ডিসেম্বরের ৩১, ১৯৫৮। গভীর জঙ্গল এবং অসম্ভব খাড়াই পাহাড় অতিক্রম করে বারোজন বিপ্লবীর ক্লান্তিহীন বীরত্বপূর্ণ যাত্রার অবসান, চে-ফিদেল এর নেতৃত্বে কিউবার মুক্তি। সিয়েরা মায়েস্ত্রার সর্বোচ্চ চূড়া পিকো টুরকুইনো থেকে হাভানার রাজপথে কমাদান্তে চে গুয়েভারার সদর্পে আগমন। না, এখানেই এই বিদ্রোহীর যাত্রা শেষ হয়নি। কিউবা থেকে কঙ্গো, কঙ্গো থেকে গোপনে কিউবায় ফেরা, সেখান থেকে বলিভিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে শহিদের মৃত্যু বরণ।
আরও পড়ুন: জন্মের ২০২ তম বর্ষপূর্তিতে কার্ল মার্কসকে শ্রদ্ধা, ভিডিও
কমাদান্তে চের এই বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ থাকা সত্ত্বেও খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, কেন তাঁর এই পথ সাম্রাজ্যবাদীদের মনে আতঙ্ক তো সৃষ্টি করেই না বরং যেকোনো গণ আন্দোলনকে বিপথগামী করতে সাম্রাজ্যবাদীরা গুয়েভরাজমকেই ব্যবহার করে। মার্কস-লেনিন এবং মাও সে তুং-কে সাম্রাজ্যবাদীরা পণ্য হিসাবে হাজির করার সাহস দেখাতে না পারলেও গেঞ্জি- জাঙ্গিয়া-ট্যাটু সবেতেই গুয়েভারাকে তারা পণ্য করে এবং খুব সচেতন ভাবেই করে। এখন এটাই প্রশ্ন, কেন? এত বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ থাকা সত্ত্বেও কেন চে সাম্রাজ্যবাদীদের পণ্য হন?
লেনিন তাঁর দাদা সম্পর্কে বলেছিলেন দর্শনের বিচ্যুতি সত্ত্বেও সে ছিল একজন মহান বিপ্লবী। চে সম্পর্কেও একই কথা খাটে। যদিও চে-র সময় মার্কসবাদ বিকশিত হয়ে লেনিনবাদ- মাও সেতুং-এর চিন্তাধারায় পরিণত হলেও চে এই লাইনের বিরোধী নৈরাজ্যবাদী লাইনকে বিপ্লবের পথ হিসাবে সামনে নিয়ে আসেন যেখানে বিপ্লবী পার্টি এবং জনগণের কোনো ভূমিকা নেই। কয়েকজন সাহসী বিপ্লবের ইচ্ছায় বলীয়ান হয়ে ব্যবস্থা বদল করবে। জনগণ নয় বীরেরাই ইতিহাস তৈরি করে, এই হচ্ছে এই লাইনের মূল বক্তব্য।
সমাজতন্ত্রে পৌঁছবার পথ হিসাবে এখনো অবধি তিন ধরনের পথ সামনে এসেছে, (১) মার্ক্সবাদ (২) সংস্কারবাদ (৩) নৈরাজ্যবাদ। মার্কসবাদ প্রথম দিন থেকেই শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ- এই সংস্কারবাদী পথ এবং আবার জনগণ নয়, উন্নত অস্ত্রের সাহায্যে কয়েকজন ব্যক্তি সমাজ বদল ঘটাবে- এই দুই ধরনের সংশোধনবাদী ধারার বিরুদ্ধে লড়াই করে এসেছে।
সংস্কারবাদের মূল প্রবক্তা বার্নস্টাইন। এই মতবাদ শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের কথা বলে। পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে ‘তিন শান্তি তত্ত্বের’ মধ্যে দিয়ে বার্নস্টাইনের সংস্কারবাদকে তাত্ত্বিক রূপ দেয় ক্রুশ্চেভ। এই তিন শান্তির ফেরিওয়ালাদের বিরুদ্ধে কমরেড মাও-এর নেতৃত্বে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি, আলজেরিয়ান লেবার্স পার্টি সহ কয়েকটি কমিউনিস্ট পার্টি রুখে দাঁড়ায় এবং কমরেড মাও-এর নেতৃত্বে মতাদর্শগত বিতর্ক চালায় যা আন্তর্জাতিক মহাবিতর্ক নামে পরিচিত।
ঊনবিংশ শতাব্দীর আটের দশকে প্রকৃতি ও সমাজ বিকাশের নিয়মের বিজ্ঞান হিসাবে, নিপীড়িত ও শোষিত জনতার বিপ্লবের বিজ্ঞান হিসাবে, সমস্ত দেশে সমাজতন্ত্রের বিজয় এবং সাম্যবাদী সমাজ গড়ে তোলার বিজ্ঞান হিসাবে মার্কসবাদকে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়েছে সারা ইউরোপ জুড়ে সেই সময় প্রুধোঁর পেটি বুর্জোয়া নৈরাজ্যবাদী সংশোধনবাদী অতিবাম ধারার বিরুদ্ধে লড়াই করে। পার্টি গঠনের প্রশ্নে, কর্তৃত্ব প্রশ্নে, বিপ্লবে জনগণের বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে কৃষকের ঐক্যের প্রশ্নে প্রুধোঁর এই নৈরাজ্যবাদী লাইন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টি ভঙ্গির বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করে। এই নৈরাজ্যবাদী ধারার মূল কথা হল ইতিহাস সৃষ্টি করে কয়েকজন ব্যক্তিবিশেষ (উন্নত অস্ত্রের সাহায্যে), জনগণ নয়। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে এই ধারারই বিকশিত রূপ দেখি গুয়েভরাজম এর মধ্যে। বক্তব্য একই থেকে যায়, প্রুধোঁজম ফুকো-দ্রেব্যে-গুয়েভরাজমে পরিণত হয়। প্রুধোঁ থেকে চে বিপ্লবী পার্টি গড়ার পক্ষে নয়, তাদের মতে ছোটো কয়েকজনের ফৌজ ছোটো ছোটো আঘাতের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র শক্তিকে ঘায়েল করবে। মেহনতি জনগণের ভূমিকা এখানে দর্শকের। স্বাভাবিক ভাবেই এই ধরনের উদ্যোগকে ধ্বংস করা সুবিধাজনক। তাই সাম্রাজ্যবাদীরা চে-কে ভয় পায় না। তাকে নিশ্চিন্তে পণ্য করে ফেলে।
কিছু লোক বিশ্বাস করেন মার্কসবাদ এবং নৈরাজ্যবাদ একই নীতি থেকে উদ্ভূত, পার্থক্য খালি কৌশল নিয়ে। এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। এই প্রসঙ্গে কমরেড স্ট্যালিন বলছেন, নৈরাজ্যবাদই মার্কসবাদের প্রকৃত শত্রু(‘নৈরাজ্যবাদ, না সমাজতন্ত্র’)। ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লবী লাইনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড চারু মজুমদার চের এই লাইনকে নৈরাজ্যবাদী বাম বিচ্যুতি বলেই ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর সপ্তম দলিলে। আর বাম বিচ্যুতি আর সংস্কারবাদী ডান বিচ্যুতি দুটোই সংশোধনবাদী ধারার একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ, যা শাসক শ্রেণির স্বার্থই রক্ষা করে। মার্কস-লেনিন-মাওয়ের অনুশীল করা পথের বিরোধিতা অতীত থেকে আজ অবধি শুধু সংশোধনবাদী নয়া সংশোধনবাদীদের কাছ থেকেই এসেছে তা নয়, সশস্ত্র সংগ্রামের লাইন নেওয়া প্রুধোঁ থেকে গুয়েভরাজম- এই নৈরাজ্যবাদী ধারা থেকেও এসেছে। এই কারণেই স্ট্যালিন নৈরাজ্যবাদকে মার্কসবাদের প্রধান শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা প্রুধো থেকে চে গুয়েভরাজম কে চিহ্নিত করেছে ‘সশস্ত্র সংশোধনবাদী’ ধারা বলে।
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে ক্রুশ্চেভিও শান্তিবাদ, গুয়েভরাজমের অস্ত্রবাদ- এই দুই সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেই মার্কসবাদ লেনিনবাদের সর্বজনীন সত্যের সাথে চিন বিপ্লব ও আন্তর্জাতিক সর্বহারা বিপ্লবের সমন্বয় ঘটিয়ে কমরেড মাও মার্কসবাদ লেনিনবাদের দর্শন, রাজনৈতিক অর্থনীতি, সামরিক বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের লাইনকে উচ্চ স্তরে বিকশিত করেন, বিপ্লবী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধ বিকশিত হয়। সংস্কারবাদী তিন শান্তির তত্ত্ব এবং নৈরাজ্যবাদী গুয়েভরাজম- এই দুই সংশোধনবাদী ধারার বিরুদ্ধে লড়াই করেই মাও তাঁর সামরিক লাইন যার সার বস্তু হল দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধ, সাংগঠনিক লাইন যার মৌলিক ভিত্তি হল পার্টি, গণফৌজ এবং যুক্তফ্রন্ট এই তিন জাদু অস্ত্রের গঠন করেন, যা মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের অস্ত্রাগারে এক অনন্য অবদান। নৈরাজ্যবাদী গুয়েভরাজমের বিপরীত বিপ্লবী গণলাইন হিসাবে কমরেড মাও ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষকদের ভূমিকাকে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সামনে নিয়ে আসেন। চে গুয়েভরাজমে ভূমিহীন কৃষকের বিপ্লবে কোনো ভূমিকা নেই, আছে শুধু কয়েকজন ব্যক্তি বা ছোটো আর্মি- যারা বিপ্লব ঘটাবে। আর মার্কসবাদী লেনিনবাদী লাইনকে কমরেড মাও আরো দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন, জনযুদ্ধে ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণের লাইনকে সামনে নিয়ে এসে। তিনি প্রমাণ করলেন জনযুদ্ধে অস্ত্র নয় জনগণই নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে। ‘প্রত্যেক নাগরিক একজন সৈনিক’- মাও-এর এই স্লোগান গেরিলা যুদ্ধকে গভীরতায় ও ব্যাপকতায় প্রসারিত করে। মাও-এর শিক্ষা পার্টি বন্দুককে নিয়ন্ত্রণ করবে, বন্দুক পার্টিকে নয়। এই সব কারণেই বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিপ্লবীরা ক্রুশ্চেভিও এবং গুয়েভরাজম এই দুই সংশোধনবাদী ধারার বিরুদ্ধে লড়াই করেই (পার্টির বাইরে এবং ভিতরে) মার্কস-লেনিন-মাওয়ের শিক্ষাকে পাথেয় করে কমিউনিস্ট বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলছেন। তারা ঘোষণা করছেন মার্কস-লেনিন-মাওয়ে্র শিক্ষা এক অখণ্ড সত্তা, একে আংশিক ভাবে গ্রহণ বা অনুশীলন করা যায় না।
Relevant post.