Home সংস্কৃতি সোভিয়েত-মুজাহিদিন দ্বন্দ্বের ছায়ায় আফগানিস্তানের প্রান্তরে বলিউডি স্বপ্ন

সোভিয়েত-মুজাহিদিন দ্বন্দ্বের ছায়ায় আফগানিস্তানের প্রান্তরে বলিউডি স্বপ্ন

সোভিয়েত-মুজাহিদিন দ্বন্দ্বের ছায়ায় আফগানিস্তানের প্রান্তরে বলিউডি স্বপ্ন
0
প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী

জওয়ানি জানেমন, হাসিনে দিলরুবা- নাচছেন পরভীন ববি।নেমক হালাল ছবির গানের দৃশ্য দিয়েই ছবি শুরু। শুধু শুরু নয়। গোটা ছবি জুড়ে জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দিবাস্বপ্নে বলিউডকে পুনর্নির্মাণ করেন কেন্দ্রীয় কিশোর চরিত্র কোয়াদ্রাতোল্লা। না কোনো ভারতীয় ছবি নয়।

তিন বছর আগে ‘উলফ অ্যান্ড শিপ’ দিয়ে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেই চমকে দিয়েছিলেন আফগান পরিচালক শারবানু সাদাত।কানের ডিরেক্টর্স ফোর্টনাইটে সেবার সেরার তকমা পেয়েছিলেন তিনি। প্রেমিক আনওয়ার হাশিমির অপ্রকাশিত ডায়রি থেকে সেই প্রথম ছবি। ওই ডায়রির উপাদান দিয়ে পাঁচটি ছবি বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে সাদাতের। দ্বিতীয়টি এবার দেখা গেল কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে। দ্য অরফ্যানেজ।

অনাথ কোয়াদ্রা সিনেমা হলে অমিতাভ বচ্চনের ছবি দেখে আর সেই ছবির টিকিট ব্ল্যাক করে। গোটা ছবি জুড়ে নানা ওঠাপড়ায় পনেরো বছরের কিশোরের মুখ অভিব্যক্তিহীন। কিন্তু মস্তিষ্কে ভিড় করে রয়েছে বলিউড। সেটা ১৯৮৯ সাল। আফগানিস্তানে সোভিয়েত প্রভাবের শেষ কাল, ক্রমেই ক্ষমতা বাড়াচ্ছে মুজাহিদিনরা। কিশোর কোয়াদ্রার তখন জানার কথা নয়, সিকি শতাব্দী পরে গ্যাংস অফ ওয়াসিপুরে রামাধীর সিং বলবেন, “যব তক হিন্দুস্তান পে সানেমা হ্যায়, তব তক লোগ চুতিয়া বনতে রহেঙ্গে”। তাই অনাথ আশ্রম(হস্টেল)-এ সহপাঠীর প্রেমে পড়ে সে ভাবতে থাকে, সে আর ওই মেয়েটি বলিউডি পোশাক পরে সিনেমার মতো গাইছে- জানে ক্যায়সে কব কাঁহা ইকরার হো গ্যায়া (পরিচালক গোটা গানটি রিমেক করেছেন)।আর বন্দুকের গুলি নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে প্রিয় বন্ধু হাসিবের মৃত্যুর পর কোয়াদ্রার মনে না এসে উপায় থাকে না- জয় আর ভীরুর মতো বাইকে চেপে আফগানিস্তানের হলুদ শস্যে ঢাকা প্রান্তরের মাঝ দিয়ে তারা গাইতে গাইতে চলেছে- ইয়ে দোস্তি, হাম নেহি তোড়েঙ্গে।

এ তো গেল গানের কথা। আর গল্প? অনাথ আশ্রমে এসে ব্ল্যাকার কিশোরের দুবেলা দুমুঠো খাবারের সমস্যা মেটে। মেলে নানা রকমের বন্ধু। হস্টেলে র‍্যাগিং থাকে নিশ্চয়, কিন্তু সেসব গল্প এগনোর অঙ্গ।সমাজের উচ্ছিষ্ট হয়ে পড়া একঝাঁক কিশোর-কিশোরী হস্টেলে বন্ধু পায়, বেঁচে থাকার রসদ পায়। মানবিক আধিকারিক ও শিক্ষকদের পায়।তাদের মধ্যে একদলকে নিয়ে যাওয়া হয় মসকোয়। সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি তাদের আকৃষ্ট করার হালকা চেষ্টাও থাকে। দর্শকরা দেখতে পান শায়িত লেনিনকে, ছোটোরাও। কিন্তু সে সবে তেমন যেন জোর নেই। শুধু ব্যবস্থাটাই রয়ে গেছে। ততদিনে নিশ্চয় সোভিয়েত শাসকদের মনেই কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়েছে।তাই কিছু রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা আর সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য তৈরি ব্যবস্থার কর্মীদের অভ্যাসগত মানবিকতাতেই মজে যায় কিশোর মনগুলো। তাদের কাছে সেটুকুই ছিল অনেক। তাই যখন মুজাহিদিনরা কাবুল দখল করে নেয়, তখন সোভিয়েত আধিকারিকরা পালানোর পথ দেখে, ছাত্ররা হয়ে পড়ে বর্মহীন। ছাত্রদরদি সুপারভাইজারকে মুজাহিদিনরা অকারণে গুলি করে মারলে অসহায় কোয়াদ্রা গেয়ে ওঠে মুকদ্দর কা সিকন্দরের গানটি। আর ভাবতে থাকে শাহেনশা সিনেমার অমিতাভের মতো সে একাই মুজাহিদিনদের দলটিকে পিটিয়ে ঠান্ডা করে দেবে। কোনো বামপন্থা বা কমিউনিজম নয়, তার চোখের আগুনে জ্বলতে থাকেন ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা এক ভারতীয় মেগাস্টার।

পরিচালক শারবানু সাদাত

শারবানুর এই অসাধারণ ছবিতে পরতে পরতে মিশে রয়েছে বলিউড। সাবেক আফগানিস্তানে যা ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় বিনোদন। এক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সময়কে ধরতে চেয়েছেন তিনি, সঙ্গী করেছেন আমাদের বিগ বি-কে। বেআইনি পথে বেঁচে থাকতে চাওয়া চালচুলোহীন এক কিশোরের মনোজগৎ ছবির শুরুতে বাস্তব থেকে পালানোর জন্য বলিউডকে বেছে নিয়েছিল। শেষে সেই রাষ্ট্রক্ষমতায় পালাবদল ঘটে যায়। স্কুলের শিক্ষক-আধিকারিকরা  চাকরি রাখতে নিজেদের পালটে নেন।পরিবারহীন প্রথম যৌবন এই পরিবর্তনকে মানতে পারে না। তাদের নিজেদের ঘর-জগৎ ভেঙে যাওয়ার মুখে এসে তারা রুখে দাঁড়াতে চায়। অথচ তাদের চোখে কোনো স্বপ্ন নেই, মতাদর্শের ওপর তৈরি হওয়া এক অবক্ষয়ী মহান রাষ্ট্র তাদের কোনো নতুন মূল্যবোধ দিতে পারেনি। শুধু দিয়েছে পেয়ে হারানোর ভয়। আর সেই হারানোর ভয় থেকে তারা শাহেনশার কাছে আশ্রয় খোঁজে। সভ্যতা হেরে যায়, জিতে যায় বলিউড। জিতে যান বচ্চন।   

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *