

বাগদাদে মার্কিন বিমান হানায় ইরানের কোয়াড ফোর্সের জেনারেল কাসিম সোলেইমানি এবং ইরান সমর্থিত ইরাকি মিলিশিয়ার প্রধান আবু মেহদি আল মুহানদিসের হত্যার ঘটনায় ইরাক এবং ইরান বিরোধিতা করেছে স্বাভাবিক ভাবেই। তাদের বক্তব্য মার্কিন সেনা যে শর্তের ভিত্তিতে ইরাকে রয়েছে, তাতে প্রয়োজনে বিমান হানার কোনো সংস্থান নেই। ইরান প্রতিশোধ নেবে বলে জানিয়ে দিয়েছে।
তৃতীয় পক্ষগুলির মধ্যে রাশিয়া এর তীব্র নিন্দা করেছে, এই ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়বে বলে মত প্রকাশ করেছে।ইজরায়েল বলেছে, আমেরিকা যা করেছে তা নিজেদের রক্ষা করার জন্য করেছে এবং ঠিক করেছে। আর চিন? তারা বলেছে আমেরিকার শান্ত হওয়া উচিত। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপুঞ্জের নীতি মেনে কোনো পক্ষেরই হিংসার আশ্রয় নেওয়া উচিত নয়।
ঘটনার পর ইরানকে আলোচনার বার্তা দিয়েছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট।অর্থাত, আমেরিকা আপাতত বিশ্বযুদ্ধ এড়াতে চাইছে। কিন্তু আমেরিকা কী চাইল বা রাষ্ট্রপুঞ্জ কী নীতির বাঁধনে সবাইকে বাঁধতে চাইল, তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ সাম্রাজ্যবাদ মানেই যুদ্ধ। তাদের মুনাফার লোভই দুনিয়ায় যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে বারবার।মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দখল রাখার জন্য আমেরিকা হাজার ঘোষণা সত্ত্বেও ইরাক থেকে সেনা সরাতে পারছে না। অন্যদিকে ইরান চাইছে ইরাকের রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিজেদের দখলদারি। তাদের সাহায্য করছে রাশিয়া ও চিন।ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি রয়েই গেছে।
গত বছরের অক্টোবর থেকে ইরাকি জনগণ বেকারত্ব, দুর্নীতি ও সরকারি পরিষেবার দুরবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।তাদের বক্তব্য, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির থেকে বেশি তৈল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও দেশের এতটা খারাপ অবস্থা হওয়া সম্ভব নয়। জনতার সেই বিক্ষোভের সূচিমুখে যেমন আমেরিকা রয়েছে, তেমনই রয়েছে ইরানি দখলদারি।যদিও এই আন্দোলনকে মূলত ইরানের বিরুদ্ধে পরিচালিত করতে গোপন কার্যকলাপ চালাচ্ছিল আমেরিকা। গণ আন্দোলনে নিজেদের প্রভাবও বাড়িয়েছিল। গোটা আন্দোলনের পর্যায়ে বেশ কিছু মার্কিনপন্থী ব্যক্তি ও মার্কিন নাগরিককে গোপনে হত্যা করে ইরান সমর্থিত ইরাকি মিলিশিয়া সদস্যরা। যাদের নেতা ছিলেন নিহত মুহানদিস। ইরানের পক্ষ থেকে এদের সাহায্য করছিলেন সোলেইমানি।ইরাকের আইসিস, আল কায়দাকে পর্যুদস্ত করে একসময় ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। পাশাপাশি ইরানের স্বার্থ রক্ষায় চালাচ্ছিলেন মার্কিনবিরোধী কার্যকলাপ।
মিলিশিয়ার ক্ষমতা ধ্বংস করতে কিছুদিন আগেই কাদাইব হিজবোল্লায় বিমান হানা করে আমেরিকা। তার প্রতিবাদে মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও করে আন্দোলন করছিলেন ইরাকের জনগণ। এই অবস্থায় মার্কিন দূতাবাস চত্বরে ঢুকে পড়ে ইরাকি মিলিশিয়ারা। নিরাপত্তারক্ষীরাও তাদের জায়গা ছেড়ে দেয়। বর্ষশেষের রাতে তুমুল মারামারি চলে মার্কিন দূতাবাসে। এই ঘটনার পেছনে সোলেইমানি ও মুহানদিসের ভূমিকা জেনেই বিমান হানায় তাদের হত্যা করল আমেরিকা। তাদের আশা, এর মধ্য দিয়ে তারা ইরাকি জনতার ইরানবিরোধী অংশকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারবে।
কিন্তু মনে রাখা দরকার সাদ্দাম হোসেনের জমানার বহু সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা সত্ত্বেও সেই সময় ইরাকে আপেক্ষিক ভাবে কিছুটা স্বাধীন,ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা সক্রিয় ছিল। যদিও তাতে রাশিয়ার মদত ছিলই। তবুও সেই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা সহজে চলে যাওয়ার নয়। সাম্প্রতিক গণ আন্দোলনে সেই ছবিটাই সামনে এসেছে। পথে নেমে পড়েছেন ইরাকের শ্রমজীবী জনতাও। তারা কোনো ভাবেই আমেরিকাকে তাদের বন্ধু মনে করেন না।গত আঠাশ বছর ধরে ইরাকে অর্থনীতিকে তারা ধ্বংস করেছে। সাদ্দামের মৃত্যুর পর গত ষোল বছরে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।বিমান হানার পর ইরাকি জনগণের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা বাড়বে বৈ কমবে না। দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন এখানে জড়িত। ইতিমধ্যেই গণ আন্দোলনের জেরে পদত্যাগ করেছেন ইরাকের প্রধানমন্ত্রী, পদত্যাগ করতে চেয়েছেন রাষ্ট্রপতিও। আমেরিকা বা ইরান, তাদের লড়াইয়ের ভূমি হিসেবে ইরাককে কাজে লাগাক, এটা ইরাকিরা চান না। তাদের গণ আন্দোলন যত তীব্র হবে ততই শান্তির পথে হাঁটতে বাধ্য হবে দুই বৈদেশিক শক্তি। মার্কিন বিরোধী জোটকে শক্তিশালী করার লক্ষ্য নিয়ে এদিনই পাকিস্তানকে ২০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য পাঠিয়েছে ইউএই।
মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সলতে পাকানো শুরু হবে না বিবদমান পক্ষ বাধ্য হবে আলোচনার টেবিল ও চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের পুরনো পথে ফিরতে, তার চাবিকাঠি রয়েছে ইরাকের সংগ্রামী জনগণের হাতে। মনে রাখতে হবে, মন্দায় দীর্ণ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে টিকে থাকার জন্য বাজার দখলের যুদ্ধ ছাড়া গতি নেই।