Home রাজনীতি অবসর-সংস্কার বিরোধী সংগ্রামে অগ্নিগর্ভ ফ্রান্স: একটি বিশ্লেষণ

অবসর-সংস্কার বিরোধী সংগ্রামে অগ্নিগর্ভ ফ্রান্স: একটি বিশ্লেষণ

অবসর-সংস্কার বিরোধী সংগ্রামে অগ্নিগর্ভ ফ্রান্স: একটি বিশ্লেষণ
0

পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: গত তিন মাস ধরে সাম্প্রতিক কালের অন্যতম বৃহৎ শ্রমিক আন্দোলনে কাঁপছে গোটা ফ্রান্স। কয়েক বছর আগে যখন ইউনিয়নগুলোর লড়াইয়ের উদ্যম এবং সদস্য সংখ্যা কমে আসছিল, তখনই ২০১৮-১৯-এ কিছুটা অসংগঠিত চেহারার ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন তৈরি হয়। সেই সময় থেকে অর্থাৎ ম্যাকরোঁর প্রথম জমানায় নিজেদের সংগঠনগুলোকে পুনর্জীবিত করতে ইউনিয়নগুলো ব্যাপক আকারে ধর্মঘট-আন্দোলন শুরু করে দেয়। প্রথমে, ২০১৮ সালে রেলশ্রমিকদের বিশেষ অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে, তারপর ২০১৯-এর ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় গণ-অবসর ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে তৈরি প্রথম খসড়া বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন। সেটা অবশ্য কোভিড অতিমারির জন্য সাময়িক ভাবে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এর আগে ২০০৬ সালে একটি বিল প্রস্তাবিত হয়-‘প্রথম নিয়োগ চুক্তি’। যার মাধ্যমে নিয়োগকর্তারা ২৬ বছরের কমবয়সিদের সঙ্গে এমন চুক্তি করতে পারত, যাতে তাদের ছাঁটাই করলে কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না এবং তাদের সামাজিক সুরক্ষা বাবদ কোনো টাকা বরাদ্দ করতে হবে না। সেই সময় তীব্র আন্দোলন হয়েছিল। তারপর থেকে কোনো দক্ষিণপন্থী এবং ‘বামপন্থী’ সরকারের করা কোনো নয়া উদারনৈতিক সংস্কারের বিরুদ্ধে কোনো বড়ো আকারের জাতীয় স্তরের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ফ্রান্সে হয়নি।

চলতি বছর সরকারের অবসরের বয়স ৬২ থেকে বাড়িয়ে ৬৪ করার বিরুদ্ধে ইউনিয়নগুলি জানুয়ারির ১৯ এবং ৩১ তারিখ বিক্ষোভের ডাক দেয়। তাতে বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশ নেয়। মুদ্রাস্ফীতির সংকটের ফলেই এই ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে বড়ো বড়ো ফরাসি সংস্থাগুলো ২০২২ সালে ১লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকা বা ১৫ হাজার ২০০ কোটি ইউরোরও বেশি মুনাফা করেছে।

যদিও এই বিক্ষোভগুলি একটা বিষয়কে আড়াল করে দিয়েছিল। তা হল, ধর্মঘটে যোগ দেওয়া শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমেই কমছিল। তারওপর প্রধান ‘জঙ্গি’ ইউনিয়ন সিজিটি বোঝাপড়ার স্বার্থে এবং সরকারের সামনে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের চেহারা তুলে ধরতে কিছুটা নরমপন্থা গ্রহণ করে। টানা ধর্মঘটের বদলে আন্দোলনের ফাঁকে ফাঁকে ধর্মঘটের কৌশল নেয়। তাতে জঙ্গি কর্মী-সমর্থকদের উৎসাহে ভাঁটা পড়ে। তারা সংখ্যায় কমতে থাকে।

ফ্রান্সের দুটি আইনসভায় ভোটাভুটির জন্য বিল পেশের পর আন্দোলন তীব্রতা পায়। ৭ মার্চের মিছিল সফল হয়। বহু মানুষ অংশ নেয় এবং মিডিয়ায় প্রচারও হয় ব্যাপক ভাবে। আসলে সে সময় সরকার একটা মারাত্মক কাঁচা কাজ করে। দেশের শ্রমমন্ত্রী ঘোষণা করেন, যারা ন্যূনতম বেতনে ৪০ বছর চাকরি করেছেন, তাদের পেনসন বাড়িয়ে ১২০০ ইউরো করা হবে। সরকার বলে, এই সিদ্ধান্তে দেশের ৪০ হাজার মানুষ উপকৃত হবেন কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, উপকৃত হচ্ছেন মাত্র ৪৮ জন।

পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার কর্তৃত্ববাদী অবস্থান নেয়। আইনসভায় বিতর্কের সময় কমিয়ে দেয়। এতে কিছু সাংসদ, যারা বিলটি নিয়ে সন্দিগ্ধ ছিলেন, আলোচনা চাইছিলেন, তারা বিরোধী শিবিরে যোগ দেন। এরা রিপাবলিকান গোষ্ঠীর সদস্য, যারা কিনা ম্যাকরোঁর উদারনৈতিক সংস্কারের পক্ষে। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ইউনিয়নগুলির সঙ্গে আলোচনায় বসতে বা দরাদরি করতে রাজি হননি। যা কিনা ফরাসি রীতির বিরোধী। সরকার সমাজের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে আলোচনায় রাজি না হওয়ায় আইনসভার বিভিন্ন গোষ্ঠীর সদস্যরা একযোগে সংস্কারের বিরোধী হয়ে যায়। এই অবস্থায় ১৬ মার্চ চূড়ান্ত ভোটাভুটির আগে দক্ষিণপন্থী রিপাবলিকান পার্টির এক নেতা সরকারকে ভোটাভুটি ছাড়াই আইন পাসের পথ নিতে বলে। এরকম একটি ধারা(৪৯.৩) আপদকালীন পরিস্থিতির জন্য সংবিধানে রয়েছে। যা আইনসভাকে বলে, সরকার দেশের ভালোর জন্যই কাজ করছে, এই মর্মে সরকারের উপর ‘বিশ্বাস’ রাখতে। ১৬ মার্চ দুপুর তিনটেয় ম্যাকরোঁর সরকার এই ব্যবস্থাই নেয়, যা জরুরি অবস্থা ছাড়া কিছু নয়। সংসদ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। বহু সদস্য সরকারের ‘পদত্যাগ’-এর দাবি তুলতে থাকেন। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে যায়। সংসদে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার কথা ওঠে। যা ৪৯.৩ নম্বর ধারা প্রয়োগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আনাই নিয়ম। তা করা হয়। এর আগে যতবার এই প্রস্তাব আনা হয়েছে, তা সবই ছিল প্রতীকী। কিন্তু এবার পরিস্থিতি তেমন ছিল না। ম্যাকরোঁর দলেরই এক বরিষ্ঠ সদস্য সংসদে এই প্রস্তাব আনেন। সব ধরনের বিরোধীরা সরকার ফেলার পক্ষে জড়ো হতে থাকে। এমনকি বেশ কিছু সাংসদ তাদের দলের দলের অবস্থানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষ নেন। প্রতিদিন মিছিল হতে থাকে। প্রতি রাতে ৫০ থেকে ৩০০ জন গ্রেফতার হচ্ছিল। ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস শুরু হয়ে গিয়েছিল।

এই অবস্থায়, সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবে যখন প্রায় ৭০% শক্তি একজোট, তখন ইউনিয়নগুলির মধ্যে বিভাজন সামনে আসতে থাকে। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বড়ো ইউনিয়নগুলির গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় তারা ভয় পেয়ে যায়, যদি এই ভাবে আন্দোলন চলতে থাকে তাহলে ইয়েলো ভেস্টরা ফিরে আসবে এবং আন্দোলনের ওপর ইউনিয়নগুলির নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে। অন্যদিকে কিছু ইউনিয়ন আন্দোলনকে আরও বিস্তৃত করা ও বিপ্লবী চেহারা দেওয়ার পক্ষে ছিল।

এদিকে ২০ মার্চের অনাস্থা প্রস্তাবে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে বিতর্ক ও ভোটাভুটি চলে। কোনো সাংসদ চাইলে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে ভোট দিতে পারেন, এই মর্মেই ভোট হয়। তাতে ৫৭৩ ভোটের লড়াইতে সরকার পক্ষ মাত্র ৯ ভোটে জেতে। এর আগে এরকম ভোটে সবচেয়ে কম ভোটে জেতার ইতিহাস ছিল ৫০ ভোট। এর থেকেই বর্তমান সরকার কতটা সংকটে আছে তা বোঝা যায়। পথের লড়াইয়ের জেরেই ভোটাভুটিতে আইনসভাকে এমন অবস্থান নিতে হল।

এর থেকে বোঝা যায়, ফ্রান্স এমন বড়ো মাত্রা প্রাতিষ্ঠানিক সংকটের মধ্যে রয়েছে, যা গত ৫০ বছরে দেখা যায়নি। তা এক সংকটের পর্যায়ের মধ্যে প্রবেশ করছে। দেশে শ্রেণি বিভাজন ক্রমেই বাড়ছে এবং শাসক শ্রেণির ওপর বৃহৎ কর্পোরেটরা যে দায়িত্ব ন্যস্ত করে রেখেছে, তা তারা যথাযথ ভাবে পালন করতে পারছে না। জনগণ ক্রমেই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।

২০১৬ সালে ‘সমাজতান্ত্রিক’ প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কো ওঁলাদের সময় নাগরিকত্ব এবং শ্রম আইনে যে সংস্কার আনা হয়, তা দক্ষিণপন্থীরাও করার স্বপ্ন দেখতো না। সে সময় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বহু ছাত্রযুব বাম ও প্রগতিশীল ধারায় দীক্ষিত হয়। এবারে তা আরও বেড়েছে। ‘পুঁজির একনায়কত্ব’ থেকে মুক্তির কথা এবারের আন্দোলনে জোরেসোরে উঠেছে। এখনকার ছাত্রযুব এবং বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী এই পরিস্থিতিতে নতুন ধরনের সর্বহারা পার্টি গড়ে তোলার কথা বলছেন। নইলে মূলধারার বামেরা ক্রমেই এই স্বসতস্ফূর্ত আন্দোলনমুখীনতাকে ক্রমেই গ্রাস করে নেবে। তবে যে ধরনের অতিবাম লড়াকু পার্টির দাবি উঠেছে, তা ঠিক লেনিন বা মাওবাদী ধরনের ভ্যানগার্ড পার্টি নয়। তা এমন এক পার্টি, যা জঙ্গি লড়াই করবে এবং বাম-জনপ্রিয় সংস্কার সাধনের কথা বলবে এবং তাদের কর্মসূচিও তেমনই হবে এবং এর চেহারা হবে অনেকটা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সময়কার গণপার্টিগুলোর মতো। এই পার্টি মূলধারার বাম দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না।

আগামী দিনগুলো অনিশ্চিত। গুরুত্বপূর্ণ ট্রেড ইউনিয়ন সিজিটির সম্মেলন সামনে। সেখানে দুই সংস্কারপন্থী এবং একজন পরিবর্তনকামী নেতৃত্বের জন্য লড়বেন। অন্যদিকে পেনসন-সংস্কার বিল নিয়ে আইনি লড়াইও চলছে। কিছু বামদলের জোট পেনসন সংস্কার বিল নিয়ে গণভোটের চেষ্টা করছে। এটা যদি এগোয় তাহলে আন্দোলন আরও চলবে। ফ্রান্সের বিপ্লবীরা ফ্রান্সের বর্তমান পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের শেষ দিনগুলোর লড়াইয়ে অংশও নিচ্ছে, তাতে নজরও রাখছে। আমরা তো জানি, আইন ততদিনই কঠোর, যতদিন তার অস্তিত্ব রয়েছে।

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *