Home সংস্কৃতি ঘরে আর বাইরের দোটানা পেরিয়ে প্রবীণ অপর্ণার কাছে বেঁচে থাকার রসদ পেল বাঙালি

ঘরে আর বাইরের দোটানা পেরিয়ে প্রবীণ অপর্ণার কাছে বেঁচে থাকার রসদ পেল বাঙালি

ঘরে আর বাইরের দোটানা পেরিয়ে প্রবীণ অপর্ণার কাছে বেঁচে থাকার রসদ পেল বাঙালি
0
প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী

তখন তো স্কুলে পড়তাম। বাংলা ছবিতে সেই প্রথম ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চুমু দেখানো হয়েছিল বলে পড়েছিলাম কোনো এক জায়গায়। সৌমিত্র আর স্বাতীলেখা। স্বাতীলেখাকে তো চেনার কথা নয়, তিনি নাটকের মানুষ। সত্যজিতের ডাকে বিমলা হয়েছিলেন। উপায়ই বা কী!! বিমলা যে সুন্দরী নন, সে তো রবি ঠাকুর সেই কবেই বলে দিয়ে গেছেন। আর পড়েছিলাম অপর্ণা সেনের সাক্ষাৎকার। খোলামেলা জানিয়ে দিয়েছিলেন, ঘরে বাইরে উপন্যাসটি তাঁর ভালো লাগে না, সত্যজিতের ছবিটাও তাঁর ভালো লাগেনি। ছবিটা নিজের মতো করতে চান, এ কথাও জানিয়েছিলেন সম্ভবত। তারপর প্রথম সুযোগেই হাঁ করে টিভিতে দেখেছিলাম ছবিটা। সে সব বহু আগের কথা। পাঁচ বছর দেশ চালানোর পর মোদি জমানা বিপুল ভাবে ফিরে এল, তারপরই সেই ছবি নিজের ভাষ্যে জনগণের কাছে নিয়ে আসতে পারলেন বাঙালির বড়ো আপন অপর্ণা।

আরও পড়ুন: ভারতে রেটিং ভিক্ষা করা বাইকার এবং একটি অভারতীয় সিনেমা

উইকিপিডিয়ায় দেখছিলাম, অপর্ণার বয়স ৭৪ হয়ে গেল।কতকিছুই তো দেখে ফেলেছেন। তাই বোধহয় হিন্দুত্ববাদীদের জমানায় যে সতর্ক থাকতে হয়, সেটা ওর প্রবীণ বুদ্ধিতে কুলোয়নি। হিন্দুত্ববাদীদের মুসলিম হত্যার বিরোধী মিছিলে পরপর তিনটি গান গাইয়ে দিয়েছেন। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, ইন্টারন্যাশনাল এবং উই শ্যাল ওভারকাম। যদিও হিন্দিতে। গল্পটাও দিল্লিতে নিয়ে ফেলেছেন। সন্দীপের গভীর চুম্বনের প্রাথমিকতা পেরিয়ে বিমলাকে(এ ছবিতে বৃন্দা)গর্ভবতী করেছেন। ছবির দীর্ঘসময় জুড়ে সন্দীপ-বৃন্দার উত্তাল পরকীয়া দেখিয়েছেন। তখন একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছিল বটে, এখন মনে হচ্ছে ভারতবাসী ও বিজেপির রাজনীতির গভীর ভাব-ভালোবাসার প্রতীক হিসেবেই ওই আঙ্গিকটি ব্যবহার করেছেন পরমার পরিচালক।আর গণতন্ত্রপ্রেমী লিবারাল বুদ্ধিজীবীদের মহান বানিয়েছেন ও তাঁদের রাজনীতির দুর্বলতা দেখিয়েছেন। রবি ঠাকুরও বিমলাকে বিধবা করেছিলেন উপন্যাসের শেষে, অপর্ণাও করেছেন। তবু তাতে অনেক তফাত। নিখিলেশ না পাল্টালেও সন্দীপ আর বিমলা গত একশ বছরে কতটা বদলে গেছে, পরিচালক তা চোখে আভুল দিয়ে দেখিয়েছেন। একটু ভুল হল। নিখিলেশ নিজেকে পালটাতে চেয়েছে। আর তা দেখাতে এত বড়ো দেশের একটাই জায়গা খুঁজে পেয়েছেন আমাদের অপর্ণা সেন। বস্তার। সেখানে হাসপাতাল বানাতে গিয়ে সুধা ভরদ্বাজ, বিনায়ক সেনের সঙ্গে দেখাও করে নিখিলেশ(ছবিতে তাদের যাই নাম হোক)। ভুলে যাওয়ার আগে বলে রাখা দরকার, ছবিতে গৌরী লংকেশও রয়েছেন।

পালটে যাওয়া বিমলা(বৃন্দা) এ ছবিতে দলিত রমণী। যার ব্রাহ্মণ্যকরণ সম্পূর্ণ হতে হতেও আটকে দিয়েছেন পরিচালক। উপন্যাস-অন্তের বিপন্নতা পেরিয়ে এ ছবিতে সে নিজের অস্ত্র খুঁজে পায়।কেটে দেয় বিধির বিধান। সৌমিত্র ঠিক সময়ে পালাতে পেরেছিলেন, উচ্চাকাঙ্খী- অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী যিশু পালাতে পারেন না। ইতিহাসের গতিমুখ নিয়ে বিবৃতি দেওয়ার জন্য আমাদের এখনও প্রবীণ পরিচালকদের ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে, এ যে একরকম দুর্ভাগ্য- তা বুঝে মন খারাপ হয় বইকি! আর তা নিমেষে কেটে যায়, যখন শহরতলির হলে ছবির শেষে উপস্থিত বেশ কয়েকজন দর্শক হাততালি দিয়ে ওঠেন।

আর হ্যাঁ। শুধু বস্তার বা সুধা-বিনায়কে নয়, এ ছবিতে অন্যভাবেও মাওবাদীরা রয়েছেন। হিন্দুত্ববাদীরা নিজেদের করা হত্যার দায় অবলীলায় তাদের ওপর চাপিয়ে দেয় আর উদারপন্থী রাজনীতির দীনতা পেরোতে হিংসার আশ্রয়েই নিশ্চিন্ত হতে চান অপর্ণা।

ছবির অভিনয় ও নীল দত্তর সঙ্গীত চমৎকার। অসাধারণ অভিনয়ে সৌমিত্র আর ভিক্টরের কথা একবারও মনে আনতে দেননি যিশু ও অনির্বাণ। বৃন্দার ভূমিকায় তুহিনাও বেশ ভালো করেছেন। তবু ওই যে, আমাদের রবীন্দ্রনাথ আছেন, সত্যজিত আছেন। আর স্বাতীলেখার সূক্ষ্ণতাকে ভুলতে পারার পাপ কি আমরা করতে পারি! সে বৃন্দা যতই কনভেন্ট-শিক্ষিত হন। বিমলাও তো গাইতে জানতেন, ”সিং মি দ্য সংস আই ডিলাইটেড টু হিয়ার, লং লং এগো…’   

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *