পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: মাওবাদীরা যে অবস্থান বদল করছে, তার আঁচ প্রথম মিলেছিল গত সেপ্টেম্বরে। ১৩ অক্টোবর ঝাড়খণ্ডে যে নির্বাচন বয়কটের আহ্বান তারা দিয়েছিল, তাতেও ছিল একই বার্তা। বিজেপি বিরোধী দলগুলো সম্পর্কে সেখানে বলা হয়েছিল, “ফ্যাসিবাদ মাওবাদীদের আক্রমণ করছে বলে বিরোধী নেতারা শান্ত হয়ে বসেছিল, যখন ফ্যাসিবাদ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করেছে তখনও তারা চুপ করে থেকেছে, তারপর যখন ফ্যাসিবাদ শ্রমিকদের অধিকারও কেড়ে নিতে শুরু করল তখনও তারা কথা বলেনি তাই জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে”। এই বক্তব্যের পাশাপাশি মাওবাদীদের পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরো বিরোধী নেতাদের বলেছিল, “ক্ষমতার লোভ ত্যাগ করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নিজেরা কে কী অবস্থান নেবেন, সেটা ঠিক করুন, জনগণের পক্ষে কাজ করা শুরু করুন। সে দিন আর দূরে নয়, যখন আমরা সবাই একজোট হয়ে সমস্ত ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাজিত করতে পারব”। তাদের এই অবস্থান পরিবর্তন সম্পর্কে এবার বিস্তারিত ভাবে টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে জানিয়েছেন মাওবাদীদের পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরোর মুখপাত্র সঙ্কেত।
সঙ্কেত বলেছেন, দেশে ‘রাজনৈতিক সংকট তীব্র হতে চলেছে’। এই পরিস্থিতিতে ‘ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ ও আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের’ বিরুদ্ধে সারা দেশজুড়ে যুদ্ধ চালাতে দেশের সকল বিজেপি/আরএসএস বিরোধী শক্তিকে সমর্থন করবে সিপিআই(মাওবাদী)। বিজেপি/আরএসএস বিরোধী সকল রাজনৈতিক দলকে সমর্থনের এই সিদ্ধান্ত পার্টির ভেতর দীর্ঘ আলোচনার পরই নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছিন সঙ্কেত। তাঁর কথায়,”কমিউনিস্ট হিসেবে আমরা সবসময়ই এই ভোটের রাজনীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু আজকের সংকট অনেক বড়ো। সাম্যবাদের প্রধান শত্রুকে আমাদের চিহ্নিত করতেই হবে।” তাঁরা কি ভোটের লড়াইতে বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলিকে সমর্থন করবেন? এই প্রশ্নের উত্তরে সংঙ্কেত স্পষ্ট জানিয়েছেন, কোন কোন নীতির ভিত্তিতে তারা সকল সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও জনদরদি শক্তিগুলিকে এক মঞ্চে জড়ো করতে চান।
“আগের বিজেপি সরকার এবং বর্তমান বিজেপি সরকারের প্রথম তিন মাসে জনগণের স্বাধীনতার ওপর একের পর এক আক্রমণ নেমে এসেছে। বাজেট অধিবেশনে সংসদে ৩৮টি বিল পাস করানো হয়েছে, সেগুলির মধ্যে বেশিরভাগেরই লক্ষ্য জনগণের অধিকারগুলো কেড়ে নেওয়া এবং কর্পোরেট এবং বিদেশি সংস্থাগুলিকে আমাদের সম্পদ লুঠ করার সুযোগ করে দেওয়া” বলেন সঙ্কেত। এই প্রসঙ্গে তিনি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল সংশোধনী বিল, এয়ারপোর্ট ইকনমিক রেগুলেটরি অথোরিটি অফ ইন্ডিয়া সংশোধনী বিল, শ্রমিকদের অধিকারকে সুরক্ষিত করার জন্য থাকা পুরনো আইনগুলি তুলে দিয়ে বেতন, কর্মস্থলে সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও কল্যাণ ইত্যাদি কোড চালু করা, ইউএপিএ সংশোধনী বিল, এনআইএ সংশোধনী বিল সহ বেশ কয়েকটি বিলের উল্লেখ করেন।
সঙ্কেত বলেন, ‘বিজেপি-আরএসএস সরকার’-এর জনবিরোধী নীতির ফলে দেশে অভূতপূর্ব আর্থিক মন্দা তৈরি হয়েছে, ব্যাপক ছাঁটাই হচ্ছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এবং এর ফলে জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। এটা কেন্দ্রীয় সরকার জানে, তাই তারা ইউএপিএ এবং এনআইএ-র মতো জনবিরোধী আইনগুলিকে সংশোধন করেছে, যাতে সেগুলি, সরকারের যারা বিরোধিতা করবে, তাদের ওপর প্রয়োগ করা যায়। “মানবাধিকার কর্মী এবং যারা আদিবাসী ও দলিতদের হয়ে কাজ করছেন, তাদের জেলে পোড়া হচ্ছে, সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। ঝাড়খণ্ডের স্ট্যান স্বামী একজন উদাহরণ”, বলেন সঙ্কেত।
ঝাড়খণ্ডের খুঁটি জেলায় আদিবাসীরা নিজেদের ‘আইনি ও সাংবিধানিক অধিকার’ দাবি করায় তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা করা হয়েছে, গেরুয়া বাহিনীর ‘গুন্ডা’রা একের পর এক গণপিটুনি ও হত্যার ঘটনা ঘটাচ্ছে- এইসব উদাহরণ দেখিয়ে বিজেপি-বিরোধী দলগুলির কাছে মাওবাদীদের প্রশ্ন, “তারা কি এই পরিস্থিতিতে নিরাপদ বোধ করছেন”? সঙ্কেত বলেন, “আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, ফ্যাসিবাদী সরকারের নিপীড়নমূলক নীতির বিরুদ্ধে গলা তুলতে বিরোধী দলগুলো ভয় পাচ্ছে। ইতিহাস বলছে, একমাত্র কমিউনিস্টরাই এই ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে মুখোমুখি লড়াই করতে ভয় পায় না”।
মাওবাদীদের আশা, বিজেপির যেসব রাজনৈতিক বিরোধীরা সংসদ ও বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে কথা বলতে পারছেন না, তারা মাওবাদীদের ডাকে ইতিবাচক সাড়া দেবেন। বিজেপি-বিরোধী দলগুলিকে কাশ্মীরের দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে সঙ্কেত বলেন, “আরএসএস চালিত মোদী-শাহ সরকার যখন কাশ্মীরের ওপর সন্ত্রাস নামানোর এবং সেখানকার জনগণের ন্যায্য অধিকার কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, তখন তারা সেখানকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পর্যন্ত বন্দি করল এবং এখনও বন্দি করে রেখেছে। কমিউনিস্টরাই একমাত্র অত্যাচার ও প্রকৃত গণতন্ত্রের লক্ষ্যে যাত্রাকে ধ্বংস করার চেষ্টার বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করছে।”
ভোটের রাজনীতিতে মাওবাদীরা কি কোনো দলের সঙ্গে জোট বাঁধবে? এই প্রশ্নের উত্তরে পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরোর বক্তব্য, ‘প্রধান শত্রুকে দুর্বল করার পর’ নিজেদের মধ্যে সমস্যা মেটানো যাবে। সঙ্কেত বলেন, “আপাতত, যারা সাধারণ মানুষের স্বার্থে কাজ করছেন, তাদের আসন্ন বিপদকে উপলব্ধি করতে হবে এবং একসঙ্গে কাজ করার জন্য আমাদের এই আহ্বানে সাড়া দেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে হবে”।
..