চলমান কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় বাজেটে কৃষকদের জন্য কী ঘোষণা করা হবে তা নিয়ে আগ্রহ ছিল সবমহলেই। বাজেট ঘোষণাপর্বে মাননীয়া অর্থমন্ত্রী ১১ বার ‘কৃষক ‘ শব্দটি উচ্চারণ করেন, বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানান এই বাজেটের হৃদয় হচ্ছেন কৃষকরা। আর অন্যদিকে সংগ্রামরত কৃষকরা বাজেটের পর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বাজেটে কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। এই পরস্পর বিরোধী দাবির মধ্যে প্রকৃত সত্যটা কী তা আমরা তথ্য ও প্রমাণের আলোকে বুঝে নিতে চেষ্টা করব বর্তমান নিবন্ধে।
আমরা শুরু করছি কৃষি ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ নিয়ে। ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে কৃষি ক্ষেত্রে আর্থিক বরাদ্দ ছিল ১,৫৪,৭৭৫ কোটি টাকা, যা ছিল মোট জিডিপির ৫ শতাংশের চেয়ে সামান্য বেশি। ২০২১-২২ আর্থিক বর্ষে কৃষি ক্ষেত্রে বরাদ্দ ১,৪৮,৩০১ কোটি টাকা যা জিডিপির ৪ শতাংশ। অর্থাৎ যে বাজেটের হৃদয় কৃষকরা তাদের ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়লো না বরং কমে গেল। তাই কৃষক নেতৃত্ব কৃষি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায় অস্বীকারের যে ধারাবাহিক ইতিহাসের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন তা অন্তত অঙ্কের বিচারে সত্যি বলে প্রমাণিত হল।
আরও পড়ুন: ব-য়ে বাজেট, ব-য়ে বেচে দে!
আমরা এবার প্রকল্প ভিত্তিক ভাবে আলোচনাটা করতে চাই। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই যে নামটি আসে তা হল প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি( পি এম- কিষান)। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন ফসলের ন্যায্য দামের জন্য কৃষকদের আন্দোলনে সারা দেশ উত্তাল তখন ঠিক নির্বাচনের আগে বহু ঢাক – ঢোল পিটিয়ে এই প্রকল্প চালু করা হয়। এই প্রকল্পে কৃষকদের সামান্য কিছু আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার জন্য বছরে ৬০০০টাকা ( তিনটি কিস্তিতে) দেওয়া হয়। বিগত বছরে এই ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা হয়েছিল ৭৫,০০০ কোটি টাকা, যা ছিল মোট কৃষি বরাদ্দের ৫৩ শতাংশ। এবার এই খাতে বরাদ্দ এক ধাক্কায় ১০,০০০ কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারের আরেকটি ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প হল ‘ interest subsidy on short term credit to farmers’। সোজা কথায় স্বল্প মেয়াদি কৃষি ঋণের সুদের ক্ষেত্রে সরকারি ভর্তুকি দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ২০২০-২১ বর্ষে বরাদ্দ ছিল ২১,১৭৫ কোটি টাকা যা বর্তমান বছরে হল ১৯,৪৬৮ কোটি টাকা, এখানেও সেই কমিয়ে দেওয়ার গল্প। দানাশস্য বিতরণের বাজেটও গতবছরের ৮০০ কোটি টাকা থেকে হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিচাই যোজনা( সেচ ব্যবস্থা) এবং প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার ব্যয়বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোন ইতরবিশেষ ঘটেনি। এমনকি বিমা যোজনায় কৃষক ও সরকারের বিমা প্রিমিয়াম লুটে নেওয়া ও কৃষকদের প্রাপ্য মিটিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিমা কোম্পানিগুলির গাফিলতির প্রশ্নে কোনো সুরক্ষা কবচের ব্যবস্থা করা হয়নি।
একথা সবার জানা যে আন্দোলনরত কৃষকদের একটি অন্যতম প্রধান দাবি ফসলের নূন্যতম সহায়ক মূল্য ( এম এস পি) যা স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ মেনে দিতে হবে ও তার জন্য আইনি ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার সে দাবি মেনে নিতে বাধ্য হবে কি না তা আগামী সময় বলবে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত দামের ব্যপারে সরকারের যেটুকু দায় আছে সেখানেও দায় কমানোর গল্প জারি আছে। এক্ষেত্রে প্রথম প্রকল্পটির নাম ‘ প্রধানমন্ত্রী অন্নদাতা আয় সংরক্ষণ যোজনা’ ( পি এম আশা)। ২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষে যা ছিল ১৫০০ কোটি টাকা,২০২০-২১ এ ৫০০ কোটি টাকা এবার আরও কমে হল ৪০০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় প্রকল্পের নাম MIS- PSS( market intervention and price support scheme)। এখানে ২০১৯-২০ বর্ষে ৩০০০ কোটি টাকা, ২০২০-২১ এ ২০০০ কোটি টাকা যা এবার হল ১৫০০ কোটি টাকা। অথচ কৃষক সংগঠনগুলির দাবি ফসলের ন্যূনতম দাম না পাওয়ার জন্য বছরে কৃষকদের ক্ষতির পরিমাণ ৫০,০০০ কোটি টাকা।
বাজেটের সংখ্যাতত্ত্ব আলোচনার সময় একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন, বাজেটে যে টাকা বরাদ্দ করা হয় আর প্রকৃত যে টাকা খরচ হয় ( সংশোধিত বাজেট) তার মধ্যে প্রায়শই পার্থক্য হয়। কৃষি ক্ষেত্রে ধারাবাহিক ভাবে দেখা যাচ্ছে বছরের শুরুতে যে বাজেট বরাদ্দ করা হল সংশোধিত বাজেটে তা কমে গেল। এক্ষেত্রে গত বছরের অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। ২০২০-২১ সালে কৃষি বরাদ্দ ছিল ১,৫৪,৭৭৫ কোটি টাকা কিন্তু খরচ হয় ১,৪৫,৩৫৫ কোটি টাকা। কৃষি সিচাই যোজনাতে ব্যয় বরাদ্দের ১১,১২৭ কোটি টাকার মধ্যে ৭,৯৫৪ কোটি, সবুজ বিপ্লব প্রকল্পে ১৩,৩২০ কোটির মধ্যে ১০,৪৭৪ কোটি, এম আই এস-পি এস এস প্রকল্পে ২০০০ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ৯৯৬ কোটি টাকা।
বর্তমান বাজেটে পরিকাঠামো উন্নয়নকে সরকার পাখির চোখ করেছে। কৃষিক্ষেত্রও তার থেকে বাদ পড়েনি। কৃষি পরিকাঠামো তৈরির জন্য এক লক্ষ কোটি টাকার তহবিল গড়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু আদতে এই টাকা দিতে হবে দেশের আমজনতাকে কারণ এই তহবিল গড়তে পেট্রোলে আড়াই টাকা প্রতি লিটার ও ডিজেলে চার টাকা প্রতি লিটার সেস বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই পরিকাঠামো সংক্রান্ত ব্যয় বরাদ্দের ঘোষণাটাও যথেষ্ট গোলমেলে। সবার মনে থাকতে পারে যে কোভিড অতিমারির সময় সরকার গরিব মানুষের হাতে এক টাকা নগদ না দিলেও বিভিন্ন প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল যার একটিতে কৃষি পরিকাঠামো সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে গোটা বিষয়টা মৌখিক ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। আর্থিক সমীক্ষায় ( ভলুম ২,অধ্যায় ৭) পরিষ্কার বলা হয়েছে এগ্রিকালচার ইনফাস্ট্রাকচার ফান্ডের ঘোষিত ১ লক্ষ কোটি টাকা ও অ্যানিম্যাল হাসবেনড্রি ইনফাস্ট্রাকচার ফান্ডের ১৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ১ টাকাও খরচ হয়নি। একমাত্র প্রাইমারি এগ্রিকালচার সোসাইটিগুলির জন্য ২৯৯১ কোটি টাকা নীতিগত ভাবে বরাদ্দ হয়েছে। এই হিসাব পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিচ্ছে অতিমারির সেই সংকটময় দিনে কৃষকদের উন্নতির জন্য বিভিন্ন ফান্ড ঘোষণা ছিল শূন্যগর্ভ আস্ফালন।
একথা সবাই স্বীকার করতে বাধ্য যে কোভিড অতিমারির সময় লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক বেঁচে থাকার জন্য গ্রামে ফিরতে বাধ্য হয়েছিল এবং সেই মানুষদের জন্য কার্যকর হয়েছিল নরেন্দ্র মোদি কতৃক উপহাসিত একশ দিনের গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা যোজনা ( মোদির ভাষায় গর্ত খোঁড়ার প্রকল্প)।এই কঠিন সময়ে গ্রাম ভারতে পরিকাঠামো উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, বাজারে চাহিদা বৃদ্ধির জন্য সরকার বাধ্য হয়েছিল ১,১১,৫০০ কোটি টাকা খরচ করতে,বাজেটে যা বরাদ্দ ছিল ৬১,৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু এই বাজেটে একশ দিনের রোজগার যোজনায় বরাদ্দ মাত্র ৭৩,০০০ কোটি টাকা যা গত বছরে প্রকৃত বরাদ্দের চেয়ে এক তৃতীয়াংশ কম। গরিব মানুষদের বাঁচিয়ে রাখতে বিগত আর্থিক বর্ষে খাদ্য নিরাপত্তা আইনে বরাদ্দ হয়েছিল ৭৮,০০০ কোটি টাকা। কিন্তু প্রয়োজন বুঝে সরকার ৩,৩৪,০০০ কোটি টাকা খরচ করেছিল। কিন্তু এবার বরাদ্দ হল ২,০০,০০০ কোটি টাকা। খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে বাজেট হ্রাস ও একশ দিনের রোজগার যোজনায় বরাদ্দ কমানো গ্রাম ভারতকে আরও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে।
শেষ বিচারে এই বাজেটে কৃষকের হাতে পেন্সিল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকলো না। এই বাজেট আসলে কৃষি আইন যা কৃষি ব্যবস্থার কর্পোরেটকরণের রোডম্যাপ তার সঙ্গে পরিপূরক। অন্নদাতারা সেই বিষয়টা সঠিক ভাবে উপলব্ধি করেছেন বলেই আজ তারা ইতিহাস গড়তে নেমেছেন।