আশির দশকের সূচনালগ্নে ‘ অনুসন্ধান ‘ নামে এক দ্বিভাষিক সিনেমা এ বঙ্গে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই সিনেমার তুঙ্গ মুহূর্তে খলনায়ক কালিরামের ঢোলটি ফেঁসে যায়, সঙ্গে ফেঁসে যায় তার গুমোর ও মিথ্যার ফানুস। আজকাল ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক হাল- হকিকতের প্রমাণস্বরুপ যে সমস্ত হীরকখণ্ড আমাদের সামনে আসছে তা সিনেমার সেই কালিরামের কথা বারবার মনে করাচ্ছে। ৫৬ ইঞ্চি ছাতি বিশিষ্ট, হিন্দু হৃদয় সম্রাট, সুপারম্যান প্রধানমন্ত্রীর অমৃত ভাষণ,ভক্তবৃন্দের থালা বাজিয়ে নাচন- কোঁদন,আইটি সেলের মিথ্যা প্রচারকে সরিয়ে বেরিয়ে আসছে দেশের কঙ্কাল সার চেহারা, শত আচ্ছে দিনের রঙচঙে বিজ্ঞাপন সেই ছবিকে আড়াল করতে পারছে না।
এই হীরকখন্ডগুলোর সাম্প্রতিক নমুনাটি হল আই এম এফের আর্থিক রিপোর্ট, যেখানে পরিষ্কার বলা হয়েছে ২০২০ সালে ভারতের জিডিপি (-)১০.৩০% হারে সংকুচিত হবে। এই পূর্বাভাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হল আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের ( যারা অর্থনীতি ও সম্পদের বিচারে ভারতের তুলনায় নেহাৎই এক ক্ষুদ্র দেশ) জিডিপি বৃদ্ধি পাবে (+) ৩.৮%। আর শয়নে,স্বপনে, জাগরণে যাদের আমরা নিত্যদিন মুন্ডুপাত করে চলেছি সেই গণ প্রজাতন্ত্রী চিনের অর্থনীতিও বৃদ্ধির মুখ দেখবে। আই এম এফের বয়ান অনুযায়ী তাদের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ১.৯%। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করছে যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘ মন কি বাত’ যাই হোক না কেন,করোনা পরবর্তী পর্যায়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত পৃথিবীর মধ্যে সবার আগে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে — এই প্রচার এক নির্ভেজাল ধাপ্পাবাজি (অনেকটা ভোটে জিতলে প্রত্যেক নাগরিকের অ্যাকাউন্টে কয়েক লক্ষ টাকা ঢুকে যাবে মার্কা জুমলাবাজি)।
অনেকে করোনার প্রশ্নটি তুলতে পারেন কিন্তু তাতেও হালে পাণি পাওয়া যাবে না। এ ব্যাপারে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক ও কেন্দ্রের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু রীতিমত ছক বানিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন নির্বোধ আর্থিক নীতি ও অপরিকল্পিত লকডাউন ভারতের অর্থনীতিকে কীভাবে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। যেমন ভারতের ক্ষেত্রে জিডিপি সংকোচনের পরিমাণ ১০.৩%, আবার প্রতি ১০ লক্ষ মানুষ পিছু করোনাতে মৃতের সংখ্যা ৮৩। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৩.৮% আর ১০ লক্ষ মানুষ পিছু করোনাতে মৃতের সংখ্যা ৩৪। সোজা কথাটা হল করোনাকে নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও বাংলাদেশ ভারতের থেকে কয়েককদম এগিয়ে আছে। যে উপমহাদেশে নিজেদের বিগ ব্রাদার বলে আমরা অহরহ জানান দিই, সেখানে আমাদের সমস্ত প্রতিবেশী দেশ অর্থনীতি ও করোনা মোকাবিলায় ভারতের চেয়ে ভালো ফল করেছে। পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি -০.০৪%,১০ লক্ষ মানুষ পিছু করোনাতে মৃতের সংখ্যা ৩০। নেপাল ও শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে সংখ্যাটা যথাক্রমে ০.০% ও ২৫ এবং -৪.৬% ও ০.৬। এর পরেও নিজেদের সুপার পাওয়ার হিসাবে ষোষণা করা কি পাগলের প্রলাপ বাক্য নয়?
জিডিপির কথা ভুলে আমরা যদি কিছুক্ষণের জন্য উন্নয়নের (মোদিজি দের ভাষায় সব কা সাথ,সব কা বিকাশ) পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই তাহলে আরও ভয়াবহ ছবি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আশা করি একথার সঙ্গে কেউ দ্বিমত হবেন না যে উন্নয়ন এর প্রথম কথা হল পেট ভরা খাবার। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ( Global hunger index) । পৃথিবীর ১০৭ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৯৪। ভারতের থেকে খারাপ ফল যারা করেছে তাদের মধ্যে রয়েছে রোয়ান্ডা( ৯৭),আফগানিস্তান (৯৯),মোজাম্বিক( ১০৩)এবং চাদ(১০৭)। এই দেশগুলি দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ের শিকার। এক্ষেত্রেও আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলিতে [পাকিস্তান (৮৮),বাংলাদেশ (৭৫),নেপাল(৭৩)] ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা আমাদের চেয়ে কম। এটাও উল্লেখ থাকা দরকার যে ভারতের জনসংখ্যার ১৪% ধারাবাহিক অপুষ্টির শিকার। সদ্য প্রকাশিত শিক্ষা নীতিতে যে দেশ নিজেকেই নিজেকে ‘ বিশ্বগুরু ‘ বলে ঘোষণা করেছে, সে দেশে ৩৭.৪% শিশুদের সার্বিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত। বিষয়টা শুধু ক্ষুধা নয়,যে টুকু খাবার ভারতবাসী পাচ্ছে তার মান নিয়েও সন্দেহের অবকাশ থাকছে। ফুড পলিসি জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্রের তথ্য অনুযায়ী ভারতে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনের পুষ্টিকর খাবার জোটে না। ভয়াবহ অপুষ্টিই তাদের যাবতীয় রোগের কারণ। শুধু তাই নয় গবেষণাপত্রের তথ্য অনুযায়ী, গ্রাম ভারতের মানুষ যদি তাদের আয়ের পুরোটাই খাবারের জন্য খরচ করেন, তাহলেও প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন সবচেয়ে সস্তার খাবার কিনে খেতে পারেন না। এরপরেও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে নির্লজ্জ বক্তিমে বাতাস কাঁপায়।
আর অতিমারি হোক বা সংক্রমণ, তা ঠেকাবার মতো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কি আমাদের দেশে আছে? ভারতে করোনার কারণে ১০ লক্ষ মানুষ পিছু মৃতের হার এত বেশি হওয়ার কারণ স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের সামান্য অংশ ব্যয়। সম্প্রতি অক্সফ্যাম ‘ commitment ti reducing inequality index 2020 ‘ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী সমীক্ষা করা ১৫৩ টি দেশের মধ্যে মাত্র ২৬ টি দেশ পূর্ব প্রতিশ্রুতি মত বাজেটের ১৫% স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করেছে। অত্যন্ত লজ্জাজনক হলেও এটাই সত্য যে ভারতের স্থান এই তালিকায় ১৫৫ কারণ মোদি সরকার স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের ৪ শতাংশের চেয়েও কম খরচ করেছে।
আসলে এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। দেশের মানুষ যখন দু বেলা দু’মুঠো খেতে পাচ্ছে না, চিকিৎসার অভাবে অকালে মারা যাচ্ছে তখন জনগণের করের টাকায় (৮৮৪০ কোটি) প্রধানমন্ত্রী – রাষ্ট্রপতির জন্য কেনা হচ্ছে প্রমোদবিমান। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দিল্লি সৌন্দর্যায়ন প্রকল্প,সাততারা হোটেলের সুবিধা যুক্ত সংসদ ভবন তৈরির প্রকল্প ঘোষণা করা হচ্ছে এই করোনাকালে। ক্রেডিট সুইসের রিপোর্ট অনুযায়ী ৮০ বছরের ইতিহাসে ভারত পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে আয় বৈষম্যের দেশ। একথাও বহু অনালোচিত যে ৪৫ বছরের ইতিহাসে ভারতবর্ষ এমন বেকারত্ব আর কখনো দেখেনি। ২০১৪ সালে সততার প্রতিমূর্তি নরেন্দ্র মোদি দিল্লির তখতে বসার পর ভারতের ব্যাঙ্কগুলিতে তস্কর কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের দৌলতে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬,৬০,০০০ কোটি টাকা। এই সময়ে দারিদ্র্য বেড়েছে ২৩%। এটাই আচ্ছে দিনের ছবি।
আমরা যদি এই ছবিটা পাল্টাতে চাই তবে অবশ্যই কার্য-কারণ সম্পর্ককে অনুধাবন করতে হবে। ভারত রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে এখানে সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ বঞ্চনার শিকার। যদিও প্রথম পর্বে কৃষি, শিল্প, পরিকাঠামো, যোগাযোগ, কর্মসংস্থানে কিছু মাত্রায় রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা ছিল। শ্রমজীবী মানুষ লড়াই করে বহু দাবি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু ৯০’ এর দশকে বিশ্বায়নের নামে যে বাজার সর্বস্ব আর্থিক নীতি বিশ্বব্যাঙ্ক,আইএমএফ-এর মত আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলির চাপে ভারত সরকার গ্রহণ করে তখন থেকেই আমাদের অধোগতি তীব্র হয়। সমস্ত তথ্য একথাই প্রমাণ করে ২০১৪ সাল থেকে নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সাম্রাজ্যবাদ তথা কর্পোরেট পুঁজি নির্ধারিত পলিসি আরও বেশি আক্রমণাত্মক, আরও বেশি শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থবিরোধী। এই নীতিকে বর্জনের লড়াই ছবিটা বদলানোর একমাত্র উপায়।
চমৎকার লেখা!
আরেকটু বিস্তারিত লেখা হলে ভাল হত।