শিশু ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ আড়াল করতে পুলিশি তৎপরতার জেরেই গ্রেফতার টিপু সুলতান?
বসন্ত বাউরি
টিপু সুলতান নামের ছেলেটিকে শান্তিনিকেতনের বাড়ি থেকে প্রথমে অপহরণ ও পরে গ্রেফতার করা হয়েছে, UAPA মামলায় জুড়ে দেওয়া হয়েছে, ২০১৬ সালের বেলপাহাড়ির একটি কেসে। অর্থাৎ পুরানো কেসে ট্যাগ করা হয়েছে, সেই সময় টিপু সুলতান বিশ্বভারতীর তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। শোনা যাচ্ছে সেই কেসে যাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল সেই সময় (রাজারাম টুডু), তিনি আঠারো মাস জেল খেটে এখন মাওবাদী পুনর্বাসন প্রকল্পে হোমগার্ডের চাকরি করছেন। অর্থাৎ এই কেসে আগের অভিযুক্ত জামিন পেয়েছেন – টিপু সুলতানের কেসটি একটি খুব জোরালো নাও হতে পারে (মেরিট নেই), কিন্তু ছাব্বিশ বছরের ছেলেটিকে বেশ কিছুদিন জেলে থাকতে হবে, যেহেতু মামলাটি UAPA। মুখ্যমন্ত্রী ও পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুদিন আগে স্ট্যান স্বামীর জেল হেফাজতে হত্যার প্রতিবাদে অন্যান্য প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীদের সাথে যৌথ উদ্যোগে রাষ্ট্রপতিকে একটা চিঠি লিখেছিলেন, তাতে UAPA -র মতো দমনমূলক আইনের প্রয়োগ নিয়ে কিছু বিরোধাভাসের ইঙ্গিত ছিল। দ্বিচারিতা শাসকদের অত্যাবশ্যকীয় বিষয়, ডাহা মিথ্যাচার তাদের শস্ত্র ও বর্ম, অসভ্যের মত ক্ষমতার ব্যবহার শাসকের সহজাত, গিরগিটির মত রং বদলানোর গুণটি শাসকরা বহুদিন আগেই আয়ত্ব করেছে বিবর্তনবাদকে সমৃদ্ধ করে। স্মরণে রাখা দরকার, ২০১০ সালে জঙ্গলমহলের কোনো এক সভায় তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাষ্ট্রীয় ঘাতকদের দ্বারা নিহত শহিদ মাওবাদী পলিটব্যুরো সদস্য আজাদকে ‘কমরেড’বলে স্মরণ করেছিলেন, ক্ষমতায় আসার ছয় মাসের মধ্যে আরেক মাওবাদী পলিটব্যুরো সদস্য কিষানজিকে হত্যা করে শ্রেণি পরিচয়ের সাক্ষ্য রেখেছিলেন। টিপু সুলতান কোন ছাড়!
তবুও প্রশ্ন জাগে, সদ্য ভোটে জিতে আসা এই রমরমা বাজারে টিপুকে গ্রেফতার করার কারণ কী? শান্তিনিকেতনের চত্ত্বরে গণআন্দোলনের পরিচিত মুখ টিপু সুলতানকে স্থানীয়ভাবে নানান কর্মকাণ্ডে দেখা যেত। কয়েক বছর আগে শ্যামবাটিতে গাছ কাটা বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীরা প্রশাসনের সাথে ধস্তাধস্তি করে, সেই সময় টিপু ও অন্যান্যদের নামে কেস হয়। ২০১৮ সালে নভেম্বর মাসে ঝাড়গ্রাম ব্লক থেকে টিপু গ্রেফতার হয়, মাওবাদী অভিযোগে, সেবার তিনমাসে জামিন পেয়েছিল। এইবারের গ্রেফতারের পিছনে কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করলে খানিক আন্দাজ করা যাবে যে এই বারের ঘটনাবলি অন্য ধারার ছিল।
স্থানীয় একটি খবরের কাগজের ২৬ সেপ্টেম্বরের রিপোর্ট বলছে, “শান্তিনিকেতনের পারুলডাঙায় ২ দিন নিখোঁজ থাকার পর পুকুর থেকে উদ্ধার হল তিনবছরের শিশুকন্যার দেহ। নাম পল্লবী মুর্মু। গত ২৩ সেপ্টেম্বর সকাল দশটা থেকে নিখোঁজ ছিল সে। শান্তিনিকেতন থানায় সেইমতো নিখোঁজের অভিযোগ দায়ের করে পরিবার। এর পর গতকাল সন্ধ্যায় খবর পাওয়া যায় গ্রামের বাইরে পুকুরে একটি মৃতদেহ ভাসছে। পরিবারের লোকজন গিয়ে দেখেন, তাঁদের বাড়ির মেয়েটির দেহ ভাসছে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় শান্তিনিকেতন থানার পুলিশ।
