Home খবর বাংলাদেশ: কতৃপক্ষের নিপীড়নের মুখে তীব্র প্রতিরোধ শ্রমিকদের

বাংলাদেশ: কতৃপক্ষের নিপীড়নের মুখে তীব্র প্রতিরোধ শ্রমিকদের

বাংলাদেশ: কতৃপক্ষের নিপীড়নের মুখে তীব্র প্রতিরোধ শ্রমিকদের
0

পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: সারা দেশ কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিধ্বস্ত হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণির দুর্দশার আরও বাড়ছে। পরিস্থিতি এখনও ভারতের মতো জায়গায় পৌঁছায়নি, তবে খুব শীঘ্রই এটি এমন পর্যায় যেতে চলেছে কারণ সে দেশের সরকার দারিদ্র সীমায় থাকা লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের মৌলিক স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং ভ্যাকসিন সরব্রাহের জন্য কোনো পদক্ষেপ করেনি।

সর্বোপরি, রাষ্ট্র্রের পুলিশি ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে শ্রমিক শ্রেণির উপর পুঁজিপতিদের হামলা ও তাদের উপর জরিমানা চাপানো, সাম্প্রতিক কালে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। মজুরি, কাজের পরিবেশ এবং অন্যান্য অনেক মৌলিক চাহিদার উপর হামলার প্রতিবাদে সাম্প্রতিক মাসগুলিতে সারা দেশে প্রচুর বিক্ষোভ সংগঠিত হয়, যেগুলি পুলিশ নির্মম ভাবে দমন করে।

শ্রমিকদের উপর সরাসরি রাবার বুলেট চার্জ করা হয়, নির্মমভাবে লাঠিপেটা করা হয় ও মিথ্যা মামলায় জেলে বন্দি করা হয় শ্রমিকদের, এমনকি মহিলা শ্রমিক ও গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রেও একই আচরণ করা হয়েছে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামি লিগ সরকার মনে করছে এ জাতীয় নির্মম অত্যাচার করে মতবিরোধকে চূর্ণ করতে পারবে। এটা তারা মারাত্মক ভুল করছেন। এগুলো শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের পুঁজির শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শ্রমিক ও যুবদের একটি গণ-সংগ্রামে পরিণত হবে।

বিশ্বের বুর্জোয়া মিডিয়াতে বাংলাদেশকে একটি উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে দেখানো হয়েছে, এবং পুঁজিপতিদের, বিনিয়োগকারীদের উজ্জ্বল ভাবে দেখানো হয়েছে। এই চকচকে ছবি সত্ত্বেও, বাংলাদেশের শ্রমিকরা বেকারত্ব ও দারিদ্রের   অন্ধকারে বাস করেন এবং এই ধ্বংসাত্মক মহামারির ফলে সেই অবস্তা আরও খারাপ দিকে যাচ্ছে, যা শত শত মানুষকে হত্যা করছে।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে গত ১৫-২০ দিনে এক হাজারেরও বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ও মোট মৃত্যুসংখ্যা ১২,০০০-এ পৌঁছেছে। তবে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ এবং আরও শতাধিক মৃত্যুর খবর চেপে যাওয়া হয়েছে। সরকার  লকডাউন জারি করা সত্ত্বেও, যা লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের বেকারত্বের ও অনাহারের কারণ হয় দাঁড়িয়েছে, মহামারি এখনও নিয়ন্ত্রণে নেই এবং আরও হাজার হাজার মানুষ শাসক শ্রেণির উদাসীনতার কারনে মারা যেতে পারে।

বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এপ্রিল মাসে দেশব্যাপী পুরো লকডাউন ঘোষণা করে, তারা শ্রমিক ও তাদের পরিবারগুলির মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। তারা ক্ষুধার্ত এবং ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মারা যায় লকডাউন ঘোষণার পরে। সরকার এটিকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়।স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা মতো কোনো এলাকায় এটি প্রয়োগ করা হয়। যদিও ২০২১-এর বই মেলা বন্ধ ছিল না, আংশিক খোলা ছিল। শুধু বন্ধ ছিল পরিবহন ব্যবস্থা।

মহামারির মধ্যেও শ্রমিকদের সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়েছে। ওভারটাইমও করতে হয়েছে। রোজার মাসে অনাহারেও তারা কাজ চালিয়ে গেছেন।  রাষ্ট্র যদি তাদের স্বার্থের প্রতি বিন্দুমাত্র সংবেদনশীল হত, তাহলে তাদের সবেতন ছুটি দিত। কিন্তু মহামারি, তাদের আর্থিক অবস্থা এতই খারাপ করে দিয়েছে য়ে শ্রমিকরা যে কোনো শর্তে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।  তাদের ওপর শোষণ বহুগুন বেড়ে গেছে।

বাঁশখালি পাওয়ার প্ল্যান্ট (এস আলম)

১৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের বাঁশখালির এস আলম গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিক্ষোভকারী শ্রমিকদের উপর পুলিশ গুলি চালালে পাঁচ শ্রমিক মারা যায় ও কমপক্ষে ১০০ জন আহত হয়। এই শ্রমিকরা বকেয়া বেতন পরিশোধ, বেতন বৃদ্ধি, শুক্রবারের কাজের সময় হ্রাস এবং ইফতারের জন্য উপযুক্ত সময় বরাদ্দর দাবি নিয়ে লড়ছিলেন।

শ্রমিকরা এই চারটি দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশ তাদের ওপর হামলা করে। পুলিশ বাঁশখালি-আনোয়ারা সড়কের বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট স্থাপন করেছিল এবং পাঁচ শ্রমিককে খুন করার পরে বাকি শ্রমিকদের জোর করে কাজ করতে বাধ্য করা হয়।

বিক্ষোভকারী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ২টি ভুয়ো মামলা দায়ের করে পুলিশ এবং এলাকার ৩,৫২৬ জন শ্রমিককে এই মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। কোনো পুলিশ বা কয়লা কেন্দ্রের কোনো মাতব্বর এই মামলায় অভিযুক্ত হয়নি, এর থেকেই বোঝা যায় যে বাংলাদেশে নির্মম পুলিশ রাজ বিরাজ করছে।

এই কয়লা কেন্দ্রের মালিক এস আলম শেখ হাসিনার খুব কাছের মানুষ এবং গত দশকে তার ধনসম্পত্তি বিপুল বেড়েছে। শাসকদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাকে দায়মুক্ত  থাকার এবং শ্রমিকদের আক্রমণ ও হত্যা এবং তাদের রক্তের শেষ ফোঁটা পর্যন্ত তাদের শোষণ করার অন্তহীন ক্ষমতা দিয়েছে। তার সব অপরাধই নজরের আড়ালে থেকে যায়। তার অনিয়ম ও দুর্নীতি, স্বৈরাচার এবং স্বেচ্ছাচারিতা, শ্রমিক হত্যা, বস্তি উচ্ছেদ ইত্যাদি দেখে স্পট বোঝা যায় বাংলাদেশে পুঁজিপতিরা কীভাবে ক্ষমতায় থাকা সুযোগ নিয়ে চলেছে।

২০১৬ সালে চিনা কম্পানির অংশীদারিত্বে তৈরি এই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য অধিগ্রহণ করা জমি থেকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সময় পুলিশ পাঁচ জন স্থানীয়কে হত্যা করেছিল। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য এখনও কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি এবং এখন একই ব্যবসায়িক গোষ্ঠী আরও পাঁচজন শ্রমিককে খুন করল।

খুলনার খালিশপুরে শ্রমিকদের উপর হামলা

সরকারি পাট কল বেসরকারিকরণ করার বিরুদ্ধে খুলনার বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ, বিক্ষোভ হয়েছে। শিল্পাঞ্চলগুলিতে শ্রমিকদের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রন করারা জন্য মোতায়েন করা  হয়েছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ। তাদের কাজ হল ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিকদের জমায়েতকে সীমাবদ্ধ রাখা, নিয়মিত শ্রমিক নেতাদের গ্রেফতার করা, শ্রমিকদের লাঠিপেটা করা এবং নিরস্ত্র শ্রমিকের বিরুদ্ধে রাবার বুলেট এবং টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করা। এটি গত দুই মাসের নিয়মিত চলেছে। সে সময় শ্রমিকরা ইদের আগে মজুরি দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল।

৮ মে শ্রমিকরা ইফতারের আয়োজন করেন রোজা ভাঙ্গার জন্য এবং এটি একটি প্রতিবাদের আকার ধারণ করে। তারা দীর্ঘদিন ধরে ইফতারের জন্য বেশি সময়ের বিরতি দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে । মালিকের কথা শুনে পুলিশ এই শ্রমিকদের উপর আক্রমণ করে বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করার জন্য, এর মধ্যে আক্রান্ত হন মহিলা শ্রমিকরা, তাদের মধ্যে কিছু গর্ভবতী মহিলাও ছিলেন যাদের পুলিশ রেয়াত করেনি।

জঙ্গি নেতৃত্বের অভাব ও সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়নের সেভাবে সমর্থন না থাকায় পুলিশ আরও একবার এই ধরনের নৃশংসতা চালিয়েও পার পেয়ে যায়।

হা-মিম গ্রুপ দ্বারা টঙ্গি শ্রমিকদের উপর হামলা

গাজিপুর জেলার কাপড় কলের শ্রমিকরা ১০ মে তাদের ঈদের ছুটি বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করছিলেন। প্রতিবাদ চলাকালীন তারা ঢাকা-মহানগর হাইওয়ে অবরোধ করেন। বিক্ষোভ জঙ্গি আকার ধারণ করতেই পুলিশ রাবার বুলেট ছোঁড়ে। ২০ জনেরও বেশি শ্রমিক গুরুতর আহত হন, তাদের আশেপাশের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

এই ঘটনাগুলিকে মিডিয়া ভুল ভাবে পরিবেশন করছে, যা একেবারেই শাসক ও আওয়ামি লিগের পক্ষে কাজ হচ্ছে। জনতার সংবাদমাধ্যম বা গণমাধ্যমের কাছে এতো অল্প তথ্য রয়েছে যে সাধারণ মানুষদের পক্ষে শ্রমিকদের সংগ্রাম সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। শ্রমিকদের বকেয়া বেতন, সন্ধের বিরতি ও ছুটি বাড়ানোর দাবিকে এই শ্রমিকবিরোধী মিডিয়া ‘অত্যাধিক চাহিদা’ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রচার করছে।

এরই মধ্যে হা-মিম গ্রুপের মালিক একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি যিনি প্রায়শই বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের  আইকন হিসেবে চিত্রিত হন। শ্রমিকদের জন্য এ এক অপমান ছাড়া কিছু নয়।

ট্রেড ইউনিয়নগুলির পরিস্থিতি

বাংলাদেশের বড়ো ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলি সস্তা শ্রমিক ভয়ংকর ভাবে শোষণ করে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে যদি শ্রমিকরা ট্রেডইউনিয়নে যোগ দেয়। তবে, তাদের হুমকি দেওয়া হয়। গুন্ডা দিয়ে মার খাওয়ানো হয়। শ্রমিক নেতাদের ওপরও আক্রমণ নামে। তাদের প্রায়ই গ্রেফতার করা হয়। তাদের ওপর ভুয়ো মামলা দেওয়া হয়। আইনি লড়াইতে শ্রমিকদের জেতা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এত কিছুর পরেও যদি আন্দোলন চলে, তাহলে পুলিশ ও গুন্ডারা মিলিত ভাবে শ্রমিক নেতাদের খুন পর্যন্ত করে। অনেকেই মনে করেন ‘ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইনটেলিজেন্স’ নামে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ, এই খুনগুলির সঙ্গে জড়িত থাকে।

এতরকম ভাবে ভয় দেখানো ও নিপীড়ন সত্ত্বেও বাংলাদেশে নিয়মিত শ্রমিক বিক্ষোভ এবং আন্দোলন চলছে।

বাংলাদেশে যে সংসদীয় বামপন্থী দলগুলি রয়েছে, শ্রমিকদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাদের কোনো নির্দিষ্ট কর্মসূচি নেই। বেশিরভাগ ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা বিপ্লবী পথ থেকে বিদায় নিয়েছেন এবং বাস্তবে অনেক ইউনিয়নই ক্ষমতাসীন দলের এজেন্টদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাদের মূল লক্ষ্য, ম্যানেজমেন্টের সাথে দল কষাকষি করে নিজেদের পকেট ভরা।।

অভিবাসী শ্রমিকরা

সরকারী তথ্য মতে কোভিড-১৯ মহামারিজনিত কারণে ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় ৩৭,৬০,০০০ প্রবাসী শ্রমিক বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এই শ্রমিক এবং তাদের পরিবার সবাই সরকারি সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। ফিরে আসা অভিবাসী শ্রমিকরা বাধ্য সংসার চালানোর জন্য ঋণ নিচ্ছেন এবং ক্রমেই ঞণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন।

ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে অভিবাসী কর্মীরা ঋণের বোঝা এবং সমাজে সুস্থ ভাবে জীবন কাটানোর জন্য  কতটা সহ্য করছেন।  একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ৬৯ শতাংশ ফিরে আসা শ্রমিক এবং তাদের পরিবার ঋণে জড়িয়ে রয়েছেন।  এই শ্রমিকদের ২৮ শতাংশের ঋণ রয়েছে ২ লাখ টাকার বেশি এবং ৫০ শতাংশেরও বেশি শ্রমিক  ১ লক্ষ টাকারও টাকারও বেশি ঋণে জড়িয়ে রয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও প্রকাশিত হয়েছে যে ৮৪ শতাংশ অভিবাসী শ্রমিক বর্তমানে বেকার।

বাংলাদেশের শাসক আওয়ামি লিগ পার্টিকে চালায় গুটি কয়েক শিল্পপতি ব্যক্তি ও গোষ্ঠী। নিজেদেরকে মুক্তি যুদ্ধের প্রকৃত উত্তরাধিকারী দাবি করে, তারা এক অগণতান্ত্রিক শাসন চালিয়ে যাচ্ছে। বিরোধী শক্তি দুর্বল। যে কোনো প্রগতিশীল কণ্ঠ ও আন্দোলনকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে মেহনতি মানুষ চুপ করে নেই। যে কোনো দিনই তাদের ক্ষোভের বিশাল আকার ধারণ করবে। সে দেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব এই ৭ওভকে সঠিক রাজনৈতিক লাইন অনুযায়ী সমাজ বদলের লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *