‘প্রিমিটিভ মাইন্ডস, আই কান্ট ডিল উইথ ইউ’। ভাবলেশহীন মুখে সাদামাটা বউ ওজাকে মন্তব্য ছুঁড়ে বিস্তীর্ণ সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যায় আয়ান মানি। ছুটে গিয়ে বাবার পাশে হাঁটতে থাকে ১০ বছরের ছোট্ট আদি। অন্যায় আর অসাম্যের পাঁচিলে ঘেরা স্থলভাগের কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার নতুন কোনো উপায় কি তামিল শূদ্র আয়ানকে বলে দেবে সাগর? জানা নেই। কারণ তাদের পথচলার মাঝেই শেষ হয়ে যায় ‘সিরিয়াস মেন’।
বছর দু-তিন আগে রঙিন অবতারে মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৩ সালের কাল্ট ছবি ‘জানে ভি দো ইয়ারোঁ’। রং লেপে দিলে কী হবে! সে ছবির দুই প্রোটাগনিস্ট তো সেই সময়ের দুই ভারতীয় যুবক। যারা সরল মনে মানুষের ভালো করতে চায়। সেই ছবির কাহিনি লিখেই বলিউডে প্রবেশ সুধীর মিশ্রের। তারপরের চার দশকে ম্যায় জিন্দা হুঁ, ইস রাত কে সুবহ নেহি, ধারাভি, হাজারোঁ খোয়াইশে অ্যাইসি, অর্জুন পন্ডিত, ইনকার জুড়ে সুধীরের স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, সংশয়ের সঙ্গী থেকেছি আমরা। বলিউডের দর্শকরা। একমত হয়েছি কখনও, অনেক সময়ই হইনি। কিন্তু সুধীরের সময়ের বুক চিরে ভারতবর্ষকে খোঁজার চেষ্টাকে সম্মান জানাতে কোনো অসুবিধা হয়নি। ২০২০-র ভারতবর্ষের কমন ম্যানকে খুঁজতে গিয়ে তিনি ছুঁয়ে ফেললেন তাদের মধ্যে আগ্নেয়গিরির মতো জমে ওঠা ক্ষোভকে। বহুতল ঘেরা বস্তির মধ্যে আটকে পড়া শহুরে নিম্নবিত্ত দলিত জীবনকে। তার রাগ, লোভ, প্রতিশোধ স্পৃহা এবং অসহায়তাকে। শর্টকাট পথে নায়ক হতে গিয়ে সে জোকার বনে যায়। কিন্তু ভেঙে না পড়ে সে রাগ পুষে রাখে।
আহা কী অভিয়নটাই না করেছেন নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। তাঁর যে ম্যানারিজমের ভক্ত দর্শকরা, সে সব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে আধুনিক অভিনয়ের এক উদ্যাপন যেন সিরিয়াস মেনের প্রতিটি ফ্রেমে। চালাকি, টেনশন, ঘৃণা, ক্রোধ, সম্পূর্ণ কোণঠাসা হয়ে পড়েও আপাতত সম্মানজনক প্রস্থানের পথ খোঁজার স্পিরিটে তিনি মাতিয়ে দিয়েছেন। ইন্দিরা তিওয়ারি, ছোট্ট আকাশনাথ, শ্বেতা বসু প্রসাদ, নাসর- চমৎকার অভিনয় করেছেন সকলেই। কিন্তু নওয়াজের অভিনয় ছাড়া এই চিত্রনাট্য যেন বাস্তব হত না কিছুতেই।
নেটফ্লিক্সে রিলিজ হওয়া এই ছবির গল্পের রূপরেখা দু’কথাতেই সেরে নেওয়া যায়। এক বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সর্বেসর্বার পিএ আয়ান মানি। দলিত হওয়ায় জীবনের সব ক্ষেত্রে অপনামিত হতে হতে সে বেপরোয়া হয়ে যায়। নিজের ছেলেকে ‘বিস্ময় বালক’ হিসেবে সমাজে পরিচিত করানোর চেষ্টায় সে অনৈতিক পথ ধরে। কাহিনির সঙ্গে জুড়ে যায় রাজনীতি, আমলাতন্ত্র ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি। কিন্তু শ্রেণি-বর্ণবাহিত ক্ষমতার হাত ধরে সকলেই খাদের কিনার থেকে স্থিতাবস্থায় ফিরে আসে। ফিরতে পারে না শুধু দলিত পরিবারটি।
সুধীর মিশ্রর এই অসামান্য স্যাটায়ারের মজার দৃশ্যগুলোতেও দর্শকরা হাসতে পারেন না। তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন পরিণতির কথা ভেবে। অবস্থান নিতে গিয়ে বারবার সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। ছবি এগিয়ে চলে নিষ্ঠুর অনিবার্যতার দিকে। শেষ দৃশ্যে নওয়াজের কঠিন, ভারলেশহীন মুখ আবার আমাদের টেনশনে ফেলে দেয়। না জানি কী ভাবছে এই দ্বিতীয় প্রজন্মের দলিত। টুজি থেকে ফোরজি হয়ে ওঠার জন্য নতুন কোন অন্তর্ঘাতের পরিকল্পনা আঁটছে সে?