ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে শঙ্কর গুহ নিয়োগির নেতৃত্ব: গুরুত্ব ও শিক্ষা
nazariyamagazine.in ওয়েবপোর্টালে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি এই নিবন্ধটি হিন্দিতে প্রকাশিত হয়। রচনাটির গুরুত্ব অনুভব করে আমরা সামান্য আক্ষরিক পরিমার্জন সহ এর বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করছি।
“নিপীড়ন এবং অবিচারের বিরুদ্ধে জনগণের হিংসাত্মক রূপে ফেটে পড়া অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। যতদিন পর্যন্ত একটি শ্রেণির দ্বারা আরেকটি শ্রেণির দমন জারি থাকবে, ততদিন শ্রেণি সংগ্রামের বর্তমান নিয়ম মেনেই এইরূপ ঘটনাও ঘটতে থাকবে”।
- শঙ্কর গুহ নিয়োগি
মধ্য ভারতে শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে কথা উঠলে ছত্তীসগঢ়ের বিখ্যাত শ্রমিক নেতা শঙ্কর গুহ নিয়োগির বিষয়ে আলোচনা হওয়া একান্ত জরুরি। বর্তমানে, ছত্তীসগঢ়ে যখন খনিজ সম্পদের অবাধ লুণ্ঠন চলছে, তখন মধ্য ভারতের শ্রমিক আন্দোলন এবং এর পাশাপাশি তার বিরোধী আন্দোলনগুলির ইতিহাসকে অনুধাবন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, শঙ্কর গুহ নিয়োগির নেতৃত্বে ছত্তীসগঢ়ে খাদান শ্রমিক ইউনিয়নের ব্যানারে তিন দশকব্যাপী যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার রূপরেখাকে বোঝা খুব জরুরি। ছত্তীসগঢ় খাদান শ্রমিক সংঘ গঠন হয়েছিল ছত্তিশগড়ের বালোদ জেলার লৌহ আকরিক খনিতে। ভিলাই স্টিল প্লান্ট, যা কিনা দেশের সর্ববৃহৎ ইস্পাত উৎপাদনকারী শিল্পক্ষেত্রগুলির মধ্যে একটি, এই খনি থেকেই তার প্রয়োজনীয় লৌহ আকরিক জোগান পেত। এই কারণে এই খনিটির প্রবল গুরুত্ব ছিল।
প্রত্যেক আন্দোলনের ইতিহাস থেকেই আমরা কিছু না কিছু শিখতে পারি। মার্কসবাদ আমাদের শিক্ষা দেয় ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে অতীতের ভুলগুলিকে শুধরে ইতিবাচক যা কিছু বর্তমানে প্রাসঙ্গিক, তাকে কাজে লাগিয়ে একটি উন্নত সমাজ গড়ার উদ্দেশ্যে সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। নিয়োগির নেতৃত্বকারী ভুমিকার ক্ষেত্রে বেশ কিছু দুর্বলতা থাকলেও তাঁর জীবন ফিরে দেখলে আমরা অনেক ইতিবাচক দিকও আবিষ্কার করব। তাঁর শিক্ষণীয় দিকগুলি আমাদের প্রকৃত শ্রেণি সংগ্রামের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা পেতে সাহায্য করবে। বর্তমানে, যখন শ্রমিক আন্দোলনের শক্তি এবং জঙ্গি রূপ কিছুটা কমে গেছে, বিশেষত শ্রমিকশ্রেণির ওপর যখন সর্বাত্মক আক্রমণ নেমে আসছে, তখন অর্থনীতি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে পুরনো ধারার ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতির সমস্যাগুলিই শ্রমিক আন্দোলনের বিকাশের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে কিনা, এই প্রশ্নটা তোলা জরুরি হয়ে পড়ছে। এছাড়া, কেন্দ্রীয় এবং তথাকথিত বিপ্লবী ট্রেড ইউনিয়নগুলির গতানুগতিক আন্দোলনের পরিবর্তে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে মার্কসবাদী বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে গড়ে তোলা গঠনমূলক আন্দোলনেরও অভাব রয়েছে।
আমরা তাই নিয়োগির নেতৃত্বে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে যে সমস্ত সৃজনশীল পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলি হয়েছিল তা বোঝার চেষ্টা করব।
সংঘর্ষ ও নির্মাণ (নির্মাণের জন্য সংঘর্ষ, সংঘর্ষের জন্য নির্মাণ)
ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ক্ষেত্রে নিয়োগির সংঘর্ষ ও নির্মাণের তত্ত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। তাঁর গড়ে তোলা আন্দোলন জুড়ে এই নীতির প্রভাব স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায়। নিয়োগি মনে করতেন যে আমরা বিপ্লবোত্তর পর্বে আমরা যে সুন্দর সমাজের স্বপ্ন দেখি, তার বিভিন্ন দিকগুলিকে জনগণের সামনে তুলে ধরা অত্যন্ত জরুরি একটি কাজ। এইভাবে, আমরা সাধারণ মানুষকে আত্মত্যাগের ওপর ভিত্তি করে তৈরি এই রাজনীতি যে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্য নিয়ে প্রচার করা হচ্ছে, সেই বিষয়ে সচেতন করতে পারবো। এটা করতে যদি আমরা অক্ষম হই, তাহলে আন্দোলন দ্রুত হতাশাবাদ এবং ঠিক তার পরেই সংশোধনবাদের দিকে বাঁক নেবে। এর জন্য অর্থনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি শ্রমিকদের রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের গতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন বিকল্প নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নিয়োগির নীতি অনুযায়ী সংঘর্ষ এবং নির্মাণ এক জোড়া পায়ের মতো—যে ব্যক্তি শুধুমাত্র একটি পা ব্যবহার করে হাঁটার চেষ্টা করবেন, তিনি হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে বাধ্য, দুটি পায়ের ওপর সমান ভার দেওয়াই এগোনোর একমাত্র উপায়। এই নীতির ওপর ভিত্তি করেই একমাত্র নতুন সমাজ ব্যবস্থার বীজ অঙ্কুরিত হতে পারে। বর্তমান সমাজের দুর্নীতিগ্রস্ত এবং পচে যাওয়া ব্যবস্থা ও তার প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রামরত শ্রমিকরা ধীরে ধীরে একটি বিকল্প সমাজের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। সাধারণত এই আন্দোলনগুলিতে, এই স্বপ্নটি চিন্তার বিমূর্ত স্তরেই আটকে থাকে, যার ফলে সময়ের সঙ্গে এই স্বপ্নটিও মলিন হয়ে যায় এবং দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম গড়ে তুলতে অনুপ্রেরণা যোগাতে ব্যর্থ হয়। নিয়োগির নীতি অনুযায়ী, এইভাবেই, নতুন সমাজ নির্মাণ করার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তর করার উদ্দেশ্যে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সকল মানুষ আরও এক ধাপ এগিয়ে যান। তাঁদের আন্দোলনের অংশ হিসেবেই শহিদ হাসপাতাল, শহিদ স্কুল, শহিদ গ্যারাজ এবং কর্মশালা নির্মিত হয়েছিল। শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থে বিকল্প স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরি করতে তাঁদের শ্রম ও সম্পদকে কাজে লাগিয়ে ওখানকার শ্রমিকরা নির্মাণ করেছিলেন শহিদ হাসপাতাল, অন্যান্য উদ্যোগগুলিও একইভাবে গড়ে উঠেছিল। তাঁদের কাজ শুধুমাত্র কিছু বিকল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করাতেই সীমিত ছিল না। নিয়োগি জোর দিয়েছিলেন সেই বিকল্প প্রতিষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্র করে একটি নয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার ওপর। এর কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল তাঁদের সংগঠনের নিজস্ব সাংস্কৃতিক উদ্যোগ ‘নব অঞ্জর’, গণতান্ত্রিক সাহিত্য প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে তৈরি লোক সাহিত্য পরিষদ, ‘মিতান’ সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং সেচের জন্য বাঁধ নির্মাণ করা।
২৪ ঘণ্টা ট্রেড ইউনিয়ন করার প্রয়োজনীয়তা কী?
দাল্লি রাজহারা খনিতে নিয়োগির হস্তক্ষেপের আগে, AITUC এবং INTUC-এর মতন ট্রেড ইউনিয়নগুলির অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু, শীঘ্রই শ্রমিকরা এই ইউনিয়নগুলির সঙ্গে ম্যানেজমেন্টের আঁতাত বুঝতে পারেন এবং তাদের বিকল্প হিসেবে নিয়োগির নেতৃত্বে ছত্তীসগঢ় খাদান শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। এই সময় নিয়োগি নিজেও ওই খনিতে কর্মরত ছিলেন। শুরু থেকেই তিনি তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির বিরুদ্ধে মতাদর্শগত আক্রমণ চালিয়েছিলেন। অন্যান্য মতাদর্শগত বিরোধের পাশাপাশি তাদের আক্রমণ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল এই কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির কর্ম পদ্ধতি—এরা শুধুমাত্র শ্রমিকরা তাঁদের গোটা দিনের যে সময়টুকু কাজে ব্যয় করতেন, তা নিয়েই কথা বলায় জোর দিত (তাও খুবই অল্প মাত্রায়)। নিয়োগি মনে করতেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিকদের কাজের সময় বাদ দিয়ে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের বাকি সময়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠতে পারছে না, ততক্ষণ অবধি সেই ট্রেড ইউনিয়নটি কোনো বিপ্লবী রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম নয়। এইভাবে, নিয়োগির উপদেশ মেনে চললে, শ্রমিক আন্দোলনকে অর্থনীতিবাদের কবলে পড়ার থেকে রক্ষা করা তো বটেই, শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবনে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রসার ঘটানোও সম্ভব। এক্ষেত্রেও আমরা সংঘর্ষ ও নির্মাণের নীতির প্রয়োগ স্পষ্টভাবে লক্ষ করতে পারি। ট্রেড ইউনিয়ন করার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল শ্রমিক মহল্লায় জল, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গৃহ হিংসা, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা। তাঁদের সংগঠনের ইতিহাসে মদ বিরোধী আন্দোলনেরও একটি গৌরবময় অধ্যায় রয়েছে। এই সমস্ত বিষয়ে মাথায় রেখে সাংগঠনিক কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁরা তাঁদের ইউনিয়নের মধ্যে ১৮টি বিভাগ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু, নিয়োগি এটাও স্পষ্টভাবে বলতেন যে জল, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ইত্যাদি নিয়ে আন্দোলন কখনওই শ্রমিক আন্দোলনের প্রধান বিষয়বস্তু হতে পারে না। শ্রেণি সংগ্রামকেই শ্রমিক আন্দলনের কেন্দ্রে স্থান দিতে হবে।
এর পাশাপাশি, নিয়োগি উৎপাদন সংগ্রাম এবং শ্রেণি সংগ্রাম-এর কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে কৃষি শ্রমিক শ্রেণি সর্বক্ষণ উৎপাদন সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন, কিন্তু তাঁদের সেই সংগ্রামকে শ্রেণি সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করার দায়িত্ব একটি ট্রেড ইউনিয়নের ওপর বর্তায়।
দীর্ঘকালীন সংগ্রামের নিরিখে দেখলে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি একটি ট্রেড ইউনিয়নের সঠিক নেতৃত্বের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ছত্তীসগঢ় খাদান শ্রমিক ইউনিয়নের ক্ষেত্রেও নিয়োগি এই নীতিটি প্রণয়ন করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর একটি লেখায় তিনি লিখেছিলেন —
“এই প্রশ্নটি যখনই ওঠে, তখন এটিকে এড়ানো হয় সংগঠনের বড় আকারকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে। শেষমেশ, যে ধরনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই সংগঠনের কর্মপদ্ধিতি হিসেবে প্রয়োগ করা হোক না কেন, ‘জনগণ’ অদৃশ্য হয়ে যায়, ‘আইন’ থেকে যায় এবং তারপর ‘আইন’ নিয়ে ‘বিতর্ক’ তৈরি হয়। যত বেশি মাথা, তত বেশি মত এবং তত বেশি পথ। এই ভাবে বহু-কেন্দ্রিকতা সংগঠনকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। আজকের অনেক সমাজতান্ত্রিক ট্রেড ইউনিয়নই এই দুঃখজনক পরিস্থিতির শিকার।
সব শেষে তারা বলে—‘শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার পদ্ধতিটিই হল ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন করার সঠিক পদ্ধতি’।”
ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব
যে কোনো আন্দোলনের ভবিষ্যৎ তার নেতৃত্বের ওপর ব্যাপক ভাবে নির্ভর করে। একটি ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের ক্ষেত্রে তার কর্ম পদ্ধতি, কর্মসূচি, প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়নের দিশা, শ্রেণি সংগ্রামের বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে তার ভূমিকা—এই সমস্ত প্রশ্নগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়োগিরও তাঁর সংগঠনের নেতৃত্ব সম্বন্ধে বেশ গভীর এবং পরিপক্ক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। যদিও, নেতৃত্ব তৈরি করার ভাবনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু দুর্বলতা কাজ করেছিল যার জন্য ছত্তীসগঢ় মুক্তি মোর্চার পরবর্তী নেতৃত্ব তাঁদের আন্দোলনকে সঠিক দিশায় চালিত করতে ব্যর্থ হয়। তা সত্ত্বেও, নেতৃত্ব প্রসঙ্গে নিয়োগির দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নিয়োগি শ্রেণি সংগ্রামের সঠিক বোঝাপড়াকে প্রধান শর্ত হিসেবে গণ্য করেছেন, তাঁর চিন্তা অনুযায়ী, সেই ব্যক্তিই সঠিক নেতৃত্ব যে সবচেয়ে বেশি শ্রেণি সচেতন। এর পর, তিনি যে বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছেন তা হল যে কোনো শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বই সর্বহারা শ্রেণির হাতে থাকা উচিত। যেমন, কৃষি শ্রমিকদের নেতৃত্ব হল কৃষি শ্রমিক পার্টি, যার মূল কাজের বিষয়বস্তু হল কৃষি শ্রমিকদের রাজনীতি। ছত্তীসগঢ়ের শিল্পাঞ্চলগুলির পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় যে বিভিন্ন রাজ্য থেকে কর্মসংস্থানের খোঁজে আসা মানুষ মিলে যাতে বৃহৎ শ্রেণিভিত্তিক ঐক্য গড়ে না তুলতে পারেন, তাই রাজনৈতিক দলগুলি তাদের ‘ছত্তীসগঢ়ী বনাম বিহারি’ বা ‘ছত্তীসগঢ়ী বনাম তেলেগু’-র মতো বিতর্কে জড়িয়ে ব্যস্ত রাখে। এটা সত্যি যে বাইরে থেকে আসা শ্রমিকদের এখানকার সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক গড়ে উঠলেও তাঁরা জাতিগত ভাবে এবং সাংস্কৃতিক ভাবে আপন মনে করেন তাদের জন্মস্থানকেই। নিয়োগির স্পষ্ট মতামত ছিল যে একটি ট্রেড ইউনিয়নকে এই সমস্ত কথা মাথায় রেখেই শ্রেণিভিত্তিক ঐক্য গড়ে তুলে ব্যাপক শ্রমিক ঐক্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
তা বাদ দিয়ে, নেতৃত্ব গড়ে ওঠার জন্য যে ৪টি বিষয়ের ওপর নিয়োগি জোর দিয়েছেন তা হল—শ্রেণি সংগ্রাম, উৎপাদনের সংগ্রাম, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ইতিহাসের অধ্যয়ন। নেতৃত্ব যাতে অর্থনীতিবাদ, সংশোধনবাদ, বাম বিচ্যুতি এবং মতাদর্শগত দীনতা এড়িয়ে চলতে পারে তার জন্য পূর্বে উল্লেখিত বিষয়গুলিকে ৪টি স্তম্ভ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে ইতিহাসের অধ্যয়ন বলতে তিনি শুধু ইতিহাস সম্বন্ধে জানার কথা বলেননি। তিনি যে জায়গাটির ওপর জোর দিয়েছেন তা হল ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ঠিক করা। নিয়োগি এই বিষয়টিকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন তা হল —
“পুঁজিবাদী শ্রেণি এবং সাম্রাজ্যবাদীরা যেখানে ইতিহাস এবং তার বস্তুগত পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নেয়, ভারতের ট্রেড ইউনিয়নপন্থীরা আজ সেখানে তার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর কথা ভাবছে”।
এই পর্বে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সমস্ত প্রশ্ন উঠে এসেছে, তার মধ্যে অন্যতম হল ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কীরকম হবে তা নিয়ে। এই প্রসঙ্গে নিয়োগি একটি অত্যন্ত স্পষ্ট উত্তর দিয়েছিলেন —
“শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু মাথায় রাখা দরকার যাতে আন্দোলনের নেতৃত্ব সব সময় শ্রমিক শ্রেণির হাতে যেন থাকে”।
যান্ত্রিকীকরণ
দাল্লি রাজহারার আন্দোলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রামগুলির মধ্যে একটি ছিল যান্ত্রিকীকরণ বিরোধী সংগ্রাম। এই সংগ্রাম শুধুমাত্র যান্ত্রিকীকরণের তীব্র বিরোধিতাই করেনি, বরং শিল্পক্ষেত্রে বাড়তে থাকা যান্ত্রিকীকরণের বিকল্প সমাধানও খোঁজার প্রচেষ্টা করেছিল। যখন রাজহারা খনির সম্পূর্ণ যান্ত্রিকীকরণের প্রস্তাব ওঠে, তখন ওখানকার শ্রমিক সংগঠন এর ফলে শ্রমিকদের যে গণ ছাঁটাই হতে হবে—সেই সমস্যার কথা জোরালো কণ্ঠে তুলে ধরেন। বিকল্প হিসেবে তখন তাঁরা আধা-যান্ত্রিকীকরণের প্রস্তাব রেখেছিলেন। এই তত্ত্বটি সম্পূর্ণ যান্ত্রিকীকরণের বিরোধিতা করে এবং আকরিক উত্তোলনের কাজটি শ্রমিকদের দিয়ে করিয়ে পরবর্তী বাকি কাজটুকুর ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার করার পক্ষে কথা বলে। দাল্লি রাজহারাতে এই তত্ত্বটির প্রয়োগ শুধুমাত্র পরীক্ষামূলক জায়গা থেকে করা হয়েছিল। এই পরীক্ষাটিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখলে বর্তমানে জাতীয় স্তরে সাধারণত যে সমস্ত খনন প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয় সেই প্রসঙ্গে নতুন ভাবনাচিন্তার জন্ম হতে পারে। এছাড়াও, নিয়োগি যান্ত্রিকীকরণ সংক্রান্ত আরও একটি জরুরি বিষয়ে অবদান রেখেছিলেন — “আমাদের দেশে খনন সংক্রান্ত আইন-নীতিগুলি বিদেশে বসে থাকা আমাদের মালিকদের বাজার নীতির সঙ্গে সামাঞ্জস্য রেখে ঠিক করা হয়। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি কোনো বেঁধে দেওয়া নীতি অনুযায়ী তাদের পণ্য বিক্রয় করে মুনাফা লাভ করাতে সন্তুষ্ট নয়। তারা সারাক্ষণ উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং প্রযুক্তির বিকাশের বিকৃতি ঘটিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে তাদের অধীনে থাকা দেশগুলির উৎপাদন নীতিতে হস্তক্ষেপ করার মধ্যে দিয়ে অতি মুনাফার খোঁজ করতে থাকে”।
ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে জঙ্গি আন্দোলনে পরিণত করার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রেও নিয়োগি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। নিয়োগি তাঁর অধিকাংশ লেখাতেই মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শের কথা লিখেছেন, কিন্তু তাঁর গড়ে তোলা আন্দোলনে বেশ কিছু দুর্বলতা রয়ে গিয়েছিল, যার কারণে আন্দোলনটি বিপ্লবী আন্দোলনে পরিণত হতে পারেনি। ছত্তীসগঢ় মুক্তি মোর্চা তাদের রাজনীতি প্রচার করার জন্য বিভিন্ন নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছিল, কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পেছনে যে যুক্তিগুলি দেওয়া হয়েছিল, তা যথেষ্ট ছিল না। একইভাবে, নিয়োগির হত্যা হওয়ারও আগে তাঁর সংগঠনের ভিতর এমন কোনো নেতৃত্ব উঠে আসেননি যিনি তাঁদের আন্দোলনকে সঠিক ভাবে চালিত করবেন এবং ঠিক এই কারণেই এই আন্দোলনের গতিপথে ধ্বস নেমে আসে। যদিও, নিয়োগির হত্যার পর গোটা আন্দোলনটি বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়, কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট মানুষ সঠিক বিপ্লবী পথে কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে মনস্থির এবং তাঁরা বৃহত্তর সংগ্রামের ময়দানে এখনও তাই করে চলেছেন। কিন্তু, নিয়োগির গড়ে তোলা আন্দোলনের সিংহভাগ নেতৃত্বই নিয়োগির দ্বারা উল্লেখিত পুরনো ভূল-ত্রুটির ফাঁদেই পা দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর শেষ প্রবন্ধে লিখেছিলেন —
“আমার মৃত্যুর পর এমন একটি নেতৃত্ব গঠন করতে হবে যারা এটা নিশ্চিত করবে যে এই আন্দোলনটি সঠিক দিশায় এগিয়ে চলে। নির্মাণ এবং সংগ্রাম হল আমাদের আন্দোলনের মূল দুটি বিষয়। এর অর্থ হল গঠনমূলক উদ্যোগ নিতে হবে এবং তার পাশাপাশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে হবে—সমস্ত ধরণের শোষণ এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জারি রাখতে হবে…আমাদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা রয়েছে জনযুদ্ধ গোষ্ঠী এবং আইপিএফ-এর”।
এর পরেই নিয়োগি স্পষ্টভাবে এই দুটি সংগঠনের সঙ্গে তাঁদের বিতর্কের জায়গাগুলি আগামীর নেতৃত্বের জন্য চিহ্নিত করেছিলেন এবং শেষে বলেছিলেন যে —
“আমার বিশ্বাস একদিন ভারতে একটি সঠিক মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী পার্টি প্রতিষ্ঠিত হবে। সেদিন, আমি ছত্তীসগঢ়ের বিপ্লবী কমরেডদের অনুরোধ করবো ওই মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী পার্টির সঙ্গে সহযোগিতা করে সকলকে এক নতুন দুনিয়া বা নতুন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে”।
এই মর্মে, নিয়োগির গোটা ভাবনাটি বোঝা যায় তাঁদের আন্দোলন থেকে উঠে আসা একটি গানের মধ্যে দিয়ে —
“গণসংগঠন, গণআন্দোলন, জনযুদ্ধের পথে এগিয়ে যাও
ছত্তীসগঢ়ের মুক্তির স্বার্থে, একই পদক্ষেপ নাও!”
-গীত, আইন বিভাগের ছাত্রী, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়