Home খবর পরেশনাথ পাহাড়ে আদিবাসীদের সঙ্গে জৈন মন্দির কর্তৃপক্ষের বিরোধের কারণ কী
0

পরেশনাথ পাহাড়ে আদিবাসীদের সঙ্গে জৈন মন্দির কর্তৃপক্ষের বিরোধের কারণ কী

পরেশনাথ পাহাড়ে আদিবাসীদের সঙ্গে জৈন মন্দির কর্তৃপক্ষের বিরোধের কারণ কী
0

পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: বছর তিনেক আগে ঝাড়খণ্ডের পরেশনাথ পাহাড়ের জৈন তীর্থস্থান শ্রী সামেদ শিখরকে পরিবেশগত ভাবে সংবেদনশীল হিসেবে ঘোষণা করেছিল মোদি সরকার। জৈনদের লাগাতার প্রতিবাদে এ বছরের জানুয