পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: অভূতপূর্ব সংকটের কবলে গোটা পৃথিবী। একদিকে অতিমারি অন্যদিকে বিশ্ব অর্থনীতির ধস, এমন ধস যা আগে কখনও দেখা যায়নি।
বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনীয় কোনো ঘটনা ইতিহাসে নেই। বড়ো জোর কাছাকাছি আসতে পারে ১৪শ শতকের ব্ল্যাক ডেথ মহামারি। ওই মহামারিতে ইউরোপ ও পাশাপাশি অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মারা গিয়েছিল। প্লেগ এমন ভাবে ছড়িয়েছিল যে গোটা ইউরোপ জুড়ে ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় তৈরি হয়। ওই মহামারি ইউরোপের ইতিহাসে স্থায়ী ভূমিকা রেখে গিয়েছে। যদিও সে সময় দুনিয়া এমন বিশ্বায়িত ছিল না। তাই নির্দিষ্ট মহাদেশের ভূখণ্ডেই তা সীমায়িত ছিল।
প্লেগ মহামারি সমাজ ও অর্থনীতিতে বিশাল প্রভাব ফেললেও, রাজতন্ত্রের জোয়ালে পিষ্ট জনসমাজ সে সময় এমনিতেই ক্রোধে ফুটছিল। সামন্ততন্ত্র পতনের অপেক্ষায় দিন গুনছিল। মহামারি তাকে ত্বরাণ্বিত করে মাত্র।
বর্তমান কোভিড অতিমারিতে এখনও পর্যন্ত ব্ল্যাক প্লেগের থেকে অনেক কম মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু এর প্রভাব যথেষ্ট। মন্দার জেরে তৈরি হওয়া গণ আন্দোলন ঠেকাতে সাম্রাজ্যবাদীরা মরিয়া হয়ে অতিমারির নামে লকডাউনের মতো পদ্ধতি সামনে নিয়ে এলেও, এতে মন্দার প্রভাব আরও অনেকগুন বেড়ে গেছে। গত ৩০০ বছরে এত বড়ো সংকট দেখেনি পুঁজিবাদ। করোনা পুঁজিবাদের কফিনে শেষ পেরকে মারার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছে।
অভূতপূর্ব ধস
রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশ্ব খাদ্য প্রকল্প জানিয়েছে দুনিয়ার সাড়ে ২৬ কোটিরও বেশি মানুষের মাথায় অনাহারের খাঁড়া ঝুলছে। পুঁজিবাদের তাবড় তাবড় নীতি নির্ধারকরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। পুঁজিবাদী সরকারগুলো ক্ষতিপূরণ ও আর্থিক সাহায্য দিতে দিতে নিজেরা দেনায় ডুবে গিয়েছে।
এতসব পদক্ষেপ করার পরেও যে সংকট তৈরি হয়েছে, ইতিহাসে তার জুড়ি নেই।২০২০-র দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে মার্কিন জিডিপি বছরের হিসেবে ৩২.৯% কমেছে। এপ্রিল-জুনে জাপানের অর্থনীতি প্রকৃত অর্থে ২৭.৮% কমেছে (যা এর আগে কখনও হয়নি)। ওই সময়কালে ভারতের জিডিপি ২৩.৯% কমেছে(এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি)।২০%-এর বেশি কমেছে ব্রিটিনের জিডিপি।
কোটি কোটি মানুষ কাজ খুইয়েছেন বা খোয়ানোর অপেক্ষায় রয়েছেন অথচ নিউইয়র্ক থেকে টোকিও পর্যন্ত শেয়ার বাজার বেড়েই চলেছে। ফাটকাবাজরা উৎসব করছে। স্টক মার্কেটের এমএসসিআই বিশ্ব সূচক ৬.৬% বেড়েছে আগস্টে। গত ৪৪ বছরে আগস্ট মাসে তা এত কখনও বাড়েনি। বোঝাই যাচ্ছে, বিশ্ব পুঁজিবাদ এখন পুরোপুরি ফাটকাবাজদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। শেয়ার বাজারের সঙ্গে বুনিয়াদি অর্থনীতির কোনো সম্পর্কই নেই।
ধ্বংসের মুখোমুখি
এটা কোনো স্বাভাবিক পুঁজিবাদী সংকট নয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি তার চূড়ান্ত পতনের মুখোমুখি। পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতির কোনো সম্ভাবনা নেই বরং সব লক্ষণ থেকেই স্পষ্ট যে মন্দা চলবে। সংকট থেকে পরিত্রাণের যে ব্যবস্থাই করা হোক, তার মেয়াদ হবে খুবই কম দিনের। এই ব্যবস্থার প্রাণ হল বিনিয়োগ, সেটা বিপুল ভাবে হ্রাস পেয়েছে, কেনাকাটাও তেমন ভাবেই কমে গিয়েছে।