দীর্ঘক্ষণ ধরে মৃতদেহ জলেই পড়েছিল। পরিবার ও পাড়া-প্রতিবেশীর দাবি ছিল, পুলিশ কুকুর আনার। সেইমতো রাত দশটায় বোলপুরে পারুলডাঙা গ্রামে নিয়ে আসা হয় পুলিশ কুকুর। সঙ্গে বিশাল পুলিশবাহিনী। পরিবারের দাবি, এই ঘটনার সঙ্গে যে বা যারা জড়িত রয়েছে তাদের কঠোরতম শাস্তি দিতে হবে। পুলিশ তদন্ত করে দেখুক কারা দোষী”।
http://bengali.dbpnews.com/mystery-surrounding-the-rescue-of-the-bodies-of-a-3-year-old-girl-and-an-adult-at-separate-places-in-birbhum/
https://fb.watch/8Hm5MGLn1d/
পুলিশ মৌখিক আশ্বাস দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করেনি। দু’সপ্তাহের বেশি সময় ধরে নিষ্ক্রিয় পুলিশ পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট দেয়নি, রহস্যজনক মৃত্যু ঘিরে যে প্রশ্নগুলি উঠেছিল তার তদন্ত করেনি এবং গরিমসি করে গুরুতর অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
এই বিষয়টি নিয়ে বিশ্বভারতীর কিছু ছাত্রছাত্রী নড়াচড়া শুরু করে, পারুলডাঙ্গা যায় ও পুলিশকে চাপ দেওয়ার উদ্যোগ নেয়।
৮ অক্টোবর আর সংবাদ্মাধ্যমের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে মৃত শিশুটির পরিবার শান্তিনিকেতন থানার সামনে ধরনায় বসেছেন।
https://fb.watch/8HlXv3EmVZ/, https://www.anandabazar.com/west-bengal/purulia-birbhum-bankura/agitation-in-front-of-shantiniketan-ps-by-tribal-people-for-police-probe-of-child-death-of-paruldanga/cid/1306855
এবারেও পুলিশসুলভ মিথ্যাচার ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে আদিবাসী পরিবারটিকে ফিরত পাঠানো হয়। ক্ষমতাহীন আদিবাসী পরিবারটির ন্যায়বিচারের আবেদন শোনার দায় কোনো তৃণমূল নেতার ছিল না। বরং ক্ষমতাসীন সরকার ও তার পোষ্য পুলিশ বাহিনীর লোমশ শরীরে নোংরা ছিটে লাগাতে পারে এই আশঙ্কায় বিষয়টি কবরে পাঠানোই উদ্দেশ্য ছিল।
Students Unity for New Society-র পক্ষ থেকে বিশ্বভারতীর দেওয়ালে এই শিশুর রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে পোস্টারিং করা হয়। সাথে নকশালবাড়ির রাজনীতির সমর্থনেও কিছু লেখা ছিল। Students Unity for New Society-র সহমর্মী ছিল টিপু। এই পোস্টারিং-এর প্রতিক্রিয়ায় স্থানীয় কিছু মিডিয়া হই হই করে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়ানো শুরু করে, ক্যাম্পাসে নাকি মাওবাদী পোস্টার পাওয়া গেছে। (https://fb.watch/8yqZ4mUK5m/), আনন্দবাজারেও এই ‘চাঞ্চল্যকর’ খবরের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। আমাদের দেশের নিউজ মিডিয়াগুলি শিশু হত্যা ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে খবরে তত আগ্রহী নয়, যতটা উৎসাহী শিশু হত্যা প্রতিবাদের পোস্টারকে নিয়ে বাজার গরম করতে।
১০ অক্টোবর এই পোস্টারিং ও তাকে কেন্দ্র করে শান্তিনিকেতনে ‘চাঞ্চল্য’ সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে অন্য একটি বিষয় মানুষের সামনে উঠে আসছিল, সেটা হচ্ছে পারুলডাঙ্গার মর্মান্তিক ঘটনা ও পুলিশ প্রশাসনের অকর্মন্যতা। অকর্মন্যতা শুধু নয়, অপরাধ লুকিয়ে ফেলার প্রচেষ্টা, যা আমরা যোগীর উত্তরপ্রদেশে হাথরাসের সময় দেখেছি, হরদম দেখছি। পুলিশ প্রশাসনের দুষ্কর্ম উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে, কালিমালিপ্ত হতে পারে দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী ক্যান্ডিডেটের রাজ্যপাট – তাই ঘনিয়ে ওঠার আগেই তড়িঘড়ি গ্রেফতার করে সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করাটা জরুরি ছিল।
এইখানে বীরভূমের তৃণমূলের সভাধিপতি অনুব্রত মন্ডলের ভূমিকা খানিক উল্লেখ করা দরকার। ভিডিও মিমে অনুব্রত খুবই জনপ্রিয়, তার নানারকম হাস্যকর উপমার ব্যবহারের কারণে – আদতে উনি একটি ক্ষমতাশালী স্বৈরতন্ত্রী, পুলিশের সাথে মিলে রাজনীতি করার কারণে মাফিয়া সুলভ দাপট দেখাতে পারেন। কান পাতলেই তার বিপুল সম্পত্তির কথা শোনা যায়। অনুব্রত মাইনাস পুলিশ হলে তার অক্সিজেন মাত্রা কমে যাবে সন্দেহ নেই। তার স্টাইল অফ ফাংশনিং হল বিরোধিতা দেখলেই পুলিশকে দিয়ে কেস খাওয়ানো, একটি ভিডিওতে ফাঁস হয়েছিল যেখানে অনুব্রত বিরোধীদের কেন গাঁজা কেস দেওয়া হচ্ছে না তাই নিয়ে সন্তাপ করছেন। আমাদের সোস্যাল মিডিয়ায় এই রকম সমস্ত ‘নেতা’রা মিম মেটিরিয়াল বটে, তাতে যে জিনিসটা হয় সেটি হল এদের ভয়াবহতা লঘু হয়ে যায়। অবশ্য সোস্যাল মিডিয়ার সবকিছুই নির্বিষ, Students Unity for New Society যদি তাদের পোস্টারগুলি ফেসবুকে প্রচার করত – লাইক, লাভ আর অ্যাংরি ইমোজিতে ভারী আত্মপ্রসাদের ঢেঁকুর তুলতে পারতো। বাইরের রাজনীতির জগতটা কড়া কর্কশ। বীরভূমে যেকোনো বিষয়ে আন্দোলন করতে যান যা অনুব্রতর স্বার্থে সামান্য আঁচড় লাগাবে, খেলা কাকে বলে বুঝতে পারবেন। বীরভূম শুধু নয়, সর্বত্রই এই বিষয়, শয়ে শয়ে অনুব্রত তৈরি আছে।
টিপু সুলতানকে প্রশাসন গাঁজা কেস দেয়নি, UAPA দিয়েছে। এবং প্রমাণ করে দিয়েছে বিপ্লবী মতাদর্শে্র ক্ষেত্রে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ ও একনায়িকাতন্ত্রের মধ্যে ফারাক খুব সূক্ষ্ম, যখন তখন একে অন্যের রূপ ধারণ করতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-বিরোধী প্রগতিশীল অংশের সক্রিয় সহযোগিতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রহণ করেছেন, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদকে রুখতে একনায়িকার সমর্থনে অলিখিত বোঝাপড়া হয়েছে – কোথাও কি নাগরিক সমাজের প্রেসার গ্রুপের কান্ডারিরা উভমুখী মত বিনিময়ে ব্যর্থ? একনায়িকাকে নির্বাচনী বৈতরণী পার করে দেওয়াই কি গণতান্ত্রিক সুশীলদের কাজ? একনায়িকাকে সামনে রেখে ফ্যাসিবাদবিরোধী হতে চাওয়া প্রগতিবাদীদের পায়ের তলার জমি ক্রমাগত ক্ষয়ে যাচ্ছে, ভোঁতা হচ্ছে রাজনৈতিক স্বর। কিভাবে টিপু ও অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির বিষয়ে একনায়িকাকে চাপ দেওয়া যায় সে বিষয়ে আরও খানিক আন্তরিক উদ্যোগের আশা রাখছি, যেমনটা দেখেছিলাম নির্বাচনের আগে বিজেপিকে পরাস্ত করার ক্ষেত্রে।