কোভিডের আগেও ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অথৈ জলে ছিল, পরেও থাকবে, একটি বিশ্লেষণ
পিপলস ম্যাগজিন ডেস্ক: যে দেশের জিডিপির মাত্র ১.২ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয়, সে দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেন, যে করোনা অতিমারি সামলানোয় রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই, তার পিছনে কী কারণ থাকতে পারে? একটাই। নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদির ছাতির মাপ ৫৬ ইঞ্চি। অন্তত জনশ্রুতি সেরকমই। কথাটা ডাহা মিথ্যে। ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কোভিড অতিমারির আগেও গভীর সংকটে ছিল, এখনও তেমনই আছে। পচনটা দিনের আলোর মতো সামনে চলে এসেছে, এই যা।
আরও পড়ুন: ভ্যাকসিন বানাতে খরচ বেশি, লাভ কম- তাই চরমে কোভিড প্রতিষেধক নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের লড়াই
বিশ্ব স্বাস্থ্য সূচকে ১৯৫টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৫৪ নম্বরে। এই সূচক তৈরি হয়, জনগণের স্বাস্থ্য পরিষেবার সুযোগ পাওয়ার ক্ষমতা ও পরিষেবার গুণমান সংক্রান্ত সরকারি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। প্রকৃত অবস্থাটা আরও খারাপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী ১০০০ রোগী পিছু একজন চিকিৎসক থাকার কথা। ভারতে সংখ্যাটা ১,৬৫৫। সরকারি ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ১১,০৮২। বিহারের মতো গরিব রাজ্যে তা ২৮, ৩৯১। পশ্চিমবঙ্গে ১০,৪১১। রাজধানী দিল্লিতে ২,২০৩। হু-এর সুপারিশ অনুযায়ী ১০০০ জন জনসংখ্যায় ৩.৫টি হাসপাতাল বেড থাকা উচিত। ভারতের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ০.৫। গ্রামের দিকে অবস্থাটা আরওই খারাপ। ভারতের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের ৬০ শতাংশ বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের হাতে। যারা মুনাফা ছাড়া কিছু বোঝে না।
গরিবদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা
বিশ্বের গরিব মানুষদের চার ভাগের এক ভাগই যে শুধু ভারতে থাকে তাই নয়। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ক্ষুধার্ত মানুষও থাকেন এখানে। রোগ প্রতিরোধ এখানে অসম্ভব। একটি হিসেব অনুযায়ী দেশের প্রায় সাড়ে উনিশ কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভোগেন। যেটা জনসংখ্যার ১৪.৫ শতাংশ। এটা সরকারি তথ্য। প্রকৃত অবস্থাটা আরও খারাপ। ৭০ শতাংশ শিশুমৃত্যুর সঙ্গে ক্ষুধার প্রশ্নটি জড়িত। জনসংখ্যার ৫০ শতাংশেরও বেশি পরিশুদ্ধ পানীয় জল পান না। দূষণ থাবা বসিয়েছে ৬৮ শতাংশ জনসংখ্যার ওপর।
যদি গরিবরা কোনো মতে পেট ভরার মতো খাবার জোগাড় করেও ফেলে, তাহলেও তাদের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কিছু কমে না। কারণটা লুকিয়ে আছে তাদের খাবারের মানের মধ্যে। উৎপাদন খরচ কমানো এবং মুনাফা বাড়ানোর জন্য খাদ্য ব্যবসায়ীরা মশলায় ভেজাল দেয়, বিষাক্ত কীটনাশক দিয়ে ফলানো সবজি, রাসায়নিক ভাবে বাড়ানো মাংস ও দুধ ব্যবহার করে। স্যাচুরেটেড ফ্যাটে তেলের পরিমাণও থাকে অত্যন্ত বিপজ্জনক মাত্রায়। এর সঙ্গে অস্বাস্থ্যকর রাস্তার খাবার তো আছেই। দূষিত খাবার ও জল খেয়ে বছরে ২০ লক্ষ মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার মধ্যে ১৫ লক্ষই শিশু। আর এই ২০ লক্ষের মধ্যে ৭ লক্ষই হয় দক্ষিণ এশিয়ায়।
উন্নত মানের স্বাস্থ্য পরিষেবার বিষয়টা ভারতে একটি শ্রেণিনির্ধারিত বিষয়। ধনীরা তাদের বাড়ির ভেতর ও বাইরে পরিষ্কার পরিবেশ রক্ষা করে, তারা কীটনাশকবিহীন পরিশুদ্ধ খাবার খায়। অন্যদিকে শ্রমজীবীরা ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে দূষিত পরিবেশে থাকতে বাধ্য হয়। স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার কথা তারা ভাবতেও পারে না। খাবারের দূষণ বিরোধী যাবতীয় আইন, নিয়ন্ত্রণবিধি সবই ধনীদের সাহায্য করার জন্য তৈরি। গরিব মানুষ প্রতিমুহূর্তে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার পরীক্ষা দিয়ে চলে।
গ্রামের কৃষক এবং তাদের পরিবার বিপজ্জনক কীটনাশকের সঙ্গেই বসবাস করেন। কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য দ্বারা দূষিত নদীর জল দিয়েই তাদের জীবন চলে। বিষাক্ত কীটনাশকের জেরে পঞ্জাব, হরিয়ানায় ক্যান্সারের হার নিয়মিত বাড়ছে। অথচ ভারতীয় কৃষিতে এই দুটি রাজ্যের গুরুত্ব অসীম। মজা হল, পঞ্জাবে কোনো যথাযথ ক্যান্সার চিকিৎসার হাসপাতাল নেই। গুরুত্বপূর্ণ ফসল উৎপাদক গ্রামগুলির উপর দিয়ে একটি ট্রেন চলে। যার নামই হয়ে গেছে ‘ক্যানসার ট্রেন’। এই ট্রেনটি ক্যান্সার রোগীদের কয়েকশো মাইল দূরে রাজস্থানের বিকানিরে ক্যান্সার হাসপাতালে নিয়ে যায়।
জনস্বাস্থ্যের এই সংকট নিয়ে ভারত সরকার যথেষ্ট সচেতন। কিন্তু তারা চোখ বন্ধ করে আছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যে বেসরকারি মুনাফা নির্ভর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছে, সেটার ক্ষতি হয় এমনকিছুই ভারত সরকার করবে না। অসুস্থ মানুষ একটা পচে যাওয়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।
বিপর্যস্ত সরকারি হাসপাতাল
সরকারি হাসপাতালের অবস্থা কল্পনারও অতীত। চিকিৎসা করতে কোনো খরচ হয় না, কিন্তু মানুষের সঙ্গে পশুর মতো ব্যবহার করা হয়। রক্ষণাবেক্ষণের তহবিল নিয়ে দুর্নীতির জেরে বহু হাসপাতাল ভবনের অবস্থা খারাপ। চিকিৎসার সরঞ্জামের রক্ষণাবেক্ষণের হালও খুব খারাপ।
২০১৭ সালে, উত্তরপ্রদেশের গোরখপুরে ৬৩ জন শিশু শ্বাসকষ্টের জেরে মারা যায়, তাদের বাবা-মায়ের সামনে। কারণ হাসপাতালটিতে অক্সিজেন সিলিন্ডার ছিল না এবং বেসরকারি সরবরাহকারীরা প্রচুর টাকা বাকি পড়ে থাকায় অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল।
দেশের গরিব এলাকাগুলিতে তো যথাযথ স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নেই বললেই চলে। এইসব এলাকায় মারণ রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে সংকটে শিশুদের স্বাস্থ্য। যদি কোনো গ্রামে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকেও থাকে, তার ৮০ শতাংশতেই ডিগ্রিধারী চিকিৎসক নেই। ঠিকঠাক ডাক্তারের দেখা পাওয়ার জন্য রোগী ও তার পরিজনদের কয়েকশো মাইল পেরোতে হয়। এর ফলে বড়ো সরকারি হাসপাতালগুলিতে সব সময়ই অতিরিক্ত রোগী থাকে। আইন অনুযায়ী তারা কোনো রোগীকে প্রত্যাখ্যানও করতে পারে না।
রক্তচোষা বেসরকারি হাসপাতাল
সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা যাদের পরিষেবা দিতে পারে না, সেই ফাঁকটা পূরণ করে বেসরকারি ক্ষেত্র। কিন্তু তারা সরকারি ব্যবস্থার থেকে ভালো কিছু নয়। সত্যি বলতে কি, তারা অনেক বেশি খারাপ। কয়েকটি বড়ো মাপের বেসরকারি হাসপাতাল বাদে, বেশিরভাগই কারও বাসস্থানে বা কোনো মতে তৈরি করা অফিস ঘরে অবস্থিত। ভারতের ১০ লক্ষ চিকিৎসকের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ সরকারি ক্ষেত্রে চাকরি করেন, বাকিরা বেসরকারি ক্ষেত্রে। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে ডাক্তার হওয়ার পরে নতুন ডাক্তারদের বেসরকারি ক্ষেত্রই চাকরির জায়গা হিসেবে বেশি আকর্ষণ করে। সেখানে তারা প্রচুর টাকা বেতন পান, পাশাপাশি ওষুধ সংস্থা থেকে প্রচুর কমিশনও মেলে। যদিও তা সত্ত্বেও বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতালে ডাক্তারের সংখ্যা কম। তবুও বেসরকারি হাসপাতালগুলি কাজ চালিয়ে যায়, এমনকি ডাক্তার ছাড়াও কখনও কখনও জটিল অস্ত্রোপচার করে। যদি সেটা ভুল হয় এবং রোগীর মরমর অবস্থা হয়, তাহলে তারা দায়িত্ব এড়াতে এবং সম্মান বাঁচাতে রোগীকে সরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়।
রক্তচোষা বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আগ্রাসী বিপণনের সাহায্য নিয়ে থাকে। সরকারি হাসপাতালে কর্মরত যেসব চিকিৎসক এবং নার্সরা তাদের হাসপাতালে আংশিক সময় কাজ করে, তাদের তারা চাপ দেয় সরকারি হাসপাতাল থেকে তাদের হাসপাতালগুলিতে রোগী নিয়ে আসার জন্য। এ কাজের জন্য তারা দালাল, প্রতারকদেরও পয়সার বিনিময়ে কাজে লাগায়। সরকারি হাসপাতালগুলির বাইরে অজস্র বেসরকারি অ্যামবুলেন্স নিয়ে দালালরা দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের কাজ হল সরকারি হাসপাতালে আসা রোগী ও তাদের বাড়ির লোকদের ভুল বুঝিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া।
বেসরকারি হাসপাতালে প্রচুর টাকা খরচ করে রোগীরা চিকিৎসা ছাড়া সব কিছু পায়। ছোটোখাটো রোগকে বড়ো রোগ হিসেবে দেখানো হয়। এবং রোগীরা দামি ওয়ার্ডে দিনের পর দিন কাটাতে থাকে এবং বিলও বেড়ে চলে। যদি এর মাঝে রোগীদের টাকা ফুরিয়ে যায়, তাহলে তাদের হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয় এবং সরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিশাল দেনার ভার মাথায় না নিয়ে কোনো গরিব রোগীই বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বেরোতে পারে না। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল রোগী ও রোগীর পরিবার থেকে বাকি টাকা আদায় করার জন্য গুন্ডাও পোষে। এমনও বহু ঘটনা আছে, যেখানে স্থানীয় পুলিশ কর্তারা টাকার বিনিময়ে বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হয়ে টাকা আদায়ে সাহায্য করে।
গ্রামাঞ্চলের বেসরকারি হাসপাতালগুলি মানব অঙ্গ পাচারের ঘাঁটি। বেসরকারি হাসপাতালে নজরদারির জন্য সরকার বিভিন্ন দল গঠন করে, তারা হঠাৎ হাসপাতাল পরিদর্শনও করে, কিন্তু কিছুই হয়না। তার কারণ লুকিয়ে আছে, ব্যাপক দুর্নীতি এবং রাজনীতিবিদদের সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যোগাযোগের মধ্যে। ফলে বেসরকারি হাসপাতালগুলির কাজকর্ম একইরকম ভাবে চলতে থাকে।
বেশকিছু অসরকারি ও মানবতাবাদী সংগঠন ভারতের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কাজ করে। তারা গরিব মানুষকে বিনা পয়সায় বা খুব কম টাকায় চিকিৎসা পরিষেবা দেয়। নাদার, অম্বানি, পিরামল, প্রেমজি, গোদরেজ, আদানি এবং অন্যান্যরা দাতব্য চিকিৎসালয় চালায়। কিন্তু সেখানে খুব সামান্য রোগীই নিখরচায় চিকিৎসা পায়। বাকিদের কাছে এগুলো স্রেফ চোখে ধুলো দেওয়ার বন্দোবস্ত। অনেকেই ক্ষেত্রেই এসব দানছত্র আসলে বড়ো পুঁজিপতিদের কর এড়ানোর উপায়। বহু আন্তর্জাতিক দাতব্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বহুজাতিক ওষুধ সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। তারা ভারতের বাজারে ঢোকার জন্য এগুলিকে কাজে লাগায় কিংবা মানুষের ওপর ওষুধ পরীক্ষার জন্য এগুলি ব্যবহার করে।
বেসরকারি হাসপাতালগুলি মুনাফার জন্য যেসব অন্যায় কাজ করে, এই অতিমারির সময়ে তার ফলাফল হচ্ছে মারাত্মক। সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের মিরাটে একটি হাসপাতালের অনুমোদন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কারণ হল, একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়, যাতে দেখা যায় হাসপাতালের এক কর্মী এক রোগীকে বলছেন, তিনি যদি ২,৫০০ টাকা দেন, তাহলে তার কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ করে দেওয়া হবে। তাতে ওই রোগী কাজে যোগ দিতে পারবেন এবং তাকে নিভৃতবাসে যেতে হবে না। জানা যায়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষে এই চক্রের পেছনে রয়েছে। উত্তর প্রদেশে এখন অবধি ২৭,০০০ কোভিড কেস ধরা পড়েছে, তার মধ্যে ৭৮৫ জন মারা গেছে। বেসরকারি হাসপাতালের বদমাইশরা দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের মরিয়া অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করতে চাইছে, তাড়াতাড়ি লাভ করার জন্য তারা এই সংখ্যাগুলিকে বাড়িয়েও দেখাচ্ছে।
ভুয়ো ওষুধ ও হাতুড়ে চিকিৎসা
ভারতের ওষুধ শিল্পের অবস্থা খুবই খারাপ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসেব অনুযায়ী ভারতে যত ওষুধ বিক্রি হয় তার ২০ শতাংশই ভুয়ো এবং বহু ওষুধের মান খুবই খারাপ। প্রকৃত হিসেবটা অবশ্য আরও বেশি। ওষুধ ক্ষেত্রকে সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায়, এই ক্ষেত্রে মুনাফার জন্য যা খুশি তাই চলছে। এক কথায় মাফিয়ারাজ চলছে। ভুয়ো বা খারাপ ওষুধ কেনা ছাড়া গরিব মানুষের কিছু করার নেই। সরকারি হাসপাতাল থেকে বিনা পয়সায় ওষুধ দেওয়ার কথা। কিন্তু ব্যাপক দুর্নীতির জন্য তা পাওয়া যায় না। সাধারণ মানুষকে হাসপাতালের পাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ওষুধের দোকান থেকে প্রচুর দামে খারাপ ওষুধ কিনতে হয়। প্রায়শই রোগীর পরিবার টাকার অভাবে হাসপাতালে চিকিৎসা করানো ছেড়ে দেয় এবং রোগীকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর জন্য ফেলে রাখতে বাধ্য হয়। ভারত, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ জেনেরিক ওষুধ রফতানি করে(ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিসে যত জেনেরিক ওষুধ দেওয়া হয়, তার ৮০ শতাংশই ভারত থেকে যায়), কিন্তু ভারতের মানুষ প্রয়োজনীয় ও জীবনদায়ী ওষুধ থেকে বঞ্চিত থেকে যায়।
বেশিরভাগ ভারতবাসী সস্তায় চিকিৎসার জন্য কোয়াক ডাক্তারদের কাছে যায়। সেখানে তাদের বিভিন্ন জড়িবুটি ও ‘জাদু’ ওষুধ দেওয়া হয়। এই বাজার ক্রমেই বাড়ছে। সত্যিকারের রোগে এইসব ভুয়ো ওষুধ দেওয়ার ফলে রোগ তো সারেই না উল্টে বেড়ে যায়। তখন রোগীকে হাসপাতালে যেতে হয়। শাসক শ্রেণি সব জানে। তারা জানে পুঁজিবাদে তারা সকলের চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে পারবে না, তাই তারা এইসব অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসাকে তোল্লাই দেয়, মানুষকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখে এবং ‘জাদু’র ওপর নির্ভরশীল করে রাখে।
বিভিন্ন ধরনের ভুয়ো ওষুধের বিপণন করা হয় খবরের কাগজ ও টিভিতে, এমনকি সোশাল মিডিয়ায়। এই সব হাতুড়েরা কারবার বাড়ানোর জন্য শাসক দলের রাজনৈতিক নেতাদের নিয়মিত ঘুষ দেয়।
বাবা রামদেবের করোনিল ও শ্বশারি দিয়ে কোভিডের চিকিৎসা, বিজেপি নেতাদের গোমূত্র দিয়ে কোভিডের চিকিৎসার প্রচার, এ সবের সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। লজ্জার ব্যাপার হল, চিকিৎসকদের একাংশও এই প্রচারে প্রভাবিত। যার ফল ভুগছে গরিব মানুষ। তবে শুধু হিন্দু রাজনৈতিক নেতারাই নয়, মুসলিম, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য ধর্মের ধর্মীয় নেতারাও এ ধরনের বহু অবৈজ্ঞানিক ওষুধ বিক্রি করেন। যাতে রোগের প্রকোপ বাড়ে এবং মানুষের সচেতনতা বাড়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
গভীর সংকটে মহিলাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা
মহিলাদের অবস্থা আরও খারাপ। কারণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুরবস্থা, অশিক্ষা, বঞ্চনার পাশাপাশি তাদের মেয়ে হওয়ার জন্য অত্যাচারগুলিও সইতে হয়। অবৈজ্ঞানিক ভাবে প্রসবের জন্য বহু মহিলা সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মারা যান। গ্রামীণ গরিব ভারতীয় পরিবারগুলিতে মেয়েদের স্বাস্থ্যে সবচেয়ে কম নজর দেওয়া হয়। নানা সামাজিক কারণ ও নিপীড়নের জন্য বহু ক্ষেত্রেই মহিলারা লজ্জায় তাদের রোগ লুকিয়ে রাখেন, এমনকি অনেকে নিজের সমস্যার কথা বলার চেয়ে মরাও ভালো বলে মনে করেন। দেশে মহিলা ডাক্তারদের সংখ্যা কম হওয়াটাও একটা সমস্যা। কারণ অনেক পরিবার তাদের ‘পরিবারের সম্মান’ রক্ষার জন্য ঘরের মেয়েদের গায়ে কোনো পুরুষকে হাত দিতে দেয় না।
পুঁজিবাদে প্রযুক্তির উন্নতি ভারতীয় মেয়েদের জীবনে অত্যাচার বাড়িয়ে দিয়েছে। গর্ভধারণের সময়কার নানা সমস্যা জানার জন্য আলট্রাসাউন্ড মেশিন ব্যবহার করা হয়। অথচ সেই মেশিন কাজে লাগানো হয় মেয়েদের ওপর নিপীড়ন চালাতে। প্রতিবছর ভারতে এই যন্ত্র কাজে লাগিয়ে গর্ভস্থ সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয়। এবং নারীভ্রূণ হত্যা করা হয়। ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এখনও মেয়েদের বোঝা মনে করা হয়। এবং মেয়ে জম্মানোটা অসম্মানজনক বলে ভাবা হয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে হরিয়ানার মতো রাজ্যে, পুরুষ, নারীর অনুপাত বিপজ্জনক ভাবে কমে গেছে। মেয়েদের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলে তাদের স্বাস্থ্যর ব্যাপারেও খুব কম নজর দেওয়া হয়। ফলে গরিব পরিবারের বহু মহিলা গোটা জীবনটাই নানা রোগে ভুগতে ভুগতে কাটান।
শ্রেণি বিভক্ত সমাজে সারোগেসির মানেটাও পালটে গেছে। যে সব মহিলাদের সন্তান ধারণে নানা শারীরিক অসুবিধা আছে, এই প্রযুক্তি তাদের কাজে লাগার কথা। অথচ পুঁজিবাদে এটা ব্যবহার করছেন ধনী মহিলারা। তারা সন্তান প্রসবের যন্ত্রণা নেবেন না বলে টাকার বিনিময়ে সেটা গরিব মহিলাদের দিয়ে করাচ্ছেন। সন্তান জন্ম নেওয়ার পর তাকে আসল ‘মা’য়ের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।
এখানে ঋতুস্রাব সম্পর্কে এখনও একটি
জঘন্য ও বিরক্তিকর ধারণা বহমান। তা হল, এটা অপবিত্র বিষয়। ফলে এই সময় বহু জায়গায়
মেয়েদের মন্দিরে ও মসজিদে ঢুকতে দেওয়া হয় না। এখানে প্রতিদিন ৯০-১০০ জন মহিলা
ধর্ষিতা হন। তারপর যা হয়, সেটা আশ্চর্য। ধর্ষিতার পরিবারের লোকেরা অভিযোগ করেন সেই
মেয়েটি তার পরিবারকে ‘অসম্মানিত’ করেছে। ফলে তাকে যদি বাঁচিয়েও রাখা হয়, তবু তাকে
সারাজীবন মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া হতে থাকে। তার কোনো চিকিৎসাও হয় না।
দেশে বাথরুমের অভাব নিয়ে রাজনীতিতে বহু আলোচনা হয়। কোটি কোটি ভারতবাসী এখনও
প্রকাশ্য স্থানে বর্জ্যত্যাগ করেন। মেয়েদের কাছে এটা খুবই চাপের ব্যাপার। তাদের
মধ্যরাত বা দিনের কোনো অস্বাভাবিক ফাঁকা সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এই সময় অনেকে
যৌন হেন্থারও শিকার হন। এই পরিস্থিতিতে বহু মানুষের কাছেই নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর
জীবন একটি বিলাসিতা। ২০১৪ সালে মোদি ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’ নামে একটি প্রকল্প শুরু
করেন। তাতে ৬৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ৯ লক্ষ বাথরুম তৈরির কথা বলা হয়। শুরু
থেকেই প্রকল্পটিতে ব্যাপক দুর্নীতি হয় এবং বর্জ্য নিষ্কাষণের কোনো পরিকল্পনা এতে
ছিল না। ফলে ক্ষেত ও নদীগুলি দূষিত হয়ে চলেছে। বিদ্যুৎ সংযোগ এবং খাদ্যে ভরতুকি
বন্ধ করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে গ্রামীণ মানুষদের এগুলি ব্যবহার করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
এতেও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মহিলারাই।
রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা
ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্যা মেটাতে কিছুই করেনি। কংগ্রেস ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের ভোটের আগে তাদের ইস্তাহারে বিনা পয়সায় চিকিৎসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তাতে তাদের কোনো লাভ হয়নি। কারণ তাদের আমলে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ব্যাপক বরাদ্দ ছাঁটাই করা হয়েছে এবং বেসরকারিকরণ হয়েছে। যেমন, ২০০৯-এর ভোটের আগে কংগ্রেস বিনা পয়সায় স্বাস্থ্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বাস্তবে তারা ক্ষমতায় আসার পর তা না করে তারা ‘রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা’ (আরএসবিওয়াই) প্রকল্পের মধ্যে গরিব পরিবারগুলিকে নিয়ে এসে স্বাস্থ্য বিমার ব্যবস্থা করে। ভারতের ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর তারা মার্কিন মডেল চাপাতে আগ্রহী ছিল। এই পদক্ষেপ কেবল বিমা ব্যবসায়ীদের উপকার করেছে।
বিজেপি তাদের ২০১৪ সালের ইস্তাহারে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যের আশ্বাস’ দিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তারা সামান্য কিছু পরিবর্তন করে আরএসবিওয়াই-কেই পুনর্জীবিত করে। যেমন- আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প। ২০১৯-এর ভোটের আগে সেটাকেই সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা বলে প্রচার করা হয়। এই সব প্রকল্পগুলো মানুষকে বিনা পয়সায় উন্নত মানের চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার বদলে, জনগণের টাকা বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবসায়ী ও রক্তচোষা বিমা সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার ছক ছাড়া কিছু নয়।
কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর দূরবস্থা
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে তাকালেই কমিউনিস্ট পার্টিগুলির জঘন্য অবস্থাটা বোঝা যায়। একদিকে তারা মুখে বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিরোধিতা করে। কিন্তু কাজে বড়ো কর্পোরেট হাসপাতালগুলিকে সুবিধা পাইয়ে দেয়। তারা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সম্পূর্ণ জাতীয়করণের কথা বলে না, বলে স্বাস্থ্য বিমার পরিসর বাড়ানোর কথা। তারওপর তারা কংগ্রেস সহ বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী দলের ঘনিষ্ঠ। ফলে তারা সচেতন ভাবেই নিজেদের ইস্তেহার ও প্রতিশ্রুতিগুলিকে হালকা করে ফেলেছে। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে তাদের হাতে কয়েক দশক ধরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। অথচ তারা বিশাল আকারের বেসরকারিকরণের কর্মসূচি লাগু করেছে। যার শুরুতেই রয়েছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও ডিএফআইডি-র পরিকল্পনা অনুযায়ী স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি ব্যবস্থা(পিপিপি)।জনগণের প্রতি এই ধরনের বিশ্বাসঘাতকতার ফলও তারা পেয়েছে এবং এখনও পেয়ে চলেছে। বেসরকারিকরণ ও শ্রমিক-বিরোধী পদক্ষেপ করার ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে দক্ষিণপন্থী দলগুলোর কোনো তফাত সাধারণ মানুষ দেখতে পান না।
আসলে সকলের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের প্রশ্নটি একটি দেশ বা সমাজে কতটা গণতন্ত্র রয়েছে, তার সঙ্গে জড়িত। শ্রমজীবী মানুষের দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় সমস্যা থেকে যাবে, শুধু স্বাস্থ্য পরিষেবার দারুণ উন্নতি হয়ে যাবে এমনটা অসম্ভব। তাই জনস্বাস্থ্য আন্দোলনকে তীব্র করার পাশাপাশি তাকে শ্রমজীবী মানুষের জীবনে গুণগত পরিবর্তন আনার বৃহত্তর লড়াইগুলোরও অংশ হয়ে উঠতে হবে। তা না হলে, সকলের জন্য স্বাস্থ্যের নামে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীরা মানুষকে প্রতারিত করেই চলবে।