আগের সমস্ত সংকটের মতোই সংকটের ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে শ্রমিক শ্রেণির ওপর। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা ব্যয় সংকোচন ও আক্রমণের পরে আজকের এই পরিস্থিতি ব্যাপক বিরোধিতার জন্ম দিয়েছে। বহুদিন ধরে প্রচারিত হতে থাকা নিরবিচ্ছিন্ন প্রগতির সমস্ত মিথ্যে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে।
পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর আমেরিকা জুড়ে যে বিশাল গণবিক্ষোভ তৈরি হয়, তা থেকে বোঝা যায় জনগণ অভ্যুত্থানের মেজাজে রয়েছেন। গোটা আমেরিকার জনসংখ্যার ১০% ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন। বহু মানুষ তাদের সমর্থন করেন। তারপরেও পুলিশের হাতে ৩ জন কৃষ্ণাঙ্গের মৃত্যু হয়েছে।
দ্য ইকনমিস্ট লিখেছে, “আমেরিকা এক গভীর সংকটে আটকে পড়েছে। নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যেই জয়ী হোক, কোনোকিছুই আর আগের মতো হবে না। এর থেকেই বোঝা যায়, আমরা বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছি”।
বৈপ্লবিক ঘটনার ঘনঘটা
গত বছরের শেষ থেকে শুরু হওয়া লেবাননের গণ বিক্ষোভ এখনও চলছে। তার জেরে আরও একটি সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। এটি একটি বৈপ্লবিক ঘটনা।
এমনকি ইজরায়েলের মতো দেশেও গণ বিক্ষোভ আছড়ে পড়েছে। নেহানিয়াহু সরকারের পদত্যাগ চাইছে সে দেশের জনগণ। নাটকীয় এবং কিছুটা বিতর্কিত ঘটনা ঘটছে বেলারুশে। সে দেশের শ্রমিক শ্রেণি সাধারণ ধর্মঘটের পথে এগিয়ে চলেছে।
সর্বত্র এক দুরারোগ্য দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা চোখে পড়ছে। এমনকি ব্রিটেনেও গত কয়েক মাসে টোরি সরকারের সমর্থনে ধস নেমেছে। সে দেশ এখন কোনো চুক্তি ছাড়াই রাতারাতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছেড়ে বেরনোর পথে এগোচ্ছে। যার পোশাকি নাম ‘নো-ডিল ব্রেক্সিট’। এটা যদি হয়, তাহলে ইইউ-র সঙ্গে ব্রিটেনের কোনো নির্দিষ্ট বাণিজ্যিক চুক্তি থাকবে না এবং গোটা ইউরোপ জুড়ে একটাই বাজারের অস্তিত্বও থাকবে না। এর ফলে শুধু ব্রিটেন নয় গোটা ইউরোপেও বিরাট বিপর্যয় নেমে আসবে। আগামী ৬ মাসে বোঝা যাবে বরিস জনসনের ভাগ্যে কী লেখা আছে।
গণ ছাঁটাই, বেকারি, জীবনের মানের পতন এবং আক্রমণ ছাড়া শ্রমিক শ্রেণিকে এখন পুঁজিবাদের আর কিছুই দেওয়ার নেই। এই পরিস্থিতি শ্রেণি সংগ্রাম তীব্র করতে বাধ্য। এমনকি মতাদর্শগত ভাবে আমাদের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে থাকা ফিনানশিয়াল টাইমসের মতো বুর্জোয়া পত্রিকাও একই পৌঁছেছে। তারা লিখেছে, “সুদূরপ্রসারী সামাজিক অস্থিরতা, এমনকি বিপ্লব”ও হয়ে যেতে পারে।
এখন…
বড়ো বড়ো মানুষের চেতনাতেও ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। ইতিমধ্যেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নিয়ে চারদিকে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। যুবসমাজের মধ্যে এই প্রশ্ন অনেক বেশি তীব্র। কারণ তারা তাদের জীবন জুড়ে কেবল ব্যয় সংকোচন ও সংকটই দেখে চলেছে।
এর ফলে সংগ্রামী জনগণের একটা বড়ো অংশ বাম অবস্থানের দিকে ঝুঁকবে।শ্রমিক শ্রেণির সমস্যাগুলির কোনো সমাধান পুঁজিবাদের কাছে নেই।
কিন্তু আমেদের জানা একটা পুরনো কথা তো আছেই। তা হল, পুঁজিবাদ নিজে থেকে ইতিহাসের মঞ্চ ছেড়ে যাবে না। তাকে ছুঁড়ে ফেলতে হবে। আমরা ইতিমধ্যেই দেখে নিয়েছি বিপ্লবী সুযোগের কোনো অভাব নেই। গোটা পরিস্থিতির মধ্যেই অন্তর্নিহিত রয়েছে বিপ্লবী সম্ভাবনা। পুঁজিবাদের চূড়ান্ত পতনের গভীরে এক নতুন সমাজ জন্ম নেওয়ার জন্য হাতপা ছুঁড়ছে। কমিউনিস্টদের কাজ হল সব রকমের সুবিধাবাদী প্রবণতাকে ছুঁড়ে ফেলে, তাকে পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য জনগণের সংগ্রামকে চালিত করা।