Home জনস্বাস্থ্য কোভিড ১৯ নয়, শিল্পপতিদের স্বার্থেই শ্রমজীবীদের মেট্রো চড়ার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে সরকারগুলো

কোভিড ১৯ নয়, শিল্পপতিদের স্বার্থেই শ্রমজীবীদের মেট্রো চড়ার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে সরকারগুলো

কোভিড ১৯ নয়, শিল্পপতিদের স্বার্থেই শ্রমজীবীদের মেট্রো চড়ার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে সরকারগুলো
1
প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী

রাস্তাঘাটে লোকজন এমনিতেই কম। কলকাতা শহরের গাড়িঘোড়ার দিকে তাকালেই সেটা মালুম হয়। ওই অফিস টাইমে যেটুকু ভিড় হয়। এই অবস্থায় কলকাতায় মেট্রো চালানোর উদ্যোগ শুরু হয়েছে। সুকৌশলে বলা হচ্ছে, এমনি সময় মেট্রোয় রোজ ৭ লক্ষ মানুষ চড়তেন, এখন লোকাল ‘ট্রেন না চলায়, শহরতলি থেকে মানুষ আসছেন না খুব একটা, তাই সেটা সাড়ে ৩ লক্ষ হয়ে যাবে। বাকি শর্তগুলো বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে না, স্কুল কলেজ বন্ধ, সরকারি কর্মীদের অতিমারি জনিত কারণে রোজ অফিস যেতে হচ্ছে না। বেসরকারি ক্ষেত্র? গত ৬ মাসে ভারতের নানা স্তরের মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের চাকরি গেছে বলে তথ্যে প্রকাশ। যে সব অফিসে সম্ভব, সে সব অফিসেই ‘বাড়ি থেকে কাজের’ ব্যবস্থা চালু করে দেওয়া হয়েছে। কোথাও রোজ, কোথাও বা সপ্তাহের অধিকাংশ দিন। যাদের পক্ষে সম্ভব, তাদের একাংশ নিজের গাড়িতে আপাতত যাতায়াত করছেন এবং করবেন। যদিও সে সংখ্যাটা খুব একটা বেশি নয় বলে বাদই রাখছি। সব মিলিয়ে মেট্রো চালু হলে এই মুহূর্তে রোজ ১.৫-২ লক্ষ মানুষকেও তা চড়তে হবে কিনা সন্দেহ।

অথচ মেট্রোর ভিড় কমাতে একের পর এক বৈঠক করে চলেছে রাজ্য সরকার এবং মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ! চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও জানা না গেলেও যেটুকু জানা গেছে, তাতে প্রকাশ, আপাতত স্মার্ট ফোন না থাকলে মেট্রো চড়া যাবে না। কারণ যাদের স্মার্ট কার্ড নেই, তাদের ৫টাকা-১০ টাকা খরচ করে অ্যাপ বা ওয়েবসাইটের প্রবেশের অনুমতি সংগ্রহ করতে হবে(টিকিট কাটতে হবে)। আর স্মার্ট কার্ড থাকলেও পাতাল পথে প্রবেশের জন্য ই-পাস সংগ্রহ করতে হবে। সেটাও বৈধ থাকবে নির্দিষ্ট ১ ঘণ্টার জন্য। অর্থাৎ দেশের সরকারি গণ পরিবহণ ব্যবস্থায় এই প্রথম সরাসরি শ্রেণি বৈষম্য তৈরি করা হচ্ছে। মেট্রোর যাত্রী তালিকা থেকে শ্রমজীবীদের স্রেফ ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। লকডাউনের বাজারে সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরা এবং যাদের যথেষ্ট সঞ্চয় আছে, তারা ছুটি কাটিয়েছেন, বিনোদন উদ্‌যাপন করেছেন। শ্রমজীবীরা খাদের কিনারে চলে গেছেন। গভীর সংকটে পড়েছে নিম্ন মধ্যবিত্তরা। কিন্তু রাষ্ট্র সরাসরি নিজের হাতে শ্রমজীবীদের গলা টিপে ধরছে, এমনটা ৬ মাসে প্রথম। যেটুকু জানা যাচ্ছে, তাতে ই-পাসের জন্য ৪-৬ ঘণ্টা আগে বুক করতে হবে। অর্থাৎ গোটা ব্যবস্থাটাই নিত্য যাত্রী অর্থাত সংগঠিত ক্ষেত্রের যাত্রীদের জন্য। যারা প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে কাজে বেরোন। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবীদের কথা ভাবাই হচ্ছে না।

সবচেয়ে বড়ো কথা, ভারতের শ্রমজীবীদের একটা বড়ো অংশের এখনও স্মার্টফোন নেই। যাদের কাছে সস্তার অ্যান্ড্রয়েড ফোন আছে, তাদের পক্ষেও আগে থেকে বুক করে সেই কিউআর কোড দেখিয়ে মেট্রো চড়ার অভ্যাস করাটা রাতারাতি অসম্ভব। অর্থাৎ অচিরেই মেট্রো হয়ে উঠবে একটি এলিট যান। যেখানে পুলিশ যন্ত্রের সাহায্যে অষ্টমী রাতের কলকাতার ভিড়ের পরিমাপ করতে পারে, সেখানে সদিচ্ছা থাকলে, মেট্রো স্টেশনে ধাপে ধাপে নির্দিষ্ট সংখ্যার যাত্রীকে ঢোকানো সম্ভব নয়- এটা মানা যায় না। আসলে রাষ্ট্র তার নিজের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে গরিব মানুষের ওপর। যেটা তারা বরাবর করে থাকে।

কিন্তু সত্যিই কী করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য গরিব মানুষের ওপর এই আক্রমণ নেমে আসছে? একেবারেই তা নয়। গোটা লকডাউনের অভিজ্ঞতা থেকে এটা স্পষ্ট যে, স্মার্টফোনের বিক্রি বাড়ানো, ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ানোই রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য। এই বাজারটা যতদূর সম্ভব নীচে নামাতে চায় তারা। দুনিয়া জুড়ে গোটা লকডাউনে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ব্যবসায়ী, ই-কমার্স ও জোমাটো-সুইগি-বিগ বাস্কেট-গ্রফার্সের ইত্যাদির মতো গিগ ইন্ডাস্ট্রি(ভারতের সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ মুকেশ অম্বানি)। তাদের সম্পত্তির পরিমাণ এবং সংস্থার শেয়ার দর আকাশ ছুঁয়েছে। অথচ ক্রমেই কোমর বেঁকে গেছে শ্রমজীবী জনতার। এবং এসবই হয়েছে রাষ্ট্রের মদতে। এই সব শিল্পপতির সঙ্গে রাষ্ট্রের অশুভ আঁতাতের হাত ধরে। গোটা লকডাউনের নীতি্ই তৈরি হয়েছে এই শ্রেণিটার সুবিধামতো।

আরও একটি বিষয় আছে। তা হল তথ্যের ব্যবসা। কয়েক বছর আগে ভারতে বিদেশি লগ্নি টানার এক সভায় নরেন্দ্র মোদি ব্যবসায়ীদের এই বলে লোভ দেখিয়েছিলেন যে ভারতে তথ্য সবচেয়ে সস্তা। ডিজিটাল ব্যবসা দাঁড়িয়েই থাকে ব্যবহারকারীদের সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যের ওপরে। তাদের উপার্জন, জীবনের মান, পছন্দ-অপছন্দ সংক্রান্ত তথ্যের ভিত্তিতেই ব্যবসার রণনীতি ঠিক করে সংস্থাগুলো। করোনা-কালে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য। প্রত্যেক করোনা রোগীর তথ্য সরাসরি চলে যাচ্ছে হু-এর কাছে। যা হাতে পাচ্ছে বহুজাতিক ওষুধ ও বিমা সংস্থাগুলো। পাশাপাশি গত ১৫ আগস্ট ন্যাশনাল ডিজিটাল হেল্থ মিশনের কথা ঘোষণা করেছেন মোদি। যাতে নিজেকে নথিভুক্ত করলে প্রত্যেক নাগরিক পেতে পারবেন একটি ইউনিক হেল্থ কার্ড। তার জন্য তাদের শরীরস্বাস্থ্য সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য, যৌন জীবন এবং রাজনৈতিক পছন্দও জানাতে হবে। বলাই বাহুল্য ভারত সরকার এই তথ্য স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেবে। আর জনগণকে বলবে, তাদের তথ্যের গোপনীয়তা বজায় থাকবে। বলাই হয়, বর্তমান দুনিয়ায় তথ্যই সবচেয়ে মূল্যবান পণ্য। মেট্রোর ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, অনেক কিছু সিদ্ধান্ত হয়ে গেলেও মেট্রো রেলের নাকি রাজ্যের – কাদের অ্যাপ ব্যবহার করে ই-পাস বুক করা যাবে, তা নিয়ে এখনও দর কষাকষি চলছে। অর্থাৎ যাত্রীদের তথ্যের মালিকানায় কার কতটা দখল থাকবে, তা এখনও স্থির হয়নি। ওই ই-পাস বুক করতে কী কী তথ্য লাগবে, তা কিছুদিনের মধ্যেই জানা যাবে।

অর্থাৎ, যাদের ক্রয় ক্ষমতা রয়েছে, মোটামুটি সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন, নিয়মিত উপার্জন রয়েছে, তাদের সম্পর্কে তথ্যটা জোগাড় করে রাখতে চাইছে রাষ্ট্র। সেটা জোগাড় হয়ে যাওয়ার পর গরিবগুর্বোরা মেট্রো চললেও কিছু যায় আসে না। তখন হয়তো স্মার্ট ফোনের ব্যবহারও আর প্রয়োজন হবে না। আপাতত, যাদের মেট্রো ছাড়াও বড়ো রকমের অসুবিধা হচ্ছিল না বা সেই অসুবিধা পয়সা দিয়ে দূর করার ক্ষমতা যাদের ছিল, তাদের জন্যই মেট্রো চালু হবে। যাদের মেট্রো ছাড়া গতি নেই, তুলমামূলক কম পয়সায় দ্রুত অনেকটা চলে যাওয়ার জন্য যাদের মেট্রোই একমাত্র উপায়, তাদেরকে আধ ঘণ্টার রাস্তা পেরোনোর জন্য ২ ঘণ্টা আগেই বাড়ি থেকে বেরোতে হবে। জীবিকার জন্য অনেক বেশি শ্রম খরচ করতে হবে।

গোটা দেশের সম্পদ যারা উৎপাদন করেন, দেশকে মহামারি-মুক্ত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বোঝা বওয়ার দায়িত্বও তাদের ওপরই চাপিয়ে দিয়েছে সরকারগুলো। ব্যাপারটা অবশ্য মন্দ নয়। শ্রমজীবী জনগণ, তাদের শত্রুমিত্র আরও স্পষ্ট ভাবে চিনতে পারছেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের আটকে রেখে লকডাউন শুরু করে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে যে বৃত্ত শুরু হয়েছিল, শ্রমজীবীদের মেট্রো চড়ার অধিকার কেড়ে নিয়ে সেই বৃত্ত হয়তো সম্পূর্ণ হল।

লড়াই এখন নতুন বৃত্ত আঁকার।

Share Now:

Comment(1)

  1. হাইপার লিঙ্কড লেখা হলুদ না করে নীল বা অন্য কোনো রঙ করলে বেটার হয়। হলুদটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *