Home খবর ভ্যাকসিন বানাতে খরচ বেশি, লাভ কম- তাই চরমে কোভিড প্রতিষেধক নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের লড়াই

ভ্যাকসিন বানাতে খরচ বেশি, লাভ কম- তাই চরমে কোভিড প্রতিষেধক নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের লড়াই

ভ্যাকসিন বানাতে খরচ বেশি, লাভ কম- তাই চরমে কোভিড প্রতিষেধক নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের লড়াই
0

পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: থিওডর রুজভেল্ট। আমেরিকার এই সুবিশাল জাহাজটি পরমাণু অস্ত্র বহনকারী বিমান পরিবহণ করে থাকে। গত ত্রিশ বছর ধরে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার স্বার্থরক্ষায় দুনিয়া জুড়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে এই জাহাজটি। কিন্তু এই ব্যাপক সুরক্ষা ব্যবস্থা সম্পন্ন জাহাজটির সুরক্ষা ব্যবস্থাও কোভিড ১৯-এর সামনে কাত হয়ে গেছে। গত মার্চ মাসে জাহাজের ১০০০ জন নাবিক মাত্র দিন কয়েকের মধ্যে করোনায় আক্রন্ত হয়ে পড়েন।

ভাইরাসের হানা যেহেতু জাতীয় সীমান্ত মানে না কিংবা অন্য কোনো নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যার মতো বিমান হানা বা সামরিক শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করা যায় না, তাই পৃথিবীর বড়ো বড়ো নেতারা ‘আন্তর্জাতিক সহযোগিতা’র একটা পরিবেশ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। গত ৪ মে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলি একটি অনলাইন সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনের পর ইউরোপিয়ান কাউন্সিল একটি বিবৃতি দেয়, যার বক্তব্য ছিল, ভ্যাকসিন আবিষ্কার ‘করবে পৃথিবী’, উৎপাদন করা হবে ‘গোটা দুনিয়ার জন্য’। তাতে বলা হয়, ‘আমরা কেউ ভাইরাসকে একা আটকাতে পারব না। নিজেদের সুরক্ষিত রাখার জন্য আমাদের পরস্পরকে সুরক্ষিত রাখতে হবে’।

ওই সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান ও স্পেন মিলিত ভাবে ১২.৫ বিলিয়ন ডলারের তহবিল তৈরি করে। এর লক্ষ্য হল, কোভিড ১৯-এর প্রতিষেধক আবিষ্কার এবং তার সমভাবে বণ্টন। তবে ওই শপথে নজরকাড়া অনুপস্থিতি ছিল আমেরিকা ও চিনের। এর থেকেই বোঝা যায় ওই সংহতির মূল্য কতটা।  

 মার্কিন স্বরাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও এবং চিনা বিদেশ দফতরের মুখপাত্র ঝাও লিজান, ভ্যাকসিন তৈরি ও বণ্টনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্বকে খাটো করে দেখানোর জন্য গত এক মাস ধরে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

মার্কিন প্রশাসনের অভিযোগ, সে দেশের প্রতিষেধক-গবেষকদের থেকে তথ্য চুরি করার জন্য চিনা সরকার সাইবার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের দাবি, চিন চিরকালই ওষুধ সংক্রান্ত গবেষণার তথ্য চুরি করার চেষ্টা করে। কোভিড ১৯-এর প্রতিষেধক সংক্রান্ত তথ্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব ব্যাপক। চিন তাই ভেতর থেকে এবং বাইরে থেকে ঢুকে এই তথ্য হাতানোর চেষ্টা করছে।  

অন্যদিকে চিন, তার আর্থিক ক্ষমতা ব্যবহার করে অস্ট্রেলিয়া সহ বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করছে। কারণ ভাইরাসের উৎস সম্পর্কে তদন্ত করার এবং এর চরিত্র সম্পর্কে চিনা সরকার যাতে আরও বেশি বেশি তথ্য দেয়, এই দাবি যে সব দেশ তুলেছে, তাদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া রয়েছে।   

করোনার প্রতিষেধকের জন্য চিন ও আমেরিকার এই দ্বন্দ্ব থেকে বোঝা যায়, বিভিন্ন শক্তিগুলির মিষ্টিমধুর আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলির আড়ালে কোভিড ১৯-এর ভ্যাকসিনের জন্য সকলের সঙ্গে সকলের যুদ্ধ চলছে।  

সেই মার্চ মাসেই ট্রাম্প প্রশাসন জার্মানির ওষুধ সংস্থা কিওরভ্যাক এজি-কে আমেরিকায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। জার্মান সরকার সেই চেষ্টা আটকায়। দিন কতক আগেই ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাকরোঁ ফরাসি ওষুধ সংস্থা সানোফির সিইও পল হাডসনকে রেগেমেগে ডেকে পাঠান। কারণ হাডসন ঘোষণা করেছিলেন, আমেরিকা তাদের প্রচুর টাকা অনুদান দিয়েছে ফলে তারা যে কোনো প্রতিষেধক তৈরি করে নিজেদের ইচ্ছেমতো জায়গায় বিপণন করবেন। অন্যদিকে ব্রিটেনের ওষুধ সংস্থা আস্ত্রাজেনেকার সিইও পাসকাল সারিওট জাতীয়তাবাদী অবস্থান রেখেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁরা কোনো প্রতিষেধক তৈরি করলে, তা সবার আগে ব্রিটেনের মানুষের কাজে লাগাবেন।   

এই মুহূর্তে ১০০-রও বেশি প্রতিষেধক নিয়ে কাজ চলছে গোটা দুনিয়ায়। তার মধ্যে ১০টিতে মানুষের ওপর পরীক্ষার স্তরে কাজ চলছে। তার মধ্যে পাঁচটি চিনের। সেখানকার গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতিষেধক আবিষ্কার হলে আগে চিনের জনগণের কাজে লাগানো হবে। ব্রিটেন এবং আমেরিকার ক্ষেত্রেও বিষয়টা তেমনই। দুনিয়ার যে সব দেশ সবচেয়ে বেশি পরিমাণে প্রতিষেধক উৎপাদন করে, তাদের অন্যতম হল ভারত। এখানে যদি ভ্যাকসিন তৈরি হয়, তাহলে হয়তো রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারতীয়দের আগে তা নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হবে স্বাভাবিক ভাবেই।     

আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করে, আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, ব্রিটেন এবং জাপানের মতো বড়ো মাপের ওষুধ প্রস্তুতকারক দেশগুলি বিশ্ব স্বাস্থ্য সমাবেশের স্বেচ্ছা পেটেন্ট পুল সংক্রান্ত সুপারিশে সই করতে বাধ্য হয় (যার দ্বারা বিভিন্ন সংস্থা নির্দিষ্ট ওষুধের ক্ষেত্রে তাদের একচেটিয়া অধিকার স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিচ্ছে)।কিন্তু শর্ত ছিল, দোহা ঘোষণাপত্র বাতিল করতে হবে।

আরও পড়ুন: কোভিড-১৯-এর প্রতিষেধকের খোঁজে সাম্রাজ্যবাদীদের লড়াই চরমে

১৯৯০-এর দশকের তৈরি হওয়া এইডস সংকট থেকে ২০০১-এর দোহা ঘোষণাপত্রের জন্ম। সে সময় এইডসের ওষুধ ছিল অত্যন্ত দামি। ১৯৯০-এর মাঝামাঝি সদ্য গণতন্ত্র পাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকা, এইচআইভি-র জেনেরিক ওষুধ তৈরি করবে বলে প্রস্তাব দেয়। উত্তরে আমেরিকা তাদের ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর হুমকি দেয়।

এর উত্তরে দীর্ঘদিন এ নিয়ে আন্দোলন চালানোর মধ্যে দিয়ে, জনস্বাস্থ্য-আন্দোলনকারীরা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এ সংক্রান্ত চুক্তিটি সংশোধন করতে সফল হয়। যেটা দাঁড়ায়, তা হল, জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোনো জরুরি অবস্থা তৈরি হলে কোনো সরকারকে মেধাস্বত্ব রক্ষা করা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। এটাই হল দোহা ঘোষণাপত্র।

সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি অবশ্য এই ঘোষণাপত্রকে অবজ্ঞা করেই এসেছে। ফলে পৃথিবীর দরিদ্রতম অংশের লক্ষ লক্ষ মানুষের অকারণ মৃত্যু হয়েছে। শেষ অবধি অবশ্য আমেরিকা ও ব্রিটেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সমাবেশের সুপারিশকে বয়কট করে। যুক্তি ছিল পেটেন্ট পুল ‘গোটা দুনিয়ার কাছে একান্ত প্রয়োজনীয় সমাধানটি নিয়ে যারা কাজ করছেন, সেই আবিষ্কারকদের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছে দেবে’।

তখনকার মতো এখনও বৃহৎ ওষুধ সংস্থাগুলির কাছে মানুষের জীবনের থেকে মুনাফা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এপ্রিলে একটি মারাত্মক তথ্য প্রকাশিত হয়। তা হল, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যাওয়ার মুখে তিনটি সার্স ভ্যাকসিনের গবেষণায় অনুদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেগুলি আবিষ্কার হলে, সেগুলিও কোভিড-১৯ প্রতিরোধে কাজ করার সম্ভাবনা ছিল। বিষয়টা হল, ওষুধ আবিষ্কার করার থেকে প্রতিষেধক আবিষ্কারে খরচ অনেক বেশি। আর দুনিয়ার গরিবরাই হল প্রতিষেধকের মূল ক্রেতা। ফলে ওষুধ সংস্থাগুলি বিনিয়োগে অনিচ্ছুক।

ক্রনিক রোগের ওষুধের মতো প্রতিষেধক দীর্ঘদিনের ক্রেতাদের কাছে বারবার বিক্রি করা যায় না। ফলে বিনিয়োগ প্রকল্প হিসেবে এর আকর্ষণ কম। নোবেলজয়ী রোগ প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক পিটার দোহারটির কথায়, “প্রতিষেধক বেচে ওষুধ সংস্থাগুলির তেমন একটা লাভ হয়না। তারা পুঁজিবাদের নিয়ম ও মুনাফা দ্বারা চালিত। উপভোক্তা হিসেবে দেখা ছাড়া মানুষকে নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই”।

সাধারণ ভাবে বলাই চলে, কোভিড ১৯ একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং আন্তর্জাতিক ভাবেই এর মোকাবিলা করা উচিত। কিন্তু বাস্তবটা হল, প্রথম যে দেশ বেশি পরিমাণে কোভিডের প্রতিষেধক আবিষ্কার করবে, সে যে শুধু অন্যদের কয়েকমাস আগে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে ফেলবে, তাই নয়। পাশাপাশি রণনৈতিক মিত্র শক্তিদের বাছাই করে, সেইসব দেশগুলিতে আগে রফতানি করবে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রেও অ্যাডভান্টেজ পাবে।

এই ক্ষেত্রে সত্যিকারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পরিবেশ তৈরির আশা নেহাতই বাতুলতা। শেষ বিচারে, বিশ্ব পুঁজিবাদের অগ্রাধিকারের সঙ্গে মানুষকে বাঁচানোর কোনো সম্পর্ক নেই।

থি্ওডোর রুজভেল্টের নাবিকরা এ কথা বুঝতে পারেন, যখন ট্রাম্প প্রশাসন এ বছর কিছুদিন আগে জাহাজ থেকে নেমে যাওয়ার অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। জাহাজের কমান্ডার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আবেদন করেন, যাতে নাবিকদের গুয়ামে নেমে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। তিনি বলেন,“এখন কোনো যুদ্ধ হচ্ছে না। নাবিকদের মরবার কোনো প্রয়োজন নেই”। কিন্তু অতিমারির মধ্যেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরোমাত্রায় যুদ্ধের মধ্যেই রয়েছে। জাহাজের ক্যাপ্টেন বারবার নাবিকদের দাবি অগ্রাহ্য করার পর নাবিকরা প্রায় বিদ্রোহের অবস্থানে পৌঁছে যান। ক্যাপ্টেনের কার্যকলাপ ছিল সামরিক আগ্রাসনের সময়ের মতোই। যেসব ইরানি, ভেনেজুয়েলিয়ান, ইয়েমেনি, আফগান, ইরাকি বা সোমালি সেনাদের তারা মারতে যায়, তাদের মতোই যেন মার্কিন সেনাদের জীবনেরও কোনো দাম নেই।                  

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *