পার্লে জি থেকে পোর্শের গাড়ি, কিছুই খাচ্ছে না বর্তমান ভারত। পার্লে জি ক্রেতাদের হাতে নিজের জন্যে খরচ করার মতো পাঁচ টাকাও নেই। অন্য দিকে যাদের কাছে মূলধন রয়েছে তাঁরাও খরচ করতে চাইছেন না সঙ্কট অনুমান করে। এই অবস্থায় চিন্তার ভাঁজ অর্থনীতিবিদদের কপালে। স্পষ্টই বলছেন, এই ঝিমুনি কাটিয়ে ওঠার দাওয়াই খুঁজে না পেলে প্রবল বিপর্যয় মুখোমুখি হতে হবে ভারতবাসীকে।
আরও পড়ুন: সোভিয়েত-মুজাহিদিন দ্বন্দ্বের ছায়ায় আফগানিস্তানের প্রান্তরে বলিউডি স্বপ্ন
অর্থের গতিবেগ নেই। অর্থাৎ পণ্য কিনছে না মানুষ। এমত অবস্থায় কী করবে বেসরকারি সংস্থাগুলি। গাড়ি শিল্পে দেদার ছাঁটাই চলছে। অনেকে উৎপাদন কমিয়ে আনছেন। তবে ঘুরিয়ে সঙ্কট মোকাবিলার পথ অনেক দিনই বেছে নিয়েছে ই-কমার্স সংস্থাগুলি। তাঁরা প্ৰথম দিনই ডেলিভারির কাজে নিযুক্ত কর্মীদের বলে দেন, তারা এই সংস্থার পরিবারের অংশ নয়। তাঁরা ফ্রিল্যান্সার/পার্টনার। কাজের ভিত্তিতে টাকা দেওয়া হবে। এই ঘোষণার সুবিধে অনেক। সরাসরি কর্মচারী হিসেবে একজন ব্যক্তি নিযুক্ত না হলে সংস্থার লাভ অনেক। শ্রম আইন ফাঁকি দেওয়া যায় সহজে, কাউকে কৈফিয়ত দিতে হয় না। বিমা, পিএফ, গ্র্যাচুইটি কিছুই দিতে হয় না। এদিকে যে টার্গেট দেওয়া হয়, তা পূরণ করতে দৈনিক অন্তত ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। রাতারাতি নীতি বদলে ফেলতে পারে সংস্থা। যেমন, গত সেপ্টেম্বর মাসেই জোম্যাটোর ডেলি্ভারি ইন্সেনটিভ ৪০ টাকা থেকে কমিয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। এই অবস্থায় ডেলিভারি পার্টনারদের রোজগার একই রাখতে বেশি খাটতে হচ্ছে অন্তত তিন-চার ঘণ্টা । কিন্তু প্রতিবাদ করা যাবে না। মাথার ওপরে ঝুলছে খাঁড়াও। প্রতিবাদ করে কাজ হারিয়েছেন বেঙ্গালুরুর বহু কর্মী। প্রায় একই সময়ে গুরুগ্রামেও কাজ গিয়েছে ৫০০ ডেলিভারি পার্টনারের। নতুন রোজগারের স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু। আর তারপরে কাজ বাঁচানোর জন্যে অহরহ দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই। ‘বাইক থাকলেই মাসে চল্লিশ হাজার’ -এই স্বপ্ন দেখিয়ে যে কর্মীদের কাজে নেওয়া হয়, তাঁরা প্রতিদিন দুশো কিলোমিটার বাইক চালিয়েও এই টাকা রোজগার করতে পারেন না। শুধু তাই নয়, ক্ষুন্নিবৃত্তির প্রয়োজনীয় অর্থের পিছনে ছুটতে গিয়ে যদি প্রাণ যায় তাহলেও তার দায়ভার নেবে না কেউ। বেঙ্গালুরুতে অগস্ট মাসের ২০ তারিখ দুনজো নামক এক সংস্থার ২৪ বছর বয়েসি দলিত ডেলিভারি পার্টনার চিন্তা রবীন্দ্র খাবার দিতে গিয়ে পথেই অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। মৃত্যুর পরে কোনও ক্ষতিপূরণ দেয়নি সংস্থা। বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছে দলিত সংঘর্ষ সমিতি। তবে সুরাহা হয়নি। রেটিংয়েই বাঁচা রেটিংয়েই মরা এই রবীন্দ্রদের।
রাজ্যভেদে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলির এই শোষণের চিত্রটা মোটামুটি এক। অথচ কোনও ট্রেড ইউনিয়নকে এই নিয়ে রাস্তায় ঝড় তুলতে দেখা যায়নি। চুপ নাগরিক সমাজ, যারা প্রত্যক্ষ ভাবে এই পরিষেবা উপভোগ করেন। এই সূত্রগুলি নাগরিক সমাজকে অতীতে যারা ধরিয়ে দিয়ে এসেছেন, সূক্ষ্ণতার সঙ্গে অভিঘাত হেনেছেন মর্মের মূলে, সেই শিল্প সংস্কৃতি জগতকে বিষয়টি তাড়িত করনি। বাজারধর্ম এবং শ্রেণি বৈষম্যের কারণেই বিষয়টি সামাজিক সমস্যা হিসেবে পরিগণিত হয়নি।
শুধু ভারতই নয়, ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেনের অবস্থাও কিন্তু শোচনীয়ই। অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, চার বছরের মধ্যে ফের ধসে যাবে ব্রিটিশ অর্থনীতি। মানুষের ক্রয়ের পরিমাণ একই রকম ভাবে পড়তে শুরু করেছে। দশকের দুর্বলতম বিকাশ হার অর্থনীতির পতনের বড়ো ইঙ্গিত। এই অবস্থায় শ্রমিক শোষণ-শ্রমিক বঞ্চনা যে একই রূপ নেবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে পার্থক্য এই যে, ব্রিটেনে বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলার লোক রয়েছেন। কেন লোচের ‘সরি উই হ্যাভ মিসড ইউ’ ছবিটিতে উঠে এসেছে ই-কমা্র্সের অসংগঠিত শ্রমিকের জীবনের পরিহাস। একই সময়ে কলকাতার মানুষ চলচ্চিত্র উৎসবে এবং লন্ডনের থিয়েটারগুলিতে সিনেমাপ্রেমীরা ছবিটি দেখার সুযোগ পেলেন। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকে এমন প্রতিষ্ঠানের গায়ে প্রস্রাবের নমুনা হালে দেখার সুযোগ মেলেনি। উল্লেখ করা জরুরি ষাটের দশকে যে সময়ে কেন ছবি করতে আসেন, তখন থেকে আজ পর্যন্ত কেনের প্রায় সমস্ত ছবিই পরস্পরবোধে একশরীরী। কেনের যাবতীয় প্রশ্নই আবর্তিত হয় মেহনতি মানুষের দিনগুজরানের গ্লানিকে কেন্দ্র করে। কেন কাঠগড়ায় দাঁড় করান সিস্টেমকে, ছাড় পাননা যিনি ছবিটি দেখতে গিয়েছেন তিনিও।
কেনের সাম্প্রতিকতম ছবিটি নিও রিয়েল ধাঁচায় তোলা। ফলে মজুরের জীবনের কয়েকটি দিনের ফিরিস্তিতে ক্যামেরা যে অতিরিক্ত গরিমা আরোপ করতে পারত, কেন তা স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করেন। কেন পরি্ত্যাগ করেন সংলাপের আধিক্য। যা এসে দাঁড়ায় তা একটি নিরাভরণ, ছিমছাম, প্রার্থনার মতো আড়ম্বরহীন। কেনের আগের ছবিটি দেখেও আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলাম। আই ড্যানিয়েল ব্লেক। হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর এক সহায়সম্বলহীন বৃদ্ধ কাজ খুঁজছে, তাঁর সাথে এসে জোটে এক সিঙ্গল মাদার, এই দুজনের নাছোড় লড়াই, খিদের গল্প বলে কেন কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন। এই ছবির অভিঘাত আবার অন্য।
কেন বলছেন নিউ ক্যাসেলের একটি পরিবারের কথা, যে পরিবারের বড়োরা লড়ছে ছোটোদের ঠাঁই শক্ত করার জন্যে, সমাজের সাধারণ নিয়মগুলিকে তারা মান্যতা দিয়েই বাঁচতে চাইছে। বাংলার মফস্সলে, কলোনিতে যেমন অজস্র রিফিউজি পরিবার দেখা যায় আরকি। রিকি ডেলিভারি পার্টনার হিসেবে কাজ শুরু করে। সংস্থার তরফে তাকে শুরুতেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তুমি আমাদের কেউ নও, তুমি আমাদের সঙ্গে কাজ করছো। এই কাজটি করার জন্যে রিকি প্রয়োজনীয় গাড়িটি কেনে স্ত্রীয়ের গাড়ি বিক্রি করে। পেশায় ‘আয়া’র এই ত্যাগকে কেন পুরুষতান্ত্রিক স্কোপে গ্লোরিফাই করেননি, নির্মোহ দৃষ্টিতে একটি সাধারণ ঘটনা হিসেবে দেখিয়েছেন এবং তার ফলশ্রুতিগুলিও দেখিয়েছেন, যেমন প্রতিদিন কাজে যাওয়ার সমস্যা, রাতবিরেতে হঠাৎ ডাক পড়লে যাওয়ার সমস্যা।
একজন ডেলিভারি পার্টনারের সঙ্কট আমরা এই লেখার শুরুতেই চিহ্নিত করেছি। এই সঙ্কটটিই ছবিতে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠে। রিকি দৌড়য়, জীবনমরণ দৌড়য়, এই দৌড় তাকে পরিবারছুট করে দেয়, অথচ সেই পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে যাবতীয় লড়াই। এই লড়াই গত কয়েকশো বছরে পৃথিবীকে পরস্পরের সম্মুখীন দুটি বিরাট শ্রেণিতে ভেঙে দিয়েছে। অপমান,শক্তিক্ষয়,কান্না, লজ্জাই জ্বালিয়েছে সভ্যতার পিলসুজ, বাজিয়েছে বিকাশের রণডঙ্কা। আমাদের প্রিয় ছবিতেও আমরা তাই দেখি অ্যাবিকে এক বাড়িতে গু মাখিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা দেখতে বাধ্য হই, বখে যাওয়া ছেলের সমস্যায় জর্জর এক পিতাকে(রিকি) মেরে তার নিজের পেচ্ছাপ মাখিয়ে দিচ্ছে তাঁর ছেলেরই বয়েসি কেউ। গাড়ি থেকে নামলে সময় নষ্ট তাই একটি ছোট বোতলে পেচ্ছাপ করে তা গাড়িতেই রেখে দিতে শিখিয়েছিল তাঁর এক সহকর্মী। সেই পেচ্ছাপের গন্ধে ভরে যাচ্ছে শরীর। কী লজ্জা! কী অপমান! অপমানিত আহত শরীরটা নিয়ে ফের উঠে দাঁড়ানো, শুশ্রুষার চেয়েও অনেক বড়ো হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
কাজের জায়গায় ক্ষতিপূরণের হুমকি, কাজ হারাবার ভয়। প্রিয়জনের এই গ্লানিতে ফেটে পড়ে অ্যাবি, প্রশ্ন তোলে, আবহমানের প্রশ্ন, আমার ক্ষতি অথচ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে আমাকেই! অপমানই ভেঙে যেতে বসা পরিবারটাকে আবার জুড়ে দেয়। এখানে ছবিটি শেষ হতে পারত, কিন্তু কেন মরণ কামড় দেন শেষ দৃশ্যপটে, যেখানে রিকি সবাইকে লুকিয়ে আহত শরীরটাকেই ঘষে ঘষে নিয়ে কাজে যেতে উদ্যত হন। ভালবাসার মহৎ শক্তি তাঁকে পরাস্ত করতে পারে না কারণ তিনি জানেন, তার রক্তে আর ঘামই রণ-রক্ত-সফলতার পৃথিবীর শেষ সত্য।
কেনের ছবিটির বৈশিষ্ট্য এই যে তিনি ক্যামেরার বুর্জোয়া চরিত্রকে নষ্ট করতে উদ্যত হয়েছেন। গল্পে অংশগ্রহণকারী কোনও মানুষের শ্রেণি থেকে উত্তরণের কোনও প্রয়াস নেই, রয়েছে দিনগুজরানের মরিয়া চেষ্টা, দিন আনা দিন খাওয়া। কেন পাখির চোখে নয়, এই নিচুতলাকে দেখেছেন হাঁটু মুড়ে নীচে বসেই। ছবিতে কোনও রাজনৈতিক পতাকা, কোনও দিনবদলের বার্তা নেই, নেই মিছিলের খোঁজ, এক দীন জীবনের অনুচ্চকিত মিছিল শুধু পর্দায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। আর এক গোঁ গোঁ রাগ, হাড়ের কালি যা দেওয়ালে গ্রাফিতি হয়ে ফোটে।
একই দেহে একজন অ্যাক্টিভিস্ট এবং একজন শিল্পী হয়ে ওঠা কঠিন, কেননা একই সঙ্গে রাজনীতি এবং তাকে সূক্ষতার সঙ্গে জানান দেওয়ার দক্ষতা অর্জন শ্রমসাধ্য, মুশকিলেরও। একজীবনে তা হয়ে ওঠা যায় না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। বাংলার শিল্পী চিত্তপ্রসাদ পেরেছিলেন কারণ তিনি জেলেপাড়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে দেখেছেন, বুঝেছেন, আবার শিল্পের তুকও রপ্ত করেছেন নিখুঁতভাবে। কেন লোচ পেরেছেন, প্রায় ষাট বছর সময় তিনি একই সঙ্গে দিয়েছেন তাঁর রাজনৈতিক ভাষ্য এবং শিল্পের ষড়ঙ্গকে শরীরে ধারণ করতে। এই ছবিটি করতে গিয়েও এই ডেলিভারি পার্টনারদের জীবনের সঙ্গে তিনি প্রথমে লীন হয়েছেন।
ছবিটি নিয়ে আরও অনেক কথা বলার, নানামাত্রায় ছবিটিকে দেখার। আপাতত এইখানে থামতে গিয়ে ভাবি এই সঙ্কট আমাদেরও রয়েছে। দিনের আলোর মতো রয়েছে, নিবন্ধের শুরুতে হাতেকলমে তা দেখিয়েছি।
এক সময়ে বাংলাছবি সমাজবাস্তবকে তুলে এনেছিল। ক্রমে তা মধ্যবিত্তের বিবেক, মিছিলের পথ ঘুরে ঢুকে গিয়েছে ভদ্রলোকের বেডরুমে। আমরা পারিনি। আমাদের ক্যামেরা-কলম ক্রমে চিন্তাহীন, মায়োপিক রোবটের খপ্পড়ে পড়ে গিয়েছে। আমার শিক্ষকপ্রতীম অ্গ্রজ অনিন্দ্য সেনগুপ্ত এবং আমি বেশ কয়েকটি সংলাপের পরে সিদ্ধান্তে এসেছি বাংলা সিনেমার বিশ্বকর্মারা ব্রেনডেথ, নগরগমনের উচ্চাশার পাকে পড়েছে। মানুষকে ওই চিন্তা রবীন্দ্রর গ্লানি স্পর্শ করে না। যে মানুষের কোনও প্রশ্ন নেই, গ্লানি নেই। অথচ খবরের কাগজে ছবি, বন্ধ হ্যাচারির বাইরে কাঁদছে ভ্যাবলা মানুষ, পরিবারের সামনে দাঁড়াবে কী করে সে! কী অপমান! কী লজ্জা! এই ব্যক্তিও কারও বাবা, এই অভিঘাত রিক্ত করে দেয় না একজন ছবি করিয়েকে? নিজেকে কী প্রবোধ দিয়ে ঘুমোতে যান তাঁরা?
খুব ভালো বিশ্লেষণ। অনেক ধন্যবাদ নিবন্ধটির জন্যে।
আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ
অবর্ণনীয় বিশ্লেষণ
ভালো হয়েছে লেখাটি। তবে ছেলে বখাটে নয়, বিদ্রোহী, এই সময়ের।
ছবিটি দেখিনি। আলোচনাতে সমৃদ্ধ হলুম
Thank you Subrata Da.