Home জনস্বাস্থ্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে শ্রমিকদের অবস্থা বদলায়নি ১৭৫ বছরেও, দেখিয়ে দিল করোনা

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে শ্রমিকদের অবস্থা বদলায়নি ১৭৫ বছরেও, দেখিয়ে দিল করোনা

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে শ্রমিকদের অবস্থা বদলায়নি ১৭৫ বছরেও, দেখিয়ে দিল করোনা
0
ধীমান বসাক

“প্রত্যেক বড়ো শহরে একটি বস্তি, যেখানে স্তুপীকৃত হয়ে আছে শ্রমজীবী শ্রেণি। ধনীদের প্রাসাদের কাছেই অনেকসময় অন্ধকার গলিতে দারিদ্র্য বাস করে। কিন্তু সাধারণ ভাবে দরিদ্রদের বসবাসের জন্য সুখি শ্রেণির চোখের বাইরে কোনো এলাকা নির্দিষ্ট থাকে। এই বস্তিগুলো ছড়িয়ে আছে ইংল্যান্ডের সমস্ত বড়ো শহরেই। শহরের সবচেয়ে জঘন্য এলাকার সবচেয়ে জঘন্য বাড়িঘর।

একতলা কিংবা দোতলা চালাঘরের লম্বা সারি। কয়েদখানার মতো ঘুপচি, প্রায়শই এলোমেলো ভাবে তৈরি। তিন-চারটে ঘর আর একটা রান্নাঘর…এই হল শ্রমিক শ্রেণির বাসস্থান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাস্তা বাঁধানো নয়। অমসৃণ, নোংরা, শাকসবজি আর পশুর বর্জ্যে ভর্তি, নর্দমা বা মলমূত্র বেরনোর জায়গা নেই, তার বদলে আছে দুর্গন্ধ জমা জলের বিস্তার। এলোমেলো বানানোর ফলে হাওয়া চলাচল করে না। আর ছোট্ট জায়গায় অনেকে একসঙ্গে ঠুসে থাকার ফলে এই শ্রমজীবী মানুষের বাসস্থানের পরিবেশ সহজেই অনুমান করা যায়। ভালো আবহাওয়ায় রাস্তাগুলো হয়ে ওঠে শুকনোর জায়গা, এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে দড়ি টাঙানো, তাতে ঝোলে ভেজা কাপড়”!…..

আরও পড়ুন: সুরাট, বান্দ্রা, চেন্নাইয়ের জঙ্গি শ্রমিক বিক্ষোভ ছাড়া কি একজন শ্রমিকেরও বাড়ি ফেরা নিশ্চিত ছিলো?

ইংল্যান্ডের শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটতই না, যদি না তার হাতে আয়ারল্যান্ডের এক বিপুল এবং নিঃস্ব জনসমষ্টি থাকত। আইরিশদের নিজের দেশে কিছুই হারানোর নেই। বরং ইংল্যান্ডে এলে কিছু লাভের মুখ দেখতে পাবে। যখন থেকে শোনা গেছে সেন্ট জর্জ চ্যানেলের পুব পারে ভালো গতরের জন্য ভালো পয়সা মিলবে, তখন থেকে প্রতিবছর দলে দলে আইরিশদের স্রোত বয়ে চলেছে। দশলাখেরও বেশি ইতিমধ্যেই মাইগ্রেট করেছে, প্রতিবছর আসছে আরও পঞ্চাশ হাজার। অধিকাংশ ঢুকছে বড়ো শহরগুলোয় আর সেখানে শ্রমিকশ্রেণির সবচেয়ে নীচের অংশ হয়ে থাকছে। কার্লাইলের কথায়- রাস্তায় বেরোলে ঘোড়ার কোচোয়ান রাস্তা করে নিতে চাবুক চালায় এদের ওপর, এরা দাঁড়িয়ে থাকে টুপি খুলে ভিক্ষা নিতে, এরা লড়ে যাচ্ছে ইংরেজ শ্রমিকদের সাথে মজুরিতে, গায়ের শক্তি দিয়ে যে কোনো কাজ করতে সে তৈরি, যে দামটুকুতে আলু কিনতে পারবে সে,…। কার্লাইলের একপাক্ষিক একতরফা সমালোচনা বাদ দিলেও অবস্থাটা এরকমই। এর চার পেনির জন্য গাদাগাদি করে পশুর মতো আসে এখানে, সবচেয়ে খারাপ ঘরে থাকতে এরা রাজি, পোশাক নিয়ে মাথাব্যথা নেই, যতক্ষণ একটা দড়ি দিয়ে সেটা শরীরে আটকে রাখা যাচ্ছে, জুতো নেই, তাদের খাবার জুড়ে আলু, যা বাঁচে তা যায় মদে। এরকম জীবনে থেকে উঁচু মজুরির দরকার কী!

……এরা শুয়োর পালে আর সেটা ঘরের পাশেই, বাতাস হয়ে ওঠে দুর্গন্ধময়। এদের আসবাবপত্রের অভ্যেস নেই, একবোঝা খড়, কয়েকটা ছেঁড়া কাপড়েই তাদের চলে যায়। একটুকরো কাঠ, একটা ভাঙা চেয়ার, টেবিলের জায়গায় একটা পুরনো দেরাজ; একটা চায়েক কেটলি, কয়েকটা ডিশ আর পাত্র এই নিয়ে তার রান্নাঘর, যেটা তার শোওয়ার আর থাকবার ঘরও। বিনোদনের সব রাস্তা তার বন্ধ, এক মদ ছাড়া। আর কীই বা সে করবে? সমাজ কী করে দোষ দেবে যখন সমাজই তাকে এই অবস্থায় রেখেছে। যেখানে মদ খাওয়াটাই প্রায় এক আবশ্যিকতা। সমাজই তো তাকে গতরখাটা বন্যতায় ফেলে রেখেছে। এদের সাথেই বাধছে ইংরেজ শ্রমিকের প্রতিযোগিতা, কত কম মজুরিতে কাজ করা যায়। দক্ষ শ্রমিক এরা নয়, এরা রাজমিস্ত্রির কাজ করে, কুলি, ছুটকো কাজ, আর যত দলে দলে এসে এরা ভিড় জমায়, শ্রমিকের মজুরির হার নীচে নেমে যেতে থাকে, আর সব বড়ো শহরেই একই অবস্থা।

ইংল্যান্ডের এই অবস্থায় যদি সংক্রামক রোগ আসে, তার ফলাফল কী হবে? সে প্রশ্নে যাওয়ার আগে বলে নেওয়া দরকার, আগের বর্ণনাগুলো আমার লেখা নয়, এখনকারও নয়। ১৭৫ বছর আগে ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা’ প্রবন্ধে এসব কথা লিখেছেন।

চমকে উঠলেন। আশ্চর্যের কিছু নয়। অবস্থা কি কিছু পালটেছে আজকের ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা, ইতালি, স্পেন বা ভারতের শ্রমিকদের? কতটা পালটেছে? করোনায় তারা কেমন আছে?

আরও পড়ুন: জন্মের ২০২ তম বর্ষপূর্তিতে কার্ল মার্কসকে শ্রদ্ধা, ভিডিও

ব্রিটেন দিয়েই শুরু করা যাক।

ব্রিটেনে সাধারণ ব্রিটিশদের মধ্যে মৃত্যুর হারের প্রায় আড়াই গুন মৃত্যুর হার এই অভিবাসীদের মধ্যে বলে জানা যাচ্ছে(১)। এদেরকে বলা হয় BAME বা Black, Asian and Minority ethnic। ইনস্টিটিউট অফ ফিসক্যাল স্টাডিজের রিপোর্টে একথা বেরিয়ে এসেছে। যদি আলাদা আলাদা ভাগ করে দেখা যায় তাহলে হিসেবটা এইরকম- ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গদের থেকে কালো আফ্রিকানদের মৃত্যুর হার প্রায় ৩.৫ গুন, ব্রিটিশ পাকিস্তানিদের মধ্যে তা ২.৭ গুন, কালো ক্যারিবিয়ানদের মধ্যে তা ১.৭ গুন। শুধু তাই নয়, দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে আই.এফ.এস-এর গবেষক অর্থনীতিবিদ বলছেন যেখানে সাধারণত বৃদ্ধরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মারা যাচ্ছেন, সংখ্যালঘুদের মধ্যে তরুণদের মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে বেশি। কী কী কারণ হতে পারে এর? সেটা বলতে গিয়ে গবেষণাপত্রটি বলছে, কালো আফ্রিকানদের মধ্যে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, যা শ্বেতাঙ্গ মানুষের তুলনায় শতকরা ৫০ ভাগ বেশি। স্বাস্থ্য পরিষেবায় শ্বেতাঙ্গদের কর্মরত হওয়ার সম্ভাবনার চেয়ে পাকিস্তানি, ভারতীয় এবং কালো আফ্রিকানদের কর্মরত হওয়ার সম্ভাবনা যথাক্রমে ৯০, ১৫০, ৩১০ শতাংশ বেশি, অর্থাত তাদের ঝুঁকি বেশি। এই BAME জনসংখ্যার ১৩% হলেও মারাত্মক অসুস্থদের মধ্যে তাদের সংখ্যা প্রায় ৩৩%। প্রথম যে ১০জন ডাক্তার ব্রিটেনে মারা গেছেন, তারা সবাই এসেছেন BAME-এর থেকে। এ নিয়ে ব্রিটেন জুড়ে হইচই শুরু হওয়ায় সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে তদন্তের ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তদন্ত কি খুব জরুরি? আমরা কি বুঝতে পারি না কেন শ্রমজীবী মানুষ, বিশেষ করে অভিবাসী শ্রমিক ও জনসমাজ করোনার সংক্রমণের মুখে অসহায়?

ফ্রান্সে ১৮ এপ্রিল প্যারিসের শহরতলিতে এক হাঙ্গামা শুরু হয়। এক মটোরসাইকেল আরোহী রাস্তায় খালি পড়ে থাকা এক পুলিস ভ্যানের খোলা দরজায় ঘা খায় এবং ভাঙা পা নিয়ে তাকে এমারজেন্সিতে ভর্তি হতে হয়। এই ঘটনায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে প্যারিস এবং শহরতলিতে। দেখতে সাধারণ এই ঘটনা কিন্তু আমেরিকার ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা ২৫ এপ্রিলের এক প্রবন্ধে(২) লিখেছে যে, এ আসলে ফ্রান্সের গরিব এবং ঘিঞ্জি বসতির শহরতলির বৈষম্য সামনে চলে আসার ফল। সারা ইউরোপ যখন লকডাউনে ঘরে ঢুকে রয়েছে, তখন পাঁচদিন ধরে প্যারিসের শহরতলিতে এই সংঘর্ষ ঘটে চলেছে। অভিযোগটা মূলত পুলিশি জুলুমবাজির। কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, এর পেছনে রয়েছে করোনা সংক্রমণ ও লকডাউনের ফলে শ্রমিক শ্রেণির পরিবারের ক্ষোভের ফল। যে শ্রমিকশ্রেণির অনেকেই অভিবাসী আর তাদের বসবাস হল ঘিঞ্জি সরকারি বাড়িতে গাদাগাদি করে। শহরতলিতে বাস করা বাস ড্রাইভার, ডাককর্মী, মুদিখানার কর্মীদের নাগাড়ে কাজ করে যাওয়া, ঘিঞ্জি ঘরে দূরত্ব না বাঁচিয়ে টেনশনে জীবন কাটানোর ফল। প্যারিসের ঠিক উত্তরে সিন-সেন্ট-ডেনিস যার ডাকনাম ‘৯৩’, কারণ জায়গাটার প্রশাসনিক সংখ্যা তাই। এই জায়গাটা হল ফ্রান্সের দরিদ্রতম এলাকা। ফরাসি পরিসংখ্যান বিভাগের হিসেব অনুযায়ী এই ‘৯৩’-তে মার্চ-এপ্রিল ২০১৯-এর তুলনায় মার্চ-এপ্রিল ২০২০-তে মৃত্যুর সংখ্যা ১২৮% বেশি, যেখানে প্যারিসে ওই মৃত্যুবৃদ্ধির হার ৬৮% বেশি। সব মৃত্যু করোনাজনিত নয় ঠিকই, কিন্তু গরিব এলাকায় যে খাঁড়ার ঘা পড়ছে, তা পরিষ্কার। ফ্রান্সের বিখ্যাত Le Monde সংবাদপত্রে ছয়জন মেয়র ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি একটা চিঠিতে জানিয়েছেন, “এটা সত্য যে এখন, অসাম্যই সিন-সেন্ট-ডেনিসকে খুন করছে।…এই গভীর অবিচার, যাকে আর পাশ কাটানো যাবে না, তাকে সরাসরি মোকাবিলা করতে হবে, অতিমারির পরের যে নতুন বিশ্ব গড়ে উঠবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষরাও একই কথা বলছেন, তাতে বাজেট ছাঁটাইয়ের বুলির ফলে জীবন খসে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই”। এক স্কুলশিক্ষক বলছেন, এই ঘরবন্দি সমাজের বিপুল অসাম্যকে সামনে এনে দিয়েছে; একদিকে ইন্টারনেটে ক্লাস চলছে আর যাদের ইন্টারনেট নেই, তারা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে।

ইতালির প্রধান অর্থনৈতিক শহর হল মিলান। ইতালির উত্তরাংশে এই শহর, যে উত্তরাংশ আবার দক্ষিণাংশের থেকে সচ্ছল। মিলানের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি নির্ভর করে চিনের উহানের ওপর, সস্তা শ্রম ও উপকরণের জন্য। মিলানে প্রায় ৩০ লক্ষ চিনা নাগরিক বাস করেন। বেশিরভাগই শ্রমিক, কিছু দোকানিও আছেন। উহান থেকে সরাসরি বিমান আছে উহানের। কাজেই আশ্চর্যের কী যে, ইতালি ইউরোপে করোনা সংক্রমণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। মিলানে কাজ করা তরুণ শ্রমিকরা আবার আসে শহরতলি থেকে, তারা সেটাকে বয়ে নিয়ে গেছে গ্রামে, পরিবারের বয়স্কদের মধ্যে আর প্রথমেই শুরু হয়েছে মৃত্যুর মিছিল। নিউইয়র্ক টাইমসের ১৫ মার্চের একটি লেখায়(৩)পরিষ্কার স্বীকার করে নিচ্ছেন নিকোলে ইরেট, যে দারিদ্র্য যেমন বয়স্কদের নানা রোগে আক্রান্ত করে রাখে, করোনায় তারা সহজ শিকার হন, তেমনি দারিদ্র্যের কারণেই এদের তরুণরা বাইরে বেরোন, দূরে যান কাজের খোঁজে আর সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়ে। ওই লেখাতেই চাইনিজ সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে যে সমাজের গরিব মানুষের ক্রনিক রোগ থাকার সম্ভাবনা ১০% বেশি। আর করোনাভাইরাসে এই ক্রনিক রোগ থাকলে মৃত্যুর সম্ভাবনা ১০ গুন।

আমেরিকায় ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো, আমেরিকান-অভিবাসী বিভাজনকে করোনা সংকট একেবারে উলঙ্গ করে দিয়েছে। NPR পত্রিকার ১২ এপ্রিল সংখ্যার একটি লেখায়(৪)মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন জেনারেল ডা. জেরোম অ্যাডামসকে উদ্ধৃত করে বলেছে, অশ্বেতাঙ্গ মানুষেরা থাকেন ঘিঞ্জি এলাকায় এবং একসাথে বয়স্ক, শিশু সবাই মিলে থাকেন এবং তাদেরই ঝুঁকি সর্বোচ্চ। নিউইয়র্ক সিটির অফিসার জানিয়েছেন শ্বেতাঙ্গদের থেকে দ্বিগুন হারে অশ্বেতাঙ্গ মানুষেরা মারা যাচ্ছেন, মৃত্যুর শতকরা ৭০ ভাগ তারাই, তাদের জনসংখ্যার হারের দ্বিগুনেরও বেশি। পত্রিকাটি বলছে, এই গরিব শ্রমিকরা শুধু ঘিঞ্জিতে এবং সব বয়সের পরিবার নিয়ে থাকে তাই নয়, এরা যাতায়াত করে গণ পরিবহণে, যাতে ঝুঁকি আরও বেশি।

বোঝাই যাচ্ছে লেখার ধরন দেখে, ধনীরা ভয় পেয়েছেন। ভয় পেয়েছেন যে গরিবরা আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের মধ্যে আবার অশ্বেতাঙ্গরা বেশি। এরা তো মরবেই, আমাদেরও মারবে। এসব ঠেকাতে যে লকডাউন নামছে, তার ফলও আবার এরাই ভুগবে। এটা বোঝার জন্য কোনো অর্থনীতি বা সমাজবিজ্ঞানের গবেষক হতে হয় না।

এরা যে ভয় পেয়েছে, তার প্রমাণ বিজনেস ইনসাইডার পত্রিকার একটা লেখার হেডিং-এ, ২১ মার্চ-“করোনা সংক্রমণ এমন একটা সময়ে ধনী আর গরিবের ধ্বংসাত্মক ফারাককে প্রকাশ করে দিচ্ছে যখন আমেরিকায় শ্রেণিযুদ্ধের সম্ভাবনা ঘনিয়ে এসেছে”(৫)।তাতে লিখছে- ধনীরা করোনা টেস্ট করাচ্ছে বেসরকারি পরীক্ষা কেন্দ্রে পয়সা দিয়ে, সংক্রমণের এলাকা থেকে ব্যক্তিগত জেট বিমানে করে বেরিয়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যাচ্ছে। বাতাস শুদ্ধ করার ওষুধ আর মেশিন কিনছে হাজার হাজার ডলার দিয়ে, কিনছে ইবোলা হজমত স্যুট আর ৪০০০ ডলারের মংসের পিস; তখন জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি আমেরিকান কাজ হারানোর মুখে, সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণ ও দানে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। যারা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে, তাদের ঝুঁকি বাড়ছে। ব্যাঙ্ক আর কর্পোরেট কর্মচারীরা বাড়িতে বসে কাজ করছে আর ছোটো দোকানদার, ওষুধের দোকানের গরিব কর্মচারীরা সরবরাহ ঠিক করার জন্য কাজ করে যেতে বাধ্য হচ্ছে। বড়োলোকরা দিনপ্রতি ১০০ ডলার দিয়ে বাচ্চাদের গৃহশিক্ষক রাখছে, সরকারি স্কুল বন্ধ হওয়ায় গরিবের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছে। আমারিকায় স্বাস্থ্য প্রায় পুরোটাই বেসরকারি আর বিমা নেই শতকরা ৪০ ভাগ মার্কিনির। একটা তুলনায় সুবিধার জন্য বলা যেতে পারে- CBC রক্তপরীক্ষার জন্য যার বিমা আছে তার লাগবে ১১ ডলার, যার নেই তার ৩৬ ডলার। ওই পত্রিকাতেই বলা হয়েছে জনসাধারণের মধ্যে আবার শ্রেণিযুদ্ধের আহ্বান, বামপন্থীদের আহ্বান বাড়ছে।

ধনীদের পত্রিকা ফোর্বস ৩০ মার্চ এক প্রবন্ধে(৬)বলছে- সারা বিশ্বে আবার পুঁজিবাদ বিরোধীরা এককাট্টা হয়েছে এই আশায় যে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের মতোই এটা একটা সুযোগ। ২০০৮ সালে লোককে ওরা ভুল বুঝিয়ে দিয়েছিল, লোকের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে ওটা পুঁজিবাদের ব্যর্থতা। ওরা বলছে, তখন পুঁজিবাদ সামলে নিলেও এবার আর পারবে না। ওরা আওয়াজ তুলছে ‘সামাজিক মালিকানা’ আর ‘অর্থনৈতিক ক্ষমতার গণতান্ত্রিকীকরণ’-এর। ওরা চাইছে আসলে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ, কিন্তু ঘুরিয়ে বলছে সে কথা; রাষ্ট্রই তো আসল সমস্যা, যেখানে রাষ্ট্রের কাজ করার কথা, সেখানটায় নেই, যেখানে নাক গলানোর না, সেখানে নাক গলাচ্ছে রাষ্ট্র। রেগন ঠিকই বলেছিলেন। সাবধান হোন। একবার বামপন্থীরা ভুল বুঝিয়েছিল ১২ বছর আগে, আবারও করোনা সংকটে তারা সেই বক্তব্য তুলে ধরছে যে বাজারের ব্যর্থতাই এই সংকটের কারণ।

দুর্ভাগ্যবশত, তাদের ওই বক্তব্য বিশ্বাস করার সম্ভাবনা খুবই বেশি”।

আরও পড়ুন: চে গুয়েভারার রাজনীতির জন্যই তাঁকে নিশ্চিন্তে পণ্য বানাতে পারে সাম্রাজ্যবাদ

সারা পুঁজিবাদী দুনিয়া ভূত দেখছে। কমিউনিজমের ভূত!

এ লেখার প্রথমে দেওয়া এঙ্গেলসের ১৮৪৫ সালের ওই লেখার ৩ বছর পরেই কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস একসাথে লিখবেন ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’, যার ভূমিকায় লেখা ছিল- সারা ইউরোপ ভূত দেখছে, কমিউনিজমের ভূত! আর শেষ আহ্বান ছিল-শৃঙ্খল ছাড়া সর্বহারার হারাবার কিছু নেই, জয় করার জন্য আছে গোটা দুনিয়া।

শ্রমিকশ্রেণি, তার মধ্যেকার অভিবাসী শ্রমিকদের অবস্থান, শহরের, শহরতলির জনবিন্যাস, আর্থিক বৈষম্য, ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন দুনিয়ায় ১৭৫ বছর আগে যা ছিল, তাই যে মূলত আছে, আজকের করোনা সংকট তা পরিষ্কার করে দিয়েছে। পুঁজিবাদ যখন সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়ে উপনিবেশ নির্ভর হয়েছে, এই অভিবাসন আরও বেড়েছে, উপনিবেশ থেকে পুঁজিবাদী কেন্দ্রতে, গ্রাম থেকে শহরে আর ততই পুঁজিবাদ তার গঠনগত চরিত্রেও আরও বেশি করে এই অভিবাসী শ্রমিকের সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সে অভিবাসী শ্রমিকদের সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আবার নিপীড়িত, বৈষম্যপীড়িত পরিচয় বহন করেন।

দুদিন আগেই পেরিয়ে এসেছি কার্ল মার্কসের জন্মদিন। শ্রমিক শ্রেণির এই চিন্তানায়কের চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা কেউ কেউ বলেছিল শেষ হয়ে গেছে, ইতিহাসের শেষ হয়ে গেছে। উদারনীতিবাদের ক্ষণস্থায়ী সাফল্য আজ ভেঙে গেছে। করোনায় শুধু নয়, মানুষ মারা যাচ্ছে পুঁজিবাদের হাতে।

তাই আবারও নতুন করে সেই রণধ্বনি-

দুনিয়ার শ্রমিক এক হও!

দুনিয়ার শ্রমিক ও নিপীড়িত জনতা এক হও!           

তথ্যসূত্র:    

১. https://english.alaraby.co.uk/english/news/2020/5/1/uk-minorities-coronavirus-death-rate-twice-that-of-whites

২. https://www.google.com/amp/s/www.washingtonpost.com/world/europe/paris-suburbs-protests-villeneuve-la-garenne/2020/04/25/55f5a40c-85a1-11ea-81a3-9690c9881111_story.html%3foutputType=amp

৩. https://www.google.com/amp/s/www.nytimes.com/2020/03/15/world/europe/coronavirus-inequality.amp.html

৪. https://www.npr.org/2020/04/12/832455226/what-coronavirus-exposes-about-americas-political-divide

৫. https://www.businessinsider.com/coronavirus-exposes-disparity-could-spark-class-warfare-2020-3

৬. https://www.google.com/amp/s/www.forbes.com/sites/rainerzitelmann/2020/03/30/left-wing-intellectuals-are-thrilled-corona-and-dreams-of-the-end-of-capitalism/amp/   

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *