। ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু-তে বিপুল মৃত্যুর আশঙ্কা প্রকাশ করার পর সেটা সত্যি না হওয়ায় জনস্বাস্থ্য নীতির স্বচ্ছতা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
২০০৯ সালে হু সোয়াইন ফ্লু-কে অতিমারি ঘোষণা করার পর পোল্যান্ড আতঙ্কে ওষুধ সঞ্চয় করার লাইনে দাঁড়াতে চায়নি। অন্যদিকে গ্রেট ব্রিটেন ১ বিলিয়ন পাউন্ডের ভ্যাকসিন ও অ্যান্টিভাইরাল কেনে। সে দেশে ৬৫০০০ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। এখন সেদেশের সরকারি কর্তারা ওষুধ কেনার চুক্তিগুলো ঝেড়ে ফেলতে ব্যস্ত।
অকারণ ওষুধ কিনে করদাতাদের কত টাকা নষ্ট করা হয়েছে তা নিয়ে সরকারি স্তরে তদন্তও হচ্ছে। .
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও এ নিয়ে সরব।
লেবার পার্টির সাংসদ পল ফ্লিন বলেছেন, “সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ওষুধ সংস্থাগুলো প্রভাব ফেলেছে।…ইউরোপ জুড়ে অকারণ ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, করদাতাদের প্রচুর টাকা নষ্ট করা হয়েছে এবং জনস্বাস্থ্য পরিষেবায় অগ্রাধিকারের প্রশ্নে আপস করা হয়েছে। হু-র আরও স্বাচ্ছ হওয়া প্রয়োজন”।
বিশেষজ্ঞরা ওষুধ সংস্থাগুলির সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কথা গোপন করেননি। তারা বলেছেন, সেসব সম্পর্কই নাকি গবেষণা ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের। কিন্তু বিশ্বা স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের ২০০৪-এর নির্দেশিকায় তা প্রকাশ করেনি। বরং তারা বলেছে, “যে সব দেশ অতিমারির মোকাবিলায় অ্যান্টিভাইরাল ব্যবহার করতে চায়, তাদের আগেভাগে ওষুধ কিনে রাখা উচিত”।
বহু দেশ ওই নির্দেশিকা গ্রহণ করে। ২০০৫ সালে ব্রিটেন প্রচুর ট্যামি ফ্লু কেনা শুরু করে। এশিয়ায় ৪০ জনের মৃত্যুর পরই ব্রিটেন ১৪.৬ মিলিয়ন ডোজ কিনে নেয়।
অ্যান্টিভাইরাসের জন্য নির্দিষ্ট নির্দেশিকাটি লিখেছেন প্রফেসর ফ্রেড হেডেন। নির্দেশিকাটি লেখার সময় যে তিনি অন্য নানা করাণে রোচে সংস্থার থেকে টাকা পেয়েছেন, তা তিনি স্বীকার করেছেন। জিএসকে-র থেকে তিনি টাকা নিয়েছেন(অন্য কারণে) ২০০২ সালে।
ট্যামি ফ্লু খেলে সোয়াইন ফ্লু আক্রান্ত ৬০ শতাংশ মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে না- এই নিয়ে কিছুদিন আগে রোচে সংস্থা একটি রিপোর্ট তৈরি করে। সেটিরও অন্যতম প্রধান লেখক ছিলেন প্রফেসর হেডেন।
অতিমারিতে টিকার ব্যবহার নিয়ে হু-এর রিপোর্টটি লেখেন ড. আর্নল্ড মন্টো। ২০০০ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে সেটি লেখা হয়, সেই সময় অন্য নানা কারণে মন্টো রোচে ও জিএসকে-র থেকে টাকা পাচ্ছিলেন। হু কিন্তু ‘স্বার্থের সংঘাত’ সংক্রান্ত কিছুই জানায়নি ওই রিপোর্টে। মন্টো বলেছেন, তিনি সবই হু-কে জানিয়েছিলেন।
তৃতীয় বিজ্ঞানী, প্রফেসর কার্ল নিকলসন, ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারি সংক্রান্ত হু-এর গুরুত্বপূর্ণ দলিলের রচয়িতা। তিনি যে জিএসকে ও রোচে থেকে স্পনসরশিপ পেয়েছেন, তা তিনি ২০০৩ সালেই জানিয়েছিলেন।
এক্ষেত্রেও ‘স্বার্থের সংঘাত’ সংক্রান্ত কোনো ঘোষণা প্রকাশিত হয়নি। নিকলসনও জানিয়েছেন যে তিনি হু-কে সবই জানিয়েছিলেন। হু-এর একজন আধিকারিক জানিয়েছেন, ওই দলিলগুলো খুবই বিশাল মাপের এবং বহুলোক তা পড়বে, তাই লেককদের গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে।