সামনেই অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন। এই সময়টায় সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে চর্চা বেড়ে ওঠে। যারা সাধারণত রাজনীতির খবরে উৎসাহ দেখান না, তারাও এই সময় দেশদুনিয়ার খবর রাখতে শুরু করেন। এই সময়টার গুরুত্ব মাথায় রেখে পিপলস ম্যাগাজিনও চোখ মুছে তার শীতঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করছে। আমরা ধারাবাহিক ভাবে আরএসএস-বিজেপি সরকারের এক দশক নিয়ে আমাদের সম্পাদকীয় মতামত প্রকাশ করার চেষ্টা করবো। তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরবো। আজ প্রথম কিস্তি।
প্রচুর হইচই করে মোদি সরকার জনগণকে যে প্রতিশ্রুতিগুলি দিয়েছিলো, তার কোনোটাই সে রাখতে পারেনি। বরং সে নিজেকে শ্রমিক-বিরোধী, কৃষক-বিরোধী, মধ্যবিত্ত-বিরোধী, দলিত-আদিবাসী-নারী-ধর্মীয় সংখ্যালঘু(মুসলিম, ক্রিস্চান) বিরোধী এবং নিপীড়িত জনগণ বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলেছে। এরা আগ্রাসী ভাবে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের সংস্কারগুলি কার্যকর করছে এবং দেশ ও বিদেশের কর্পোরেট সংস্থাগুলির বিশ্বস্ত দাস হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। পূর্বের সরকারগুলির তুলনায় এরা অনেক দ্রুত গতিতে দেশ-বিদেশের কর্পোরেটদের অনুকূলে বিভিন্ন পলিসি কার্যকর করেছে। তেল, পারমাণবিক জ্বালানি, অস্ত্র ও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জামের ক্ষেত্রে এরা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। এরা যা রফতানি করছে, সেগুলি সবই দ্বিতীয় স্তরের পণ্য এবং সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক সংস্থাগুলির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি। ‘আচ্ছে দিন’, ‘ভারতে বানাও’, ‘আত্মনির্ভর ভারত’, ‘বিকশিত ভারত-২০৪৭’-এর রোডম্যাপ এবং এই ধরনের সব প্রকল্পই দেশ-বিদেশের কর্পোরেটদের স্বার্থে তৈরি। সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত, প্রতারিত করতে ও তাদের মনোযোগ ভুল দিকে চালিত করতে এরা মিথ্যে এবং অর্ধসত্য দিয়ে প্রচার চালায় এবং প্রকল্প রচনা করে। মেক ইন ইন্ডিয়া, ডিজিটাল ইন্ডিয়া, স্মার্ট সিটি, স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া, স্কিল ইন্ডিয়া এবং ফসল বিমা প্রকল্পের ব্যর্থতাই এর উদাহরণ।
মোদির জমানায় দেশের ইতিহাসে যে তথাকথিত সবচেয়ে ‘দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি’ হয়েছে, তাতে অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা, সমাজে অশান্তি, ধর্মনিরপেক্ষ বৈচিত্যময় সংস্কৃতি ধ্বংস হয়েছে এবং বিপর্যস্ত হয়েছে পরিবেশ। এর ফলে লাখো লাখো শ্রমিক-কর্মচারী কর্মচ্যুত হয়েছেন। অসংখ্য ছোটো ও মাঝারি শিল্প বন্ধ হয়েছে। কর্মসংস্থানহীন বৃদ্ধি একটি প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। কর্মহীনতা বেড়েছে অভূতপূর্ব পরিমাণে। কৃষি আরও সংকটে জড়িয়েছে। ২৬ কোটি কৃষি শ্রমিক দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গরিব থাকার কৃতিত্ব রয়েছে আমাদের দেশের। অর্থনৈতিক বৈষম্য চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছেছে। বৈদেশিক ঋণ আরও বেড়েছে এবং দেশ আরও বেশি করে দীর্ঘমৈয়াদি ঋণের পাঁকে পড়েছে। আধা-সামন্ততান্ত্রিক, নির্ভরশীল দেশে শোষণ ও নিপীড়িন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। মিথ্যে এবং অর্ধসত্য ভাষণে পটু সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি-এনডিএ সরকারকে আদৌ গণতান্ত্রিক বলা চলে না। বস্তুত, এই সরকার আমলাতান্ত্রিক। তাই, ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী বিজেপি আমাদের দেশ ও জনগণের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক।
আরএসএসের রাজনীতিতে নিজেকে উৎসর্গ করা মোদি, সামন্ততান্ত্রিক আমলাতন্ত্র-হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদ কার্যকর করছে। ধর্মনিরপেক্ষতা, সংখ্যালঘু, স্বশাসিত ‘গণতান্ত্রিক’ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলি এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মতো বুনিয়াদি ‘সাংবিধানিক’ দিকগুলিকে তিনি আক্রমণ করছেন। মোদি সরকারের নামানো সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের নীতিগুলি দেশকে অর্থনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। জনগণের ক্রয় ক্ষমতা অভূতপূর্ব ভাবে কমে গেছে। মুদ্রাস্ফীতি ৬ শতাংশে পৌঁছেছে এবং মূল্যবৃদ্ধি আকাশ ছুঁয়েছে। জীবিকা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়ের মতো জনগণের বুনিয়াদি সমস্যাগুলিকে মোদি অবহেলা করেছেন এবং সাম্প্রদায়িক, জাতপাতের মতো বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে নিজের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পলিসিগুলি সাজিয়েছেন। ঘৃণাভাষণ, অন্তর্ঘাত, ‘গো’ গুন্ডাদের নিয়োগ করে হাজার হাজার মুসলমানের জীবন ও ব্যবসাকে ধ্বংস করা হয়েছে। তিনি এই রাষ্ট্রকে আরও বেশি করে পুলিশ-রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। যেসব সাংবাদিক জনগণের পক্ষে, সরকারের বিরুদ্ধে লেখেন তাদের জেলে পোড়া হয়েছে, যারা তার পলিসিগুলির বিরোধিতা করে, যেসব লেখক, কবি, সমাজকর্মী এবং অধিকার সংগঠনের নেতা বিজেপি শাসনের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন, তাদের ‘ইউএপিএ’ দিয়ে ভুয়ো মামলায় কারারূদ্ধ করা হয়েছে। (ক্রমশ)
বিভিন্ন ক্ষেত্র ধরে এই আলোচনা আমরা চালিয়ে যাবো।