ভারতীয় অর্থনীতির ক্রমবর্দ্ধমান নির্ভরশীলতা: সংঘ পরিবার-বিজেপির শাসনে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী আক্রমণ এবং কর্পোরেটিকরণ, সামরিকীকরণের রাজনীতির জেরে নানা দিক থেকে ভারতীয় অর্থনীতির ধ্বংসসাধন বৃদ্ধি পেয়েছে। যোজনা কমিশনকে তুলে দিয়ে নীতি আয়োগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বহু ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ-কর্পোরেটিকরণ করার জন্য বিদেশি বিনিয়োগকে সহজ করা হয়েছে। এর জন্যই আরএসএস বিজেপিকে বিকাশ পুরুষ বলে তুলে ধরছে। সরকারি খরচের জন্য টাকা জোগানোর নামে মোদি সরকার সব কিছুকে পণ্যে পরিণত করছে এবং সরকারি-রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ এবং অংশীদারি অতি সস্তা দামে বেচে দিচ্ছে। অথবা তারা সরকারি অংশীদারি কমিয়ে দিচ্ছে। রেল, রেলের প্ল্যাটফর্ম, রাস্তা, পার্ক, খেলার মাঠ, ফাঁকা জায়গা, বন্দর, বিমানবন্দর, খনি, জঙ্গল, জমি, বিভিন্ন সম্পদ ও এই ধরনের নানা জিনিস তারা অতি সস্তায় বেসরকারি ক্ষেত্রকে বিক্রি করছে। এগুলির যৌথ উপযোগিতা সম্পর্কে তারা জনগণকে প্রতারিত করছে। একদিক থেকে তারা জনগণের বুনিয়াদি অধিকারকে পদদলিত করছে। এর মধ্যে দিয়ে আদানি, অম্বানির মতো দেশের মুৎসুদ্দি কর্পোরেট সংস্থাগুলি এবং বিদেশি কর্পোরেট সংস্থাগুলির সম্পদ বিপুল বৃদ্ধি পয়েছে। বৃহৎ কর্পোরেটগুলির ২৫ লক্ষ কোটি টাকা ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব করে দেওয়া হয়েছে। তাদের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ভরতুকি দেওয়া হচ্ছে। মোতিলাল অসওয়ালের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৭ থেকে ২০২২-এর মধ্যে দেশের সবচেয়ে বড়ো ১০০টি সংস্থা ৯২.২ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ উপার্জন করেছে। মোদির জমানায় আদানি ১৫৫.৭ বিলিয়ন ডলার সম্পদ নিয়ে দুনিয়ার দ্বিতীয় ধনীতম ব্যক্তি হয়েছে। এই জমানায় শোষণ, নিপীড়ন, দমন, বৈষম্য চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছেছে। অর্থনীতি গভীর সংকটে পড়েছে এবং আরও নির্ভরশীল হয়ে গেছে। কোটি কোটি মানুষের জীবনযাপনের মান নিচু স্তরে পৌঁছে গেছে। জনগণের জীবিকা, জাতীয় সম্পত্তি এবং গোটা অর্থনীতিকে ধ্বংস করা চলছে। এতে উৎপাদন কমছে, আমদানি ও খরচ বাড়ছে, রফতানি কমছে এবং আর্থিক ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। ২০১৪-১৫-য় আর্থিক ঘাটতি ছিলো ৫,১২,৬২৮কোটি, ২০২৩-২৪-এ তা বেড়ে হয়েছে ১৭,৮৬,৮১৬ কোটি। টাকার মূল্য ২০১৫-য় ছিলো ৬৩.৭৬, বর্তমানে তা কমে হয়েছে ৮৩।
মোদি প্রশাসনের এক দশক: পিপলস ম্যাগাজিনের চোখে/ ২—দারিদ্র্য ও বেকারত্ব
৩০ ট্রিলিয়ন অর্থনীতি গোয়েবেলসের প্রচারের অঙ্গ: মোদি সরকার দুনিয়াকে বিশ্বাস করাতে চাইছে, ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে এবং ২০৪৭ সালের মধ্যে ৩০ ট্রিলিয়নের অর্থনীতিতে পরিণত হয়ে উন্নত দেশ হয়ে উঠবে। ৭৬ বছরে এই দেশ ৩.৭৫ ট্রিলিয়নের অর্থনীতিতে পরিণত হলেও এর বৃদ্ধি খুবই কম। এরা এই বিভ্রম তৈরি করতে চাইছে যে জিডিপি বৃদ্ধির হারের মধ্যে দিয়েই ভারত উন্নত দেশে পিরণত হবে। আইএমএফের টাটকা মূল্যায়ন অনুযায়ী আমেরিকার জিডিপি ২৬.৮ ট্রিলিয়ন ডলার, মাথাপিছু আয় ৮০.৪১ হাজার ডলার। ৩.৭ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপি এবং ২.৬ হাজার মাথাপিছু আয় নিয়ে ভাকরত পঞ্চম স্থানে রয়েছে। মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জি-২০ জোটের দেশগুলির মধ্যে আমাদের দেশ সবচেয়ে গরিব। ২০২১ সালের মানব উন্নয়ন সূচকে ভারত ০.৬৩৩(১ মান দিয়ে সম্পূর্ণ মানব উন্নয়ন বোঝানো হয়)। ১৯১টি দেশের মধ্যে ভারত ছিলো ১৩২ তম স্থানে। প্রতিবেশী দেশগুলির তুলনাতেও আমরা বেশি নীচে নেমে গেছি। মানবোন্নয়নে আমাদের দেশ কতটা পশ্চাদপদ অবস্থায় আছে তা এর থেকে বোঝা যায়। মোদি সরকার সংখ্যা দিয়ে জাদু দেখানোর শিল্প করায়ত্ত করেছে, এরা নানা শূন্যগর্ভ জিনিস মানুষকে বিশ্বাস করাতে চায় এবং প্রতারণা করে।
মানুষের পিঠে অসহনীয় ঋণের বোঝা: ১৯৪৭ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত দেশের ঋণ ছিলো ৫৫,৮৭,১৪৯ কোটি। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি আরও ১০০ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন এবং ২০২৩-এর মার্চের মধ্যে ভারতের মোট ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৫৫ লক্ষ কোটি। ২০২৪-এর মার্চের শেষে তা বেড়ে হবে ১৬৯ লক্ষ কোটি। এর পাশাপাশি রাজ্য সরকারগুলি আরও ৭৬,০৯,৯২৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাস থেকে জ্বালানি করের নামে সরকার জনগণের থেকে ২৬,৫১,৯১৯ কোটি টাকার বেশি সংগ্রহ করে। অর্থাৎ প্রতিটি পরিবার থেকে ১ লক্ষ টাকা জ্বালানি কর তোলা হয়। জিএসটির নামে প্রতি মাসে ১,৭০,০০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। জনগণের থেকে আদায় করা যাবতীয় করের সাথে কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, রেল, কয়লাখনি, রাস্তা, পরিকাঠামো, রফতানি এবং অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে সেস বা বিশেষ কর আদায় করে। এগুলি থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা উপার্জন হয়। তারপরেও সরকার গাদাগাদা শর্তে সাম্রাজ্যবাদী এবং দেশি-বিদেশি অতিধনীদের থেকে ঋণ নিয়ে থআকে। এগুলি খরচ করা হয় ঋণদাতাদের স্বার্থরক্ষা, চিনের সঙ্গে অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং অন্যান্য ঋণের সুদ চোকাতে। ঋণগুলো কীভাবে খরচ করা হয়, তা জনগণকে কখনও জানানো হয় না। করোনার জেরে কাজ হারানো এবং আর্থিক ভআবে দুর্বল হয়ে পড়া জনগণ ও পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য এরা এক পয়সাও খরচ করেনি, বদলে তাদের ঘারে ঋণের বিশাল বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে।
ভুয়ো আত্মনির্ভরতা: বেশি-বিদেশি কর্পোরেট বিনিয়োগকে স্বাগত জানানো এবং তাদের হাতে দেশের সম্পদ ও সস্তা শ্রমশক্তিকে তুলে দেওয়ার নীতি জনগণের বুনিয়াদি সমস্যার সমাধান করবে না , কেবল দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বাড়াবে। আমাদের দেশ বিদেশি বিনিয়োগের উপর দাঁড়িয়ে উন্নত দেশে পরিণত হবে—এটা একটা বিরাট ভ্রম। মোদি জমানার প্রথম পাঁচ বছরে দেশে ২০.৩০লক্ষ কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ আসে এবং সেই সময়কালের প্রতি বছর সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিকরা ৪৭.০৯ লক্ষ কোটি টাকা লুঠ করে নিয়ে যায়। প্রকৃত আত্মনির্ভরতার ভিত্তিতে দেশের শিল্পায়ন করার বদলে মোদি সরকার ঋণের বোঝা বাড়াচ্ছে এবং এই দেশকে সাম্রাজ্যবাদীদের নির্বিচার শোষণের কেন্দের পিরণত করছে। এর ফলে জনগণকে অত্যাধিক করের বোঝার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জনগণ যাতে সংগঠিত না হতে পারে, তাই তাদের ধর্ম ও জাতপাতের নামে বিভাজিত করা হচ্ছে। সংগ্রামী জনগণকে দমন করা হচ্ছে।
কৃষি সংকট: মোদি সরকার বাতেলা দিয়েছিলো যে তারা ২০২২-এর মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুন করে দেবে। কৃষকদের সংগঠিত লড়াইয়ের জেরে তারা কৃষকবিরোধী, কর্পোরেটপন্থী তিনটি কৃষি আইন বাতিল করলেও নিজেদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। কৃষকরা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পাচ্ছেন না। উদ্বৃত্ত জমির সঞ্চয়নের অভাবে কৃষকরা প্রবল দারিদ্র্যের কবলে পড়ছেন। ভূমি সংস্কার হচ্ছে না। চাষের খরচ বেড়েছে পণ্যের দাম কমেছে। কৃষিকাজে সরকারি ভরতুকি কমেছে। গরিবরা ঋণ পান না, বিমার সুবিধা পান না। তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নেই। খরা ও বন্যায় শস্য নষ্ট হয়। এছাড়া, সরকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কৃষকবিরোধী নীতি গ্রহণ করেছে। সব মিলিয়ে কৃষিক্ষেত্র গভীর সংকটে রয়েছে।
(ক্রমশ)