লক্ষণগুলো পরিষ্কার হচ্ছিল। বাজেট অধিবেশনের আগে যেভাবে কর্পোরেট বা বাজারমুখী কৃষি আইনের বিরুদ্ধে লড়াইরত কৃষক অবস্থানের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনছিল। তাতে এই অনুমান জোরালো হচ্ছিল যে এবারের বাজেট খোলাখুলি কর্পোরেটের পক্ষে দাঁড়াবে। সরকার চায় না সেই কর্পোরেটমুখী বাজেটের বিরুদ্ধে সারা দেশের সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ আর কৃষি আইন বিরোধী কৃষক বিক্ষোভ একসূত্রে মিশে যাক, তাই বিক্ষোভ শেষ করতে সরকার এত মরিয়া। অনুমান সত্য হল।
নোটবন্দি তারপর জিএসটি এবং শেষে দেশজোড়া লকডাউন- এই তিনটে পদক্ষেপ দেশের অর্থনীতির ওপর ভয়ঙ্কর আঘাত এনেছে। এই আঘাত সবচেয়ে বেশি পড়েছে শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, ছোটো ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র উৎপাদকদের ওপর। এদের একটা বড়ো অংশ কাজ হারিয়েছেন। কপর্দকহীন হয়েছেন, বহু মানুষের বেতনে, উপার্জনে ছাঁটাই হয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত হয়েছেন। অর্থনীতি মন্দায় পড়ে্ছে।
এর থেকে বেরিয়ে আসার উপায় হিসেবে বহু অর্থনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষ চেয়েছিলেন, সরকার এইসব মানুষদের কাছে সরাসরি অর্থ পৌঁছে দিক। কিন্তু সেদিকে না হেঁটে কেন্দ্রীয় সরকার হেঁটেছে যাতে কর্পোরেট দেশিবিদেশি বৃহৎ পুঁজিপতি লাভবান হয়, সেই রাস্তায়। কর্পোরেট ট্যাক্স ছাঁটাই, জলের দরে সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান বেচে দেওয়া, কৃষি আইন এনে কৃষি পণ্যের বাজারে কর্পোরেটকে আধিপত্য করার সুযোগ দেওয়া, শ্রম কোড চালু করে শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করা, তাতেই নাকি কর্পোরেট উজ্জীবিত হয়ে আরও আরও বিনিয়োগ করবে আর ওই পথেই দেশের বিকাশ হবে। এই হচ্ছে মোদি সরকারের অর্থনীতি।
এবারের বাজেটও একই ধারাবাহিকতার ফসল। সরকার ঘোষণা করেছে চারটি ক্ষেত্র ছাড়া কোনো সরকারি ক্ষেত্রই রাখা হবে না। দুটি ব্যাঙ্ক, একটি সাধারণ বিমা সংস্থা এ বছরই বিক্রি করা হবে। এলআইসি-র বেসরকারিকরণ শুরু করা হবে, রেল বন্দর, বিমা সড়ক খনি গ্যাস বাদ থাকবে না কিছুই।
এই মোদি সরকার ২০১৯-এ কর্পোরেট ট্যাক্সে বিপুল ছাড়দিয়েছিল। যার মোট পরিমাণ প্রায় ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। বলা হয়েছিল, এতে কর্পোরেটরা আরও বিনিয়োগ করবে, ফলে চাকরিবাকরি কর্মসংস্থান বাড়বে। অথচ যত দিন গিয়েছে, এই আশা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। সাধারণের উপকার হওয়া ছেড়েই দেওয়া যাক, না বেড়েছে বিদেশি বিনিয়োগ, না বেড়েছে দেশি বিনিয়োগ। লাভবান হয়েছে মূলত ৪,৬৯৮টি সংস্থা যাদের বার্ষিক টার্নওভার ৪০০ কোটি টাকার ওপরে।
পাঠকের মনে থাকবে, কর্পোরেট ট্যাক্সের ছাড়ের এই ঘোষণার কয়েকদিন আগেই কেন্দ্র রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উদ্বৃত্ত রিজার্ভ থেকে ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি নিজেদের পকেটে নিয়েছিল। আর কর্পোরেট ট্যাক্স ছাড়ের পরপরই কেন্দ্র ঘোষণা করে, সে সরকারি সংস্থা বেচে আয় করবে ২০ হাজার কোটি টাকা। এই তিনটে জিনিসকে একসাথে ধরলে যা দাঁড়ায় তা হল, রিজার্ভ ব্যাঙ্কে জনগণের ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে নাও সরকারের হাতে, তার মধ্যে থেকে কর্পোরেট ট্যাক্স ছা়ড়ের মাধ্যমে কর্পোরেটের হাতে দিয়ে দাও ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যাতে সেই টাকার একটা অংশ দিয়েই জনগণের টাকায় তৈরি সরকারি সংস্থা তারা কিনে নিতে পারে। কর্পোরেটের পক্ষে এত খুল্লমখুল্লা পদক্ষেপ এর আগে ভারতবর্ষে হয়নি।
কিন্তু তাতেও যে কর্পোরেটের চিঁড়ে ভেজেনি, তা পরিষ্কার হয় যখন আবারও সরকারকে নিজের ঘর হাট করে খুলে সব বিক্রির আহ্বান দিতে হয়।
স্বাস্থ্য খাতে যে বৃদ্ধির হিসেব দেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে ৩৫ হাজার কোটি টাকা যাবে ভ্যাকসিন প্রয়োগের জন্য। যার কার্যকারিতা এখনও সন্দেহাতীত নয়। বাকি বড়ো অংশ যাবে তথাকথিত আত্মনির্ভর স্বাস্থ্য প্রকল্পের নামে বেসরকারি সংস্থাকে উৎসাহ দানের জন্য। অথচ করোনাভাইরাস সংকট দেখিয়ে দিয়েছে, স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে বেসরকারি ক্ষেত্র পুরোপুরি ব্যর্থ, বারংবার দাবি উঠেছে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে সরকার তেলের দাম বাড়ায়, অথচ বলা হয়েছিল বাজারের দামের সঙ্গে যুক্ত হলে নাকি জনসাধারণের লাভ হবে, এবারকার বাজেটেও আবার সেস বসাচ্ছে কেন্দ্র, এর ফল কী হবে সবার জানা।
ব-য়ে বাজেট, ব-য়ে বেচে দে।
এই সরকারের কৃষি আইন যে কর্পোরেটমুখী হবে, তাতে আর সন্দেহ কী! যারা ‘মানুষের জন্য কাজ’ করার জন্য নাকি বিজেপিতে যাচ্ছেন, তারা যে দেশের জনসাধারণকে মূর্খ, হাঁদা ভাবেন, তাতে সন্দেহ নেই। প্রশ্ন একটাই। এদের বুলিতে বিশ্বাস করে আমরা দুহাত তুলে জয় কর্পোরেট, জয় শ্রীরাম বলে নেত্য করবো, নাকি দিল্লির ঠান্ডায় লড়াইরত কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তুলবো- “কর্পোরেট রাজ দূর হঠো”!
প্রচ্ছদ সৌজন্য: ইডি টাইমস
সূত্র: https://scroll.in/article/961662/why-india-needs-to-rethink-its-corporate-tax-cut