সাম্প্রতিক সময়ে ইতিহাসের পাঠ ও সিলেবাস বিতর্ক এক নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে সরকার ও সংঘ পরিবারের মতাদর্শের সমর্থকরা এক প্রচার জোরদার করেছেন যার মূল বিষয় ‘প্রকৃত ভারতীয় ইতিহাস রচনা’। এক্ষেত্রে দুটো বিষয় লক্ষ্য করা যায়—প্রথমটি হল সংঘ পরিবারের মতাদর্শের অনুকূল নয় এমন ইতিহাসের পাঠগুলিকে সিলেবাস থেকে হয় সংশোধন নতুবা পুরোপুরি বর্জন। দ্বিতীয় বিষয়টি হল অনৈতিহাসিক,প্রমাণহীন বিভিন্ন কষ্ট কল্পনাকে ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত করা। এবারের বিষয় হল এনসিইআরটি ( National Council of educational research and training) কর্তৃক একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির সমাজবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সিলেবাসের সংশোধন, বিশেষ করে মোগল ইতিহাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশের বিয়োজন।
এখন এই সংশোধন যারা করেছে সেই এনসিইআরটি কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হল কোনভাবেই মোগলদের ইতিহাসকে বাদ দেওয়া হয়নি। কোভিড অতিমারির প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের উপর সিলেবাসের চাপ কমানোর লক্ষ্যে সিলেবাসকে যৌক্তিক (rationalized) করা হয়েছে এবং অপ্রয়োজনীয় ( irrelevant) অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে বিশেষজ্ঞদের আলোচনার মাধ্যমে। এও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে নয়া শিক্ষানীতির( ২০২০) লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের চাপ মুক্ত করা। তাই এনসিইআরটির মতে এই সিলেবাস বিতর্ক অর্থহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে কয়েকটা জরুরি বিষয় বলে নেওয়া জরুরি। প্রথমত বিতর্কটা শুধুমাত্র মোগল ইতিহাস বাদ দেওয়ার প্রশ্নে কেন্দ্রীভূত নয়। আর সম্পূর্ণ মোগলদের ইতিহাস বাদ দেওয়া হয়নি। দ্বাদশ শ্রেণির মোগল সম্পর্কিত দুটো পাঠ এককের মধ্যে একটিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ হল বহুত্ববাদী দর্শন,বিশ্ববীক্ষা, প্রগতিশীল সমাজভাবনার বহু উপাদান বাদ দেওয়া হয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গান্ধির সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী লড়াই, গান্ধি হত্যার ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর দায়, ভারতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন গণআন্দোলন, গুজরাত গণহত্যা, জাতপাতের বিষয়, ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব ইত্যাদি।
দ্বিতীয়ত এই নিবন্ধকারের মতে সিলেবাস কোনো অচল,অনড় শালগ্রাম শিলা নয়, সময়ের সঙ্গে এবং নতুন তথ্য ও বিশ্লেষণের আলোকে তার সংযোজন, বিয়োজন তথা আধুনিকীকরণ জরুরি। কিন্তু এক্ষেত্রে এনসিইআরটি যে যুক্তিমালা হাজির করেছে তা নেহাৎই ছেঁদো কথা। কারণ কোভিড অতিমারি আগেই শেষ হয়েছে, সমস্ত বোর্ডই তাদের পুরনো সিলেবাসে ফিরে গেছে। নয়া শিক্ষানীতিকে কার্যকর করার জন্য দিল্লির শাসকরা ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক (NCF) তৈরি করার কাজ প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে। প্রচলিত পাঠক্রমের মেয়াদ আর বেশি দিন নয়। এই অবস্থায় নতুন শিক্ষানীতির দোহাই দিয়ে সিলেবাস সংশোধন বা পরিমার্জন করা শিক্ষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অর্থহীন।
তৃতীয়ত শিক্ষার্থীদের উপর চাপ কমানোর বিষয়টিও ধোপে টেকে না। কারণ আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষা পাশের পর বিষয় বিভাজন হয়ে যায়। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যারা এই ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ছেন তারা উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে সমাজ বিজ্ঞান পড়বেন বলেই এই বিষয়গুলো বেছে নিয়েছেন, তাই চাপের প্রশ্ন ওঠে না।
চতুর্থত এনসিইআরটির তৈরি করা বই সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বইগুলো শুধু সিবিএসই (Central Board of secondary education) ছাত্র- ছাত্রীরা পড়েন,এমনটা নয়। বহু রাজ্য বোর্ড এই বই ও সিলেবাস ব্যবহার করে। যেমন এবার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই উত্তরপ্রদেশ সরকার ঘোষণা করে দিয়েছে তাদের বোর্ডের সিলেবাস এটাই হবে। তাই এনসিইআরটির তৈরি করা সিলেবাসের প্রভাব অবশ্যই সর্বভারতীয় স্তরে পড়বে।
পঞ্চমত সিলেবাসের এই পরিবর্তন শুধু একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির মধ্যেই সীমায়িত নয়। বেশ কিছু দিন আগে থেকেই বিভিন্ন নিচু ক্লাসের ( পঞ্চম – দশম শ্রেণি) সিলেবাসে সংশোধন হচ্ছে ও ভালোভাবে লক্ষ্য করলে তাতে একটা সুনির্দিষ্ট প্যাটার্ন দেখা যাবে। আরেকটা চালাকি হল শুধু অধ্যায় বাদ হচ্ছে না, অধ্যায়কে অক্ষত রেখে শব্দ ও বাক্য সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে পাঠ এককগুলোকে যথেচ্ছ ভাবে কাটছাঁট করা হচ্ছে।
আমাদের প্রথমে দেখে নেওয়া উচিত এই যৌক্তিককরণ (rationalization) প্রক্রিয়ায় কী কী বাদ গেল —
★ দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে ‘ Themes of indian history : part– two, title: kings and chronicles ; the Mughal Courts( 16 th and 17 th century) পুরো বাদ গেছে।
★ দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে গুজরাট দাঙ্গা ও সেই সংক্রান্ত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনের অংশ, হিন্দু মুসলিম ঐক্যের প্রশ্নে গান্ধিজির ভূমিকা, গান্ধি হত্যার ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর ভূমিকা ইত্যাদি। গান্ধি হত্যার ক্ষেত্রে যে লাইনগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে তার কিয়দাংশের উল্লেখ আমাদের বিষয়টা বুঝতে সাহায্য করবে– ” Gandhiji’s actions were not liked by all. Extremists in both the communities blamed him for their condition….. RSS was banned for sometimes”.
★ দ্বাদশ শ্রেণির সমাজবিজ্ঞানের সিভিকস অংশ থেকে বাদ গেছে বিভিন্ন গণআন্দোলন, একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সংসদীয় রাজনীতিতে আধিপত্য পর্ব, ঠান্ডা যুদ্ধ, একমেরু বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ইত্যাদি।
★ একাদশ শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে বাদ গেছে মধ্য এশিয়ায় গড়ে ওঠা ইসলামিক সাম্রাজ্যের কথা, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব, শিল্প বিপ্লব প্রভৃতি।
★ দশম শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে বাদ গেছে সেই অংশগুলো যা বহুত্ববাদী রাজনীতি, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের পাঠ দেয়। যে সমস্ত অধ্যায়গুলো বাদ দেওয়া হয়েছে তার শিরোনাম গুলি হল– ‘ democracy and diversity’,’ popular struggles and movements’, ‘ challenges of democracy ‘ ইত্যাদি।
★ উল্লেখ করার মত বিষয় হল পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির সিলেবাসে পরিকল্পিত ভাবে ভারতীয় সমাজের অন্যতম অভিশাপ বর্ণব্যবস্থা, জাতপাত,ব্রাহ্মণ্যবাদী শোষণ সংক্রান্ত বিভিন্ন উল্লেখ যা এতদিন এনসিইআরটি-র বইতে ছিল, তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। হাতে করে যারা ময়লা নিয়ে যায় তাদের সম্বন্ধে ( সমাজ কর্মী হর্ষ মান্দারের সে প্রসঙ্গে কাজ) প্রতিবেদন বাদ পড়েছে। একটি প্রবন্ধকে বাদ দেওয়া হয়েছে যার প্রতিপাদ্য ছিল স্বাধীনতার এত বছর পরেও উচ্চবর্ণের মহিলাদের চেয়ে নিম্নবর্ণের মহিলারা বেশি শোষনের শিকার। ষষ্ঠ শ্রেণির সমাজ বিজ্ঞানের বইতে লেখা ছিল প্রাচীন কালে শুদ্র ও মহিলাদের বেদ পাঠের অধিকার ছিল না। এই বিষয়টাকে এবার বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
★ পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস পাঠে মুসলিম শাসকদের নাম বাদ দেওয়ার কাজ দুবছর আগেই শুরু হয়েছিল। সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস বই-এর তৃতীয় অধ্যায় থেকে সুলতানি শাসক ও চতুর্থ অধ্যায় থেকে মোগল শাসকদের নাম বাদ গেছে। এছাড়া বাদ গেছে দশম শ্রেণির বই থেকে বিভিন্ন পরিবেশ আন্দোলনের কথা।
তথ্যের খাতিরে শুধু এটা উল্লেখ করা দরকার যে আজ যা এনসিইআরটি করছে, বিজেপি শাসিত বহু রাজ্যে বিচ্ছিন্ন ভাবে তা আগেই শুরু হয়েছে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ২০১৭ সালে মহারাষ্ট্র স্টেট এডুকেশন বোর্ড সপ্তম ও নবম শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে মুসলিম শাসকদের নাম বাদ দিয়েছিল। এই সিলেবাস পরিবর্তনের বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করেছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ অনুপ্রাণিত হিন্দুত্ববাদী থিঙ্ক ট্যাঙ্ক রামভাউ মালগি প্রবোধিনী। বসুন্ধরা রাজে যখন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন সেখানে হিন্দু গৌরব গাথা বলে একটা অধ্যায়, বিমুদ্রাকরণের উপকারিতা নিয়ে পাঠ একক সিলেবাসে যুক্ত হয়। কর্নাটকের ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে ঔপনিবেশিক শক্তি বিরোধী লড়াইয়ের অন্যতম আইকন টিপু সুলতানকে এক হিন্দু বিরোধী খুনি হিসাবে দেখানোর চেষ্টা চলছে। এই বিষয়গুলো উল্লেখের কারণ ইতিহাসের প্রচলিত পাঠের পরিবর্তন, সংশোধন বা বিয়োজন বিজেপির রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার অংশ এবং তারা এ ব্যাপারে ধারাবাহিক।
এই বিয়োজনের গল্পে এনসিইআরটির সবচেয়ে ধূর্ত চাল হল গান্ধি প্রশ্নটি। নিয়ামক সংস্থা হিসাবে বইতে কী কী বিষয় বাদ গেছে তা এনসিইআরটি আলাদা আলাদা করে তাদের ওয়েবসাইটে আপলোড করেছে। কিন্তু গান্ধি হত্যা, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর দায় এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি বাদ দেওয়া ( মোট বাদ গেছে ১৩৬ টি শব্দ ও ১০ লাইন) হলেও তা ওয়েব সাইটে উল্লেখ পর্যন্ত করা হয়নি। এই নিয়ে পরে বিতর্ক হলে তারা বলে এটা যেহেতু সামান্য বিয়োজন তাই তারা উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করেনি।
এখন প্রশ্ন হল সিলেবাস থেকে এই অধ্যায়গুলো বর্জিত হলে শিক্ষার্থীদের কী ধরনের ক্ষতি হবে?
দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস বইতে মুঘলদের নিয়ে দুটো অধ্যায় ছিল যার সময়কাল ষোড়শ ও সপ্তদশ শতক। সাধারণ ভাবে বলা যেতে পারে বাবর থেকে আওরঙ্গজেবের সময়কাল পর্যন্ত। যে অধ্যায়টা রয়ে গেল তার মধ্যে রয়েছে এই সময়কালের অর্থনৈতিক ইতিহাস, কৃষি সম্পর্ক, গ্রামীণ সমাজে নারী,গ্রামের গঠন,প্রযুক্তি, বনবাসী মানুষ ও আকর গ্রন্থ হিসাবে আইন-ই- আকবরির উপযোগিতা। যেটা বাদ গেল তার মধ্যে ছিল মুঘল রাষ্ট্র কাঠামো,রাজতন্ত্রের ধারণা,প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা, ধর্মীয় প্রশ্নগুলো। এখানে আকরগ্রন্থ হিসাবে ছিল আবুল ফজলের আকবরনামা,আবদুল হামিদ লাহোরির পাদশাহনামা। এই দুটো অধ্যায় পরস্পরের পরিপূরক তাই একটা অধ্যায় বাদ দিলে শিক্ষার্থীদের মুঘল ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে খণ্ডিত ধারণা হবে যা তাদের ইতিহাস বোধকে সম্পূর্ণ করবে না।
একই ভাবে সমস্যা হবে একাদশ শ্রেণির ওয়ার্ল্ড অব হিস্ট্রির অন্তর্গত ‘ The Central Islamic Lands’ অধ্যায়ের বিয়োগে।ইতিহাসের ছাত্রের কাছে সাম্রাজ্যের গঠন ও বিভিন্ন সাম্রাজ্যের তুলনামূলক বিচার অবশ্য পাঠ্য।এই বিয়োগের ফলে সুলতানিয়ৎ-এর উদ্ভব,ধর্মযুদ্ধ, পশ্চিম এশিয়া,ইরান,মধ্য এশিয়া,উত্তর আফ্রিকা থেকে স্পেনে কিভাবে ইসলামিক সভ্যতার বিকাশ হল,তাদের অর্থনৈতিক ও বৌদ্ধিক বিকাশ,সাংস্কৃতিক বিকাশ সম্পর্কে ধারণা তৈরি হওয়া কঠিন হবে।
সমাজ বিজ্ঞানের কোন শিক্ষার্থী যদি দেশের মুক্তিযুদ্ধের নির্ণায়ক পর্বের ঘটনাগুলি যেমন দেশভাগ, দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িকতা,গান্ধিহত্যা সম্পর্কে না জানে,যদি আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সম্পর্কের ইতিহাসে শিল্পবিপ্লব, ঠান্ডা যুদ্ধ, মার্কিন আধিপত্যবাদ সম্পর্কে তার বোধ না থাকে,যদি বহুত্ববাদী রাজনীতি ও গণতন্ত্রের পাঠ তার সিলেবাসের বাইরে হয়, তবে সিলেবাসের বোঝা কমানোর নামে আমরা তাদের জন্য কালানুক্রমিকতা রহিত, খণ্ডিত,অনৈতিহাসিক পাঠক্রম তৈরি করব,যা শিক্ষার্থীদের উচ্চতর পাঠকে যেমন বিঘ্নিত করবে তেমনি তৈরি হবে অসম্পূর্ণ সমাজ ভাবনা।
মোগল ইতিহাসের অংশ বর্জন বা গান্ধিহত্যার বিষয়টিকে শুধুমাত্র সিলেবাস বদল বা শিক্ষাঙ্গনের সমস্যা ভাবলে আমরা ভয়ংকর ভুল করব। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের অধিনায়কত্বে ‘ হিন্দুত্ববাদী ইতিহাস রচনা’ একটি দীর্ঘকালীন ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যা বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারে বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ায় আরও গতি পেয়েছে। এই ইতিহাস ভাবনা তাদের রাজনৈতিক চিন্তা ‘ হিন্দি- হিন্দু – হিন্দুস্তান ‘ মডেলের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এই ইতিহাস ভাবনার মূল কথা হল ভারতবাসীর জন্য একমাত্রিক ইতিহাস রচনা যা দেশের শত্রু- মিত্র, জয়- পরাজয়, আশীর্বাদ -অভিশাপের একটি মাত্র ভাষ্য তৈরি করবে। সেই ভাষ্য হবে সনাতন হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির গৌরব গাথা। কিন্তু ভারত ইতিহাসের মধ্যযুগ বিশেষ করে তিনশ বছরের ইসলামিক শাসন ( প্রথমে সুলতানি যুগ ও পরে মুঘল যুগ) এই ইতিহাস প্রকল্পের কাছে বিশাল প্রতিবন্ধক। শুধুমাত্র অন্ধকার যুগ বা ‘যবন সর্পদের হিসহিস’ বলে একে দেগে দিয়ে ইতিহাসের গতিকে রূদ্ধ করা যাবে না।মুঘলদের দীর্ঘ শাসনব্যবস্থা,শিল্প সংস্কৃতির গৌরব গাথা শুধু নয়, মধ্যযুগেই হিন্দু ধর্মতত্ত্ব, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছিল। সায়নের ঋকবেদ ভাষ্য, কুলুকার সমাজবিধি, ভক্তিবাদী আন্দোলন, তুলসিদাসের রামচরিতমানস, হিন্দুস্তানি ধ্রুপদ সংগীত,কর্নাটকি সংগীত,নতুন স্থাপত্য রীতি—সবই মধ্যযুগের ফসল। এই অবস্থায় সংঘ পরিবার মধ্যযুগের ইতিহাস ভাবনাকে গুলিয়ে দিতে একাধিক কৌশল গ্রহণ করেছে। প্রথমত প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে মধ্যযুগ-সম্পর্কিত বিভিন্ন স্থানের নাম বদলে দেওয়া। দ্বিতীয়ত সাধারণ মানুষের ইতিহাস বোধ যেহেতু স্কুলপাঠ্য ইতিহাস বইগুলি থেকে গড়ে ওঠে তাই সেখানে ইসলামিক যুগের ইতিহাসকে বর্জন বা কাটছাঁট করা। তৃতীয়ত নতুন ইতিহাস রচনার নামে ইতিমধ্যে প্রমাণসিদ্ধ ইতিহাসকে বিকৃত করা। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় রাজস্থান ইতিহাস বোর্ডের প্রস্তাব, যেখানে বলা হয়েছিল হলদিঘাটের যুদ্ধে রাণা প্রতাপ আকবরের বাহিনীকে শোচনীয় ভাবে পরাজিত করেছিলেন বা তাজমহল আদতে একটি হিন্দু মন্দির ইত্যাদি।
সমস্যাটা শুধু মধ্যযুগেই সীমাবদ্ধ নেই।আধুনিক ভারতের ইতিহাস আখ্যানকেও সংঘ পরিবার মেনে নিতে পারে না।কংগ্রেসের নেতৃত্বে গণ আন্দোলন(অসহযোগ, আইন অমান্য ও ভারত ছাড়ো) হোক বা সশস্ত্র সংগ্রামের উজ্জ্বল ইতিহাস—সংঘ পরিবার বা তাদের ভাবাদর্শ কোথাও নেই। কারণ উপনিবেশ বিরোধী মুক্তিযুদ্ধে তারা ব্রিটিশদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন।যাবতীয় সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা সত্বেও দেশভাগ আটকাতে এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধির এক নৈতিক অবস্থান ছিল, তাই হিন্দু রাষ্ট্রের প্রবক্তাদের কাছে তিনি এক সমস্যা এবং বর্জনীয়। হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে এনসিইআরটি আজ মহাত্মা গান্ধির হত্যার প্রসঙ্গটি বাদ দিয়ে সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণ করল। বহুত্ববাদের শিক্ষা ও গণতান্ত্রিক ভাবনার বিস্তার কর্পোরেট হিন্দুত্বের স্বার্থের সহায়ক নয়।তাই সিলেবাসের এই বর্জন ও সংশোধনের খেলা। এই খেলায় অমিত শাহেরা এতদিনের ইতিহাস চর্চা ও তার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ভাবনার ঐতিহাসিকদের গণশত্রু বলে চিহ্নিত করছেন। লক্ষ্য-সংঘ পরিবারের ভাবাদর্শে নতুন ইতিহাস রচনা। কোন ইতিহাস লেখা হবে আর কোন ইতিহাস বাতিল হবে তা এক দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াইয়ের ফলাফলে নির্ধারিত হবে, একথা বলাই বাহুল্য।