মোদির টিকানীতি অবস্থাপন্নদের সুবিধা দেওয়ার জন্য তৈরি
পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: ভারত সরকারের কোভিড-১৯ প্রতিষেধক বিলি প্রকল্প বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় হতে পারত। উল্টে টিকা কেন্দ্রগুলিতে টিকার জোগান নেই।ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩% মানুষ এ পর্যন্ত টিকা পেয়েছে। ভারতের ধনী ব্যক্তিরাই এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী।
অসুধ তৈরিতে ভারতবর্ষ বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলির মধ্যে রয়েছে। সিরাম ইন্সটিটিউট বিশ্বের বৃহত্তম টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থা, প্রতি বছর ১.৫ বিলিয়ন ভ্যাকসিন ডোজ উৎপাদন করে এই সংস্থা। বিশ্বের অর্ধেক শিশুকেই এই সংস্থারই ভ্যাকসিন দেওয়া হয় এবং পৃথিবীতে যত টিকা রফতানি হয়, তার ৬০ শতাংশই করে ভারত। ২০২০ সালের মাঝামঝি সময়ে, সেরাম ইন্সটিটিউট অক্সফোর্ড-অ্যাস্ত্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের এক বিলিয়ন ডোজ তৈরির জন্য একটি চুক্তি করেছিল, যার অর্ধেকটি কোভ্যাক্স ডোজ শেয়ারিং কর্মসূচির অংশ হিসাবে রফতানি করা হয়েছিল।
ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন যে চলতি বছরের অগাস্টের মধ্যে ৩০ কোটি ভারতীয়কে টিকা দেওয়া হবে। ভারতের জনস্বাস্থ্য ফাউন্ডেশনের সভাপতি কে শ্রীনাথ রেড্ডি বলেছিলেন, ‘বিশাল মাপের সর্বজনীন টিকাদান কর্মসূচি চালানোর’ অভিজ্ঞতা ভারতের রয়েছে, যেটা একটা বড়ো সুবিধা। কথাটা ঠিক। জানুয়ারিতে তিন দিনের মধ্যে ১১ কোটি শিশুকে পোলিও টিকা দেওয়া হয়েছিল, সে সময়ই মহামারিটি ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।
ভারতে করোনয় প্রতিদিন চার হাজারের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন। অথচ টিকাদান কর্মসূচি পড়ে রয়েছে তিমিরে। সরকার বলতে পারবে না তাদের উৎপাদন ক্ষমতা নেই। তা রয়েছে। সরকার বলতে পারবে না যে তাদের গণ টিকাকরণ কর্মসূচি চালানোর মতো পরিকাঠামো নেই। সেটা ভালোমতোই আছে। তারা বলতে পারবে না যে টাকা নেই। কারণ অঢেল টাকাও রয়েছে।
১০০র বেশি বিলিয়নেয়ার বাস করেন এই দেশে। ভারতের রয়েছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সামরিক বাজেট ( প্রতি বছর ৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), যা জনস্বাস্থের জন্য নির্ধারিত বাজেটের দ্বিগুণ। উড়িয়ে দেওয়ার মতো টাকাও ভারত সরকারের নেহাৎ কম নেই। দিল্লিতে ১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে সরকারি প্রাসাদ নির্মাণকার্য চলছে।
টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত ও উপর তলার মানুষের কোনো সমস্যা নেই। শুধু ভারতের শ্রমজীবী ও অতি দরিদ্র শ্রেণির মানুষ টিকা নেওয়া থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। একটি টিকাকেন্দ্রের প্রশাসক, টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে বলেছেন, “আমাদের কেন্দ্রে কেবল সমাজের ওপর তলার মানুষদেরই আসতে দেখি”।
অবশ্যই পয়সাওলা ব্যক্তিরা এক পা এগিয়ে রয়েছেন – সরকার ইন্টারনেটের মাধ্যমে টিকাদান কর্মসূচি চালু করেছে, তবে ভারতের বেশির ভাগ মানুষই ইন্টারনেট ব্যাবহার করেন না। টিকা নেওয়ার জন্য, জনগণকে সরকারের ‘কোউইন’ ওয়েবসাইটে একটি অ্যাকাউন্ট তৈরি করতে হচ্ছে এবং তারপরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করতে হচ্ছে। বালাই বাহুল্য, পোর্টালটিতে নানা রকম সমস্যা হচ্ছে। ভুয়ো সার্টিফিকেট চলে আসছে। মুহূর্তের মধ্যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার সুযোগ শেষ হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি।
দেশের বেশিরভাগ মানুষকে দ্রুত টিকা দেওয়ার জন্য যা করণীয়, সেটা মোদি সরকার করেনি। যে পদ্ধতিতে ভারতে গণ টিকাকরণ হয়ে এসেছে, অর্থাৎ এলাকায় এলাকায় শিবির করে বা বিশেষ ক্ষেত্রে বাড়ি বাড়ি গিয়ে, সেই ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়ে বিজেপি টিকাকে অবস্থাপন্নদের লটারি বানিয়ে ছেড়েছে।
অবশ্য এটাও ঠিক যে, বড়লোকদের জন্য যদি কিছু বাড়তি সুবিধা না থাকে, তাহলে এটা আর পুঁজিবাদ থাকে না। আইনপ্রণেতারা ভ্যাকসিন নির্মাতাদের নির্দেশ দিয়েছে, ৫০ শতাংশ ভ্যাকসিন ডোজ পিছু ১৫০ টাকা দরে কেন্দ্রীয় সরকারকে সরবরাহ করতে আর বাকি ভ্যাকসিনগুলি যেকোনো মুল্যে বেসরকারি হাসপাতাল ও রাজ্য সরকারগুলিকে সরবরাহ করতে।
কেন্দ্রের এই নীতি স্বাভাবিক ভাবেই টিকার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারি হাসপাতেল বিনা পয়সায় টিকা মিললেও মনে রাখা দরকার দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বেসরকারি ক্ষেত্রে চিকিৎসা করান। সেখানে টিকার জন্য যথেষ্ট টাকা নেওয়া হচ্ছে। মহামারি শুরু হওয়ার পর প্রথম মাসে সিরাম ইনস্টিটিউটের মালিক আদার পুনাওয়ালার যা সম্পত্তি ছিল, সেটা বর্তমানে ৮৫ গুন বেড়ে গেছে। স্বাভাবিক।
ভারতের মতো বিশাল জনসংখ্যার গরিব দেশে টিকাকরণের জন্য কুশলী পরিকল্পনার প্রয়োজন। সকলকে বিনা পয়সায় টিকা দেওয়াও দরকার। ঠিক করা দরকার, সমাজের কোন অংশকে আগে টিকা দিতে হবে। সে সব না করে, টিকার যোগানের ব্যবস্থা না করে, ভোটের বাজারে ভাবমূর্তি সামলাতে মোদি ঘোষণা করে দেন, ১৮ বছরের উপরে সকল ভারতবাসী টিকা পেতে পারেন। জঘন্য পরিকল্পনা ছাড়া কী বলা যায় একে!
টিকাকরণের বদলে কোনো সামরিক অভিযান করার প্রশ্ন এলে মোদি সরকার দিব্যি যাবতীয় শক্তি খরচ করে সে সব করবে। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এদেশে বিপুল টাকা খরচ করে সাধারণ নির্বাচন হতে পারে অথচ গরিব মানুষের জন্য টিকা দিতে যত সমস্যা।
এটা ঠিক যে আগামী কয়েক মাসে দেশে টিকা উৎপাদন বাড়বে। মোদি সরকার উৎপাদকদের ৪০ কোটি ডলার ভরতুকি দিয়েছে। পাশাপাশি জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য বিদেশ থেকে টিকা কেনারও অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। কোভিডে মৃত মানুষের সংখ্যা নিয়মিতই বাড়ছে। আর ব্যাপক গরিব মানুষ কবে টিকা পাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।