২০২০ সালের ৫জুন সরকার ঘোষিত সংস্কারমালার শেষ বিষয়টি হল চুক্তি চাষ। `the farmers ( empowerment and protection) Agreement on price assurance and farm service ordinance -2020`- এর মূল কথা হল —-
# একজন কৃষক কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির সঙ্গে লিখিত চুক্তি করবেন যাতে নির্দিষ্ট করে ফসল বিক্রির শর্ত, গুণমান,সময় ও পেমেন্টের বিষয়টির উল্লেখ থাকবে।
# কীভাবে পয়সা মেটানো হবে তা নির্দিষ্ট করে বলা থাকবে। যেমন বীজ বিক্রির ক্ষেত্রে সরবরাহের সময় ৬৬ শতাংশ ও বীজের শংসাপত্র লিখিত হয়ে যাওয়ার পর বাকি ৩৪ শতাংশ পেমেন্ট দেওয়া হবে।
# চুক্তির সময়সীমা ১ থেকে ৫ বছরের মধ্যে হবে।
# গোটা বিষয়টি তত্ত্বাবধান করবে রাজ্যস্তরের রেগুলেটরি বোর্ড।
# চুক্তিভঙ্গের আইনি প্রতিবিধান করার জন্য সেই বোর্ড একটি আইনি কাঠামো তৈরি করবে।
আরও পড়ুন: সংস্কার কর্মসূচি : ভারতীয় কৃষির সর্বনাশের নীল নকশা, পর্ব -২
মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে একটা কথা বলে নেওয়া ভাল যে নব্বই পরবর্তী ভারতের কৃষি ব্যবস্থায় চুক্তি চাষ কোন নতুন ঘটনা নয়। ২০০৩ সালে যে মডেল এপিএমসি অ্যাক্ট চালু হয়েছিল তাতে প্রথম চুক্তি চাষের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তখন থেকে কৃষিতে কর্পোরেট প্রবেশের সমর্থকরা বলতে শুরু করেন চুক্তি চাষ কৃষকদের জন্য ফসলের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করবে,কৃষক আর্থিক ভাবে লাভবান হবেন। আর আইনি প্রতিবিধানের প্রশ্নে অর্ডিন্যান্স পূর্ব সাম্প্রতিক একটি ঘটনার উল্লেখ করা প্রয়োজন। ২০১৯ সালে পেপসিকো চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে গুজরাটের কয়েকজন কৃষকের বিরুদ্ধে আদালতে ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করে। শেষ পর্যন্ত দেশজুড়ে কৃষক সংগঠনগুলোর প্রতিবাদের কারণে মামলাটি প্রত্যাহৃত হয়। তাই কৃষক ও কর্পোরেশনের আইনি লড়াইয়ে কৃষক কী অবস্থায় পড়বে তা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
ভারতে বিশ্বায়ন ও সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রথম দুই দশকে কৃষিতে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ করার লক্ষে সরকারগুলির পক্ষ থেকে বারবার চুক্তি চাষের কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের নীতিগত পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য দলিল হল ২০০০ সালে প্রস্তুত `Rationalisation of functions, activities and structre of the department of agriculture abd co- operation `। জয়েন্ট স্টক কোম্পানির মডেলে গঠিত এই দলিলে চুক্তি চাষের চারটি বিকল্পের কথা বলা হয়েছে। এই মডেলে বলা হয়েছে যেহেতু কৃষকের পক্ষে জমির মালিকানা অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয় তাই কৃষকদের জমির মালিকানা বহাল থাকবে অথবা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হবার পর শেয়ারের মাধ্যমে কৃষকের জমির ওপর অধিকার বজায় থাকবে। কৃষকদের কাছে একথা বলা হয়েছে যে নবগঠিত ফার্মের কৃষি কাজের সঙ্গে জমির মালিকদের যুক্ত রাখা হবে এবং কোম্পানির লাভের অংশ তারাও পাবেন। লভ্যাংশ পাওয়ার মাপকাঠি হবে হয় জমির পরিমাণের উপর অথবা ফার্মে তারা যে শ্রম দিয়েছেন তার ভিত্তিতে। যদিও বর্তমান অর্ডিন্যান্স এ ব্যাপারে বিশদ কোন ব্যাখ্যা উপস্থিত করেনি।
সাধারণ বিচারে চুক্তি চাষ বলতে বোঝায় এমন এক ব্যবস্থা যেখানে কৃষক (উৎপাদক) এবং কোম্পানি (ক্রেতা) একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হবেন। যে চুক্তিপত্রে লেখা থাকবে ফসলের দাম, গুণাগুণ,পরিমাণ ও ফসল দেওয়ার সম্ভাব্য তারিখ। এই চুক্তি মোতাবেক কৃষক ফসল সরবরাহ করবেন এবং কোম্পানি পূর্ব নির্ধারিত দামে তা ক্রয় করবে। চুক্তি চাষের সমর্থকরা প্রায়শই একথা বলে থাকেন যে চুক্তি চাষ কৃষক ও কোম্পানি উভয়ের কাছে এক লাভজনক ব্যবস্থা। কোম্পানি যেমন ফসলের জোগানের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকবে তেমনই কৃষকেরা ফসলের ন্যায্য দামের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকবেন। এই আশাবাদের উপর নির্ভর করে উদারীকরণের তিন দশকে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় চুক্তি চাষ শুরু হয়েছে। আমরা এবার বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চুক্তি চাষ সংক্রান্ত বহু প্রচারিত প্রতিশ্রুতিগুলিকে বিচার করব —–
উদা-১, নব্বই এর দশকের শেষ পর্বে অন্ধ্রপ্রদেশের চিত্তুর জেলার কুপ্পাম এলাকায় রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় মেসার্স বিএইচসি অ্যাগ্রো(ইন্ডিয়া) প্রাইভেট লিমিটেড কৃষকদের কাছ থেকে ২০০ একর জমি নিয়ে চুক্তি চাষ শুরু করে। এই চুক্তি চাষে অত্যন্ত ব্যয়বহুল ইজরায়েলি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। প্রতি একরে খরচ ধরা হয় ৫.৩০ লক্ষ টাকা, যার মধ্যে রাজ্য সরকারের আর্থিক সহযোগিতা ছিল ৪.৪৬ লক্ষ টাকা। কোম্পানি একর প্রতি ২০,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত বাৎসরিক ভাড়ায় কৃষকদের কাছ থেকে জমি নেয়। জমির সীমানাসূচক আলগুলি তুলে দেওয়া হয় ও সমগ্র জমিকে একটা অপারেশনাল হোল্ডিং-এ রূপান্তরিত করা হয় যাতে চাষের সময় ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহারে অসুবিধা না হয়।সেচের জলের জন্য বোরওয়েল প্রযুক্তিতে ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়। দুই ও তিন ফসলি চাষের বন্দোবস্ত করা হয়। কোম্পানি বলে রফতানি মূল্য আছে এমন শাক-সবজি শুধু চাষ করা হবে। চাষের সময় যথেচ্ছ ভাবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। কোন জৈব সার ব্যবহার করা হয়নি। দেখা যায় যে ইজরায়েলি প্রযুক্তি চাষের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে তা টৈঁকসই ( sustainable) নয় বরং পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকারক। চাষের কাজে সামান্য সংখ্যক জমির মালিক (কৃষক) লাগানো হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠরা অন্য জায়গায় কাজ খুঁজতে যেতে বাধ্য হয়। এমনকি প্রতিশ্রুতি মতো জমির ভাড়া বাবদ টাকাও কৃষকদের দেওয়া হয়নি। পরে রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপে ভাড়ার টাকা মেলে। শীঘ্রই বোরওয়েলের অবাধ প্রয়োগের ফলে ওই জমি ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ভৌমজলের স্তর নেমে যায়। যেটুকু লাভ হয় তার এক অংশও কৃষকদের মেলেনি। কৃষকেরা সংঘবদ্ধভাবে আন্দোলনে নামে। শেষ পর্যন্ত সরকার উদ্যোগ নিয়ে কৃষকদের বকেয়া মিটিয়ে দিতে বাধ্য হয় এবং প্রকল্পটি পরিত্যক্ত হয়।
উদা-২, ভারতে চুক্তিচাষের অগ্রণী সংস্থা পেপসিকোর চুক্তি চাষ সম্পর্কে পঞ্জাবের দুই কৃষকের অভিজ্ঞতা তাদের নিজেদের জবানিতেই শোনা যেতে পারে —
কুলবন্ত সিং সান্ধু: ৫ বছর আগে পেপসি সেই কৃষকদের খোঁজ করতে আসে যারা সাধারণ ধানের বদলে বাসমতী চাষ করছিল। তারা কুইন্টাল প্রতি দাম দেয় ৯৫০ টাকা। কোম্পানির আধিকারিকরা আমাদের বলে যে আর্থিক মন্দার সময়েও তারা আমাদের সাহায্য করবে। আমাদের গ্রামের বহু কৃষক তাদের সঙ্গে চুক্তি করে। যদিও তারা আমাদের যে বীজ দেয় তার দাম অনেক বেশি। একর প্রতি ২০০ টাকা জমি পরিদর্শন বাবদ ফি কোম্পানি আমাদের কাছ থেকে নেয়, যদিও সেই পরিদর্শন কখনো করা হয়নি। আমাদের উৎপাদন ব্যয় প্রায় দ্বিগুন হয়ে যায়। বাসমতী খামারে আসার পর কোম্পানি তার পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। বিশ্ববাজারে বাসমতীর চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে তারা গুণমানের দোহাই দিয়ে বেশিরভাগ ফসল কিনতে অস্বীকার করে। আমরা বিপদে পড়ি।
জগজিৎ সিং: বাসমতীর উৎপাদন ব্যয় খুব বেশি হলেও ফলন খুব কম। আমাদের লাভের পরিমাণ কম, এমনকি বেশ কিছু কৃষক ক্ষতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। কোম্পানি চুক্তির সময় দাম দিয়েছিল কুইন্টাল প্রতি ১০০০ টাকা। কিন্তু পরে গুণমান খারাপ — এই কথা বলে বাসমতীর দাম স্থির করে কুইন্টাল প্রতি ৮০০ টাকা। আমরা ওই দামেই বাসমতী বিক্রি করতে বাধ্য হই কারণ সরকার বাসমতীর ন্যূনতম সহায়ক মূল্য স্থির করে না। (তথ্যসূত্র: ফ্রন্টলাইন পত্রিকা)
উপরিউক্ত উদাহরণগুলি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং চুক্তি চাষের সমর্থকদের বহু কথিত আশাবাদের স্বরূপ উন্মোচনকারী।