Home শিক্ষা মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট শিক্ষা সংস্কারের ধারাবহিকতাতেই মোদির নয়া শিক্ষানীতি ২০২০
0

মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট শিক্ষা সংস্কারের ধারাবহিকতাতেই মোদির নয়া শিক্ষানীতি ২০২০

মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট শিক্ষা সংস্কারের ধারাবহিকতাতেই মোদির নয়া শিক্ষানীতি ২০২০
0
শুভেন্দু ঘোষ

“ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রয়োজন এক শাসক শ্রেণির।.. রাষ্ট্র শাসনের জন্য আবশ্যক কর্মকর্তাদের আমি শূন্য থেকে সৃষ্টি করতে পারব না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেই তাদের ক্রমে ক্রমে গঠন করে দিতে হবে আমার জন্য…। … এই হল জেনতিল সংস্কারের গভীরতর কারণ।”

বেনিতো মুসোলিনি, ১৯২৩।

ইতালিতে জেনতিল সংস্কারের অন্যতম প্রবণতা ছিল ‘নিঃস্বার্থ’ (যা তাৎক্ষণিক কোনো উদ্দেশ্যসাধনে লিপ্ত নয়) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিলোপসাধন, বা অল্প কিছু সংখ্যক বাঁচিয়ে রাখা যাতে তা শুধুমাত্র উচ্চশ্রেণির মানুষের নাগালেই থাকে। অপরপক্ষে  জোর দেওয়া হল বৃত্তিমূলক শিক্ষার স্কুলের সংখ্যা বাড়ানোর উপর। পরিষ্কার ভাবেই দ্বিতীয় ধরনের স্কুলের পড়ুয়ারা নিম্নশ্রেণি থেকেই উঠে আসবেন। গ্রামসি এই প্রবণতাকে দেখেছেন শাসক শ্রেণির অ্যাজেন্ডা হিসেবেই। মানবমুখী সংস্কৃতির শিক্ষা থেকে দূরে ঠেলে বিশেষ বৃত্তিমূলক শিক্ষার দিকে শোষিত শ্রেণিকে ঠেলে দিয়ে পড়ুয়াদের নিয়তি যেন প্রথমেই রচিত করে দেওয়া হচ্ছে। শাসক শ্রেণির দর্শনগত আধিপত্যকে নিরঙ্কুশ করতে তৈরি করা হচ্ছে এক বিকৃত শিক্ষাব্যবস্থা। গ্রামসি এটাও খেয়াল করছেন এই বিশেষ ধরনের সংস্কার এক রাজনৈতিক আমলাতান্ত্রিক আধিপত্যের জন্ম দেয়, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আস্তে আস্তে গ্রাস করে ফেলে।

সাম্রাজ্যবাদের যুগে পুঁজিবাদী শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য মুনাফা কামানোর সাথে সাথে মতাদর্শগত নিয়ন্ত্রণের। পুঁজিবাদ যেমন শ্রমিককে তার মানসিক চিন্তন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে থাকে, তার শিক্ষাব্যবস্থাও তাকে তার ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন, বিকৃত করতে থাকে। জন্ম দেয় কম শিক্ষিত(মৌল মানসিক চিন্তার নিরিখে), বেশি অনুগত মানুষের। ফ্যাসিস্ট শাসন এই বিকৃতিকে নিয়ে যায় এক অন্য পর্যায়ে। সে একই সাথে মৌল চিন্তা ভাবনার প্রক্রিয়া থেকে পড়ুয়াদের চ্যুতি ঘটায় আবার ভ্রান্ত বিকৃত ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে তৈরি করে তার পদাতিক বাহিনী। আমরা দেখতে পাই উত্তর ভারতের এক তীব্র প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তানি সংস্কৃতিকে শিক্ষাব্যবস্থা ও বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমের ঢক্কানিনাদ সহ,  ভারতের ঐতিহ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল, ভারতের শোষিত শ্রেণির সিংহভাগই এই প্রাধান্যকারী সংস্কৃতির অংশীদার নয়, ফলস্বরূপ তাদের পক্ষে এই শিক্ষাব্যবস্থায় সফল হওয়া(বাকি সমস্ত বৈষম্যকে অস্বীকার করলেও) অসম্ভব এক প্রকল্প।

এবার জাতীয় শিক্ষানীতি -২০২০ এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একটু নয়ন মেলা যাক। প্রথমত ইংরেজিকে এলিটদের ভাষা বলে খোরাক করে ত্রিভাষা সূত্র নামানো হয়েছে, অর্থাৎ এলিট ইংরেজির পাশাপাশি ‘ভোকাল ফর লোকাল’ হিন্দিও গিলতে হবে। দ্বিতীয়ত  সরকার ‘ইন্ডিয়ান এডুকেশান সার্ভিস’ তৈরি করবে, এবং তার ক্যাডারদের সরকার বাছাই করবে। এই শ্রী শ্রী আমলা বাবুর দল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পদে  নিযুক্ত হবে, এবং তারপর কী হবে শ্যামলালই জানবে। তৃতীয় এবং ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট হল বৃত্তিমূলক শিক্ষা। এর আগে বৃত্তিমূলক শিক্ষার আলাদা ব্যবস্থা থাকলেও তা শুরু করা যেত অষ্টম ও দশম শ্রেণিতে। কিন্তু বর্তমান শিক্ষানীতিতে অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি (বয়স ১১-১২ বছর) থেকেই ভোকেশনাল কোর্সে নবিশি শুরু করার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে অনলাইন শিক্ষায় জোর দেওয়ার কথা। এছাড়া ফ্লেক্সিবিলিটির গুলগাপ্পা দিয়ে এক্সিট এন্ট্রির কেত্তনও আছে।

একশ বছর আগের ইতিহাসের দিকে হালকা চোখ বোলালেই বোঝা যায়, কর্পোরেট হাঙরদের স্বার্থে ‘সস্তায়’ শ্রমিক ও ‘পুষ্টিকর'(পড়ুন চড়া মুনাফাদায়ক) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরির পাশাপাশি এই শিক্ষানীতি আসলে ফ্যাসিস্ট মতাদর্শের ধারক বাহকের কারখানা বিশেষ।

একদিকে এই নয়া শিক্ষানীতি ভারতীয় ঐতিহ্য(ব্রাহ্মণ্যবাদ),  ভাষা(হিন্দি) ছড়িয়ে দিতে চায়, আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থায় যেটুকু মৌলিক চিন্তার অবকাশ ছিল তাকে ধ্বংস করতে চায়। অন্যদিকে বৃত্তি শিক্ষা ও ফ্লেক্সিবিলিটির নামে ব্যাপক শ্রমজীবী ও প্রান্তিক জনগণকে সমাজবিদ্যা, সংস্কৃতি, মৌলবিজ্ঞানের চর্চা থেকে দূরে ঠেলে নিজেদের মতাদর্শগত আধিপত্য বজায় রাখতে চায়।

সাম্প্রতিক তথ্যের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে ভারত ক্ষুধার সূচকে পৃথিবীর শেষের দিকের দেশ, বাংলাদেশ পাকিস্তান নেপালেরও পিছনে। সবচেয়ে বেশি শিশুশ্রমিক ভারতে, এগারো জন শিশুর একজন শ্রমে নিযুক্ত। করোনাকালে পশ্চিমবঙ্গে হওয়া এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে বাংলায় শিশুশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ১৭% শিশু অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। বাংলার ২৯% পড়ুয়া অনলাইন শিক্ষার সুযোগ পেলেও গোটা দেশের ক্ষেত্রে তা মাত্র ১৪%, ফলে শিশুশ্রমের ক্ষেত্রে গোটা ভারতের ছবি আশাপ্রদ কিছু হবে এমনটা আশা করা বোকামি। আপাত কেওটিক এই তথ্যগুলো আসলে আমাদের আলোচনার নিরিখে প্রচণ্ড জড়িত। আদতে একটা আধা ঔপনিবেশিক আধা সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় শোষক শ্রেণির যে আধিপত্য ও শ্রমাজীবী শ্রেণির যে প্রান্তিকিকরণ হাজির ছিল, তা নতুন শিক্ষানীতির মাধ্যমে আরো তীব্র হবে। এবং সেই তীব্রতা ফ্যাসিস্ট দর্শনের সাথে সাজুয্য রেখে শোষকের স্বার্থকে রক্ষা করার জন্যই নির্মিত হয়েছে।

একশ বছর আগের ফ্যাসিস্টদের ইতিহাস আমাদের সামনে রাখা,  মুসোলিনির বনসাই মোদির ইতিহাসকে  রুখে দেওয়াটাই এই মূহূর্তে জনগণের প্রধান কর্তব্য। যদিও শুধু ফ্যাসিস্টরা নয়, শাসক শ্রেণির প্রতিটি অংশই শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমন ভাবে তৈরি ও পরিবর্তন করে যাতে জনগণকে উদ্বৃত্ত তৈরি করার যন্ত্র বানিয়ে রাখা যায়। কিন্তু সেই বিস্তৃত আলোচনা আপাতত মুলতুবি থাক।

লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে পদার্থবিদ্যার গবেষক।

ছবি সূত্র: গ্রাউন্ড জিরো  

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *