মালবিকা মিত্র
একলা জগাই নিজেই পাগল। নিজেই নিজের অমর কীর্তি লিখে চলে। অনেকটা “পাগল হইয়া বনে বনে ফিরি আপন গন্ধে মম, কস্তুরীমৃগ সম” গোছের । এবার বামেরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সেই কবে থেকে এই কথাটাই শুনছি। এবারেও ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে এ কথাটাই শুনলাম। প্রচারই সার, বাস্তবে কিছু হলো না। ফলাফল অশ্বডিম্ব। যেহেতু সংসদীয় রাজনীতিতে নির্বাচনের সাংসদ বিধায়ক পদ জেতাটাই নির্ণায়ক হয়, তাই বলছি ফলাফল অশ্বডিম্ব।
আগে বলি ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পের ধাপগুলো। নির্বাচন ঘোষণার আগেই মীনাক্ষীর ডাকে যুব ব্রিগেড অনুষ্ঠিত হলো। ব্রিগেডে সাজোসাজো রব। মঞ্চে কোনো পলিতকেশ নেতার উপস্থিতি ছিল না। সব নতুন প্রজন্মের ছাত্র যুবনেতা। এমনকি বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র মাঠে দর্শক আসনে বসে। এবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে পার্টি। মনে পড়লো এই ব্রিগেডের চেয়ে অনেক অনেক বড় ব্রিগেড জমায়েত হয়েছিল ২০২১-এ আব্বাস ভাইজানকে নিয়ে। সেই বিধানসভায় পার্টির ভোট ছয় শতাংশের আশেপাশে। আসন সংখ্যা শূন্য। একটা ব্রিগেডের জমায়েত, এটা বিশেষ কিছু প্রতিফলিত করে না। ব্রিগেডে এসইউসি-র জমায়েতটা ভেবে দেখুন। আর এবারের নির্বাচনে এসইউসি সম্ভবত নোটার চেয়ে কম ভোট পেয়েছে।
তাছাড়া জমায়েতের ক্ষেত্রে বাম দলগুলির একটা বৈশিষ্ট্য আছে আমার নিজের অভিজ্ঞতায় জানি। যখন মিছিলে বা মিটিংয়ে যেতাম বাড়িতে তালা দিয়ে মা বাবা, ভাই বোন, সবাই বেরিয়েছি। অর্থাৎ বামেদের সভায় যে জমায়েতটা প্রত্যক্ষ করেন সেটাই তাদের অপটিমাম বা চরম লেভেল। ওটাকে দেখে ভোটবাক্সকে অনুমান করা যাবে না। আমার মনে আছে উত্তরপ্রদেশে কানপুরে সিসামৌ নির্বাচনক্ষেত্রে সিপিএম প্রার্থী ছিল দৌলত রাম। ওখানে প্রচুর বাঙালির বাস। কারণ কানপুর হলো জে কে সিংহানিয়া কোম্পানির সদর দফতর। জে কে জুট, জে কে কটন, জে কে রেয়ন। আর পশ্চিমবাংলায় আমাদের হুগলি জেলায় বিখ্যাত জে কে স্টিল। ফলে হুগলি ও পার্শ্ববর্তী জেলার বহু বাঙালি সদর দফতরে চাকরি করেন। তাছাড়াও রিষড়ায় ইন্ডিয়ান এক্সপ্লোসিভ লিমিটেড আইইএল-এর সদর দফতর কানপুরে। ইছাপুর কাশিপুর গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরির বহু মানুষই কানপুরে আরমাপুর এস্টেটে বসবাস করেন ও সেখানে গান এন্ড সেল ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। ঐতিহ্যগতভাবে একটা বাঙালি বসতি গড়ে উঠেছে সেখানে পান্ডুনগর, শাস্ত্রীনগর, লালবাংলা বস্তি, এলগিন ওয়ান, এলগিন টু, চমনগঞ্জ, মূলগঞ্জ এই সমস্ত এলাকায়।
মনে আছে নির্বাচনী প্রচার দেখে আমি অভিভূত। হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণ। আমাদের প্রার্থী সিআইটিউ নেতা দৌলত রামের জয় নিশ্চিত। ঘরে ঘরে পোস্টার লেখা, ঝান্ডা সেলাই করা, ডান্ডা তৈরি করা, দেয়াল লেখা, ছোট ছোট গ্রুপে আট দশটা পরিবার নিয়ে সভা করা, আর আছে কেন্দ্রীয় মিছিল। এসবে আমি আপ্লুত ছিলাম। গণশক্তি পত্রিকাতে একটা রিপোর্ট পাঠিয়েছিলাম, কানপুরে সিপিআইএম প্রার্থীর জয় সুনিশ্চিত। বিপক্ষ দলের কংগ্রেস প্রার্থী কমলা দরিয়াবাদী, তার কোন প্রচার নেই, কিছুই নেই। একদিন একটা রোড শো দেখেছিলাম। যাই হোক, ভোট শুরুর আগেই প্রচারপর্ব শেষ হতেই আমি বাংলায় ফিরে আসি। তারপর ফলপ্রকাশের পর জানলাম সিপিআইএম প্রার্থী দৌলত রাম ৩৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন। পরে উপলব্ধি করেছিলাম বামপ্রার্থীর যে শো আমি দেখেছি, সেটাই অপটিমাম, চরম লেভেল। মিছিল মিটিংয়ে আমার সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ, তার অধিক আর কিছু ছিল না। সেটাই ভোট বাক্সে প্রতিফলিত হয়েছে। তাই বলছিলাম বামপন্থীদের প্রচারের বহিরঙ্গ দেখে জনমতের আন্দাজ লাগানো যায় না।
এবার বলি, কেন একলা জগাই। সিপিএমের একটা ফেসবুক পোস্ট আমাকে একজন হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালো। দীপ্সিতা ধরের একটা অসাধারণ সুন্দর ছবি ফটোশপে রীতিমতো এডিট করা। সেখানে লেখা হয়েছে আহা, ওই মেয়েটা কে গো! অমন সুন্দর মুখশ্রী, নাম বুঝি কৃষ্ণকলি! ও তো আমাদের ঘরের চেনা সেই মেয়ে। একেবারে বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইন। এটা পোস্ট করে বামকর্মীরা নিজেরাই ভাবতে থাকলো এটা মানুষের ভাষ্য। আরও বড় কথা হলো, মুখ নয় অভিমুখ বলেও, সেই মুখশ্রীকেই প্রচারের হাতিয়ার করলাম। সুন্দর কুৎসিত কালো ফর্সা ইত্যাদি বিভাজন। মানুষ এ কথা বলেছে? ওটা যে মানুষ বলছে না, ভাবছে না, আমি ভাবছি, একলা জগাই। সেটা কে বোঝাবে। আমি বয়সের কারণে খুব একটা বাইরে বেরোতে পারি না। কিন্তু ফোনের মাধ্যমে পুরনো পরিচিত বহু মানুষের সাথে কথা বলি। নাড়ির স্পন্দন পেতে চেষ্টা করি। লিলুয়ার একাধিক মানুষ তারা আমাকে প্রথম জানালো দীপ্সিতা হলো পদ্মনিধি ধরের নাতনি। মুখটা নতুন হলেও, ওর ট্রাক রেকর্ড পুরনো। ওর দাদু এই অঞ্চলের চাকরিবাকরি ও অন্যান্য নানানরকম বিষয়ে খুব সুনামের অধিকারী নয়। তার দু-একটা নমুনাও শোনালেন। আমাকে বলেছিল হুগলিতে ও কৃষ্ণকলি হতে পারে, ডোমজুড় জগৎবল্লভপুরে মানুষ ওকে চেনে। ওর দাদু ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১-এ ডোমজুরের তিনবারের বিধায়ক। পার্টির পূর্ব পরিচিত দুই একজনকে আশঙ্কার কথাটা জানিয়েছিলাম। তারা গুরুত্ব দেয়নি। ভেবে দেখুন দীপ্সিতা ধর সিপিআইএম প্রার্থী, উত্তরপাড়ায় প্রায় ২৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে শ্রীরামপুরে, চাপদানিতে ও চন্ডিতলায় ২১ শতাংশ, ১৯ শতাংশ ও ২২ শতাংশ ভোট পেল। কিন্তু ভরাডুবি ডোমজুড় ও জগৎবল্লভপুর। ভাবতে পারেন চুঁচুড়া, সপ্তগ্রাম ও বলাগড় বিধানসভায় তৃণমূল দল এই নির্বাচনে পরাস্ত হয়েছে। বিজেপি জয়ী হয়েছে। কিন্তু কোথাও সিপিআইএম তার ভোট বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়নি। সামান্য কিছু বেড়েছে চুঁচুড়ায়। কারণ সিপিআইএম প্রার্থী মনোদীপ ওখানেই থাকে।
তাই বলছি জমায়েত কিছু প্রমাণ করে না। নতুন প্রজন্ম নতুন মুখ তাতেও কিছু যায় আসে না। ভাবা যায় চন্দননগর বিধানসভায় ২০২১-এ সিপিআইএম প্রার্থী গৌতম সরকার জমানত খুইয়ে পেয়েছিল প্রায় ৩৩ হাজার ভোট। আর এ বছর ঘুরে দাঁড়ানোর বছরে তরুণ নেতা, নতুন মুখ, কোনও দুর্নামহীন মনোদীপ ঘোষ। পেল কিনা ২৩০০০ ভোট। পার্টি বুথ ধরে ধরে, এলাকা ধরে ধরে, কোনদিনই আলোচনায় বসবে না। অথচ মনোদীপের নাম ঘোষণার পর থেকেই আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল। কারণ ছেলে হিসেবে অত্যন্ত ভালো ছেলে। ওর বাবার সাথেও আমার পরিচয় ছিল। আমি দেখেছি ভদ্রেশ্বর এলাকায় কত সিপিআইএম কর্মী সদস্য, পার্টির সদস্য, তাদের ভেতর কোন সক্রিয়তা নেই। লকেট চট্টোপাধ্যায়ের রোড শো দেখার জন্য দৌড়ে দৌড়ে ছুটে ছুটে সিপিআইএম সদস্য-সমর্থকদের যেতে দেখেছি উন্মাদনা নিয়ে। দু-একজন নেতাকে ফোন করে জানিয়েছি ভদ্রেশ্বরে একটু নজর দাও। শোনেনি। ভদ্রেশ্বর পৌর এলাকায় ২০২১-এ ১০৪৪৩ ভোটের সাথে ২০২৪-এ প্রাপ্ত ৬০৮৭ ভোট দেখার পরে আপনি বলবেন এটা ঘুরে দাঁড়ানো? সামান্য কিছু এলাকায় বিজেপিতে ট্রান্সফারড ভোট সিপিএম ফিরে পেলেও, বহু এলাকাতেই এখনো ভোট ট্রান্সফার হওয়া চলেছে। চন্দননগর কর্পোরেশনে একইভাবে প্রায় ছয় হাজার ভোট কম পেয়েছে মনোদীপ। ২০২১-এ সিপিএম প্রার্থী গৌতম সরকারের নিজের পৌর ওয়ার্ডের হিসেবটা উৎসাহব্যাঞ্জক :-
সাল বুথ(২৪০) বুথ(২৪১) বুথ(২৪২) বুথ(২৪৩)
২০২১ ২২২ ২৭৪ ৩১৯ ১৪৫
২০২৪ ১০৩ ১৩৭ ১৪৫ ৪৮
আসলে সমস্যাটা অন্যত্র আমার দুই ছাত্র বিদ্যালয়ে ছিল অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু। তারা দুজনেই প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হলো। একজনের বাড়ি হুগলি অন্যজন নৈহাটি। এরপর যখন এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম কী খবর? তোর বাকি অর্ধেকের খবর কী? সে সখেদে বলল, ওর কথা আর বলবেন না। বামপন্থী রাজনীতি নিয়ে বেশ ব্যস্ত থাকে। আর জানেন তো, প্রেসিডেন্সির বামপন্থীরা নিজেদের একটা ভিন্নজগৎ তৈরি করে। সে জগতে আমি প্রবেশ করতে পারিনা, করলেও স্বচ্ছন্দবোধ করি না। আসলে যাদবপুর প্রেসিডেন্সিতে বামপন্থীরা মার্ক্স এঙ্গেলস লেনিন পড়ে সামান্য। তার থেকে বেশি পড়ে আলথ্রুজার, গ্রামশি, ওয়াল্টার বেনজামিন, লুকাচ, মিশেল ফুকো,দেরিদা এইসব। বলতে পারেন মার্কস লেনিন দিয়ে এরা শুরু করে না। এরা আলথ্রুজার থেকে শুরু করে, হয়তো মার্কস লেনিন পড়েই না। এরা “আমাদের তত্ত্বকথা” … “আমাদের বিজ্ঞান” ….. “আমাদের রুচিশীলতা” …. “আমরা একমাত্র সত্য” … এসব নিয়ে নিজেরাই আত্মগর্বী। ছাত্রের কথায় বুঝেছিলাম, কেন ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটা গল্পই থেকে গেল, সৃজন দীপ্সিতা সবাই একলা জগাই।
পুরনো মুখ পাল্টালেও অভিমুখ পাল্টাচ্ছে না। এমনকি সিপিআইএম প্রার্থীর পোস্টারে স্লোগান ছিল “মুখ দেখে নয় অভিমুখ দেখে” ভোট দিন। অভিমুখ কোনটা? সেটা কিন্তু ২০০৬-এর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অভিমুখেই আটকে আছে। এমনকি বুদ্ধবাবুর এআই প্রচারে নামানো হলো। সিঙ্গুরে যখন রবীন দেব প্রার্থী হলেন, তখন তিনি একটি ন্যানো গাড়ি নিয়ে সমগ্র প্রচার সারলেন। যুক্তি ছিল ন্যানো কারখানা হলো না তার বিরুদ্ধে প্রচার। গোহারা হারলেন। এরপর যখন ২০২১-এ নতুন মুখ সৃজন এলো সিঙ্গুরের লড়াইয়ে, সেও না হওয়া মোটর কারখানা থেকেই তার প্রচার শুরু করলো। ঘোষণা করলো, আমরা ক্ষমতায় এলে এখানেই মোটর কারখানা করবো। জমানত জব্দ হলো। আবার এ বছর লোকসভায় সিপিআইএম প্রার্থী সিঙ্গুরে কর্মসংস্থান, মোটর শিল্প, টাটা মোটর প্রসঙ্গের ওপর জোর দিল। স্পষ্টতই ২০১১ থেকে, বলা ভালো ২০০৯ থেকেই, মানুষ একটার পর একটা ভোটে রায় দিয়ে সিঙ্গুরে পার্টির ভুলকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল। আর পার্টি এক গুঁয়েমি, বরিশাইল্যা ভাষায় “ঠ্যাঁটামি” দেখিয়ে, ওখানেই কারখানা হবে বলে প্রচারে গেল। অথচ সকলেই জানে ন্যানো কারখানা সিঙ্গুর থেকে গুজরাটের সানন্দে যাওয়ার দু’বছরের মধ্যে ন্যানো উৎপাদন বন্ধ হয়েছে। এটা হল অভিমুখ? সত্যিই তো মুখ বদল হলেও অভিমুখ বদল হয়নি। সিঙ্গুরে এই ভুল অভিমুখকে প্রতিবাদ জানিয়েছিল ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, লিবারেশন, এসইউসি ইত্যাদি বামদলগুলি। অভিমুখ অপরিবর্তিত থাকার ফলে এদের কর্মী-সমর্থকদের ভোটগুলিও সিপিএম পায়নি। এরা নাকি ঘুরে দাঁড়াবে!!
অতি সম্প্রতি সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য ২০২৪-এর জনতার রায়কে ঐতিহাসিক বলে ঘোষণা করেন। পর্যালোচনা করার সময় তিনি তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ, বাংলা, মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাবের ভূমিকার সপ্রশংস উল্লেখ করলেন। কারণ তার চোখে এটা বিজেপি ও মোদির বিরুদ্ধে জনগণের রায়। এমনকি নির্বাচনের আগেও তাদের দলীয় পোস্টারগুলিতে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার কথাই বলা হয়েছিল। নির্বাচনের ফলপ্রকাশের পর এ রাজ্যের সিপিএম বা কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জনগণকে একটা অভিনন্দন জানানোর কোনো আগ্রহ ছিল না। বরং একটা শোকের আবহাওয়া। বুঝি এ রাজ্যে বিজেপি জিতলে পার্টি খুশি হতো। এখানেই এই রাজ্যের বাম আন্দোলনের দুর্বলতা। জানিনা দলীয় নেতৃত্ব আলাপ আলোচনায় বসে এই ত্রুটিগুলি চিহ্নিত করতে পারবে কিনা। নির্বাচনের ফলপ্রকাশের আগে ব্রাত্য বসু একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন আমরা অবশ্যই মনে প্রাণে বিরোধী দল হিসেবে সিপিএম ও কংগ্রেসকে পছন্দ করি। কারণ তারা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী। তৃণমূল সরকারের বিকল্প দলটি যদি হয় ঘোর সাম্প্রদায়িক বিজেপি, তাহলে সেটা এই রাজ্যের পক্ষে ঘোর বিপজ্জনক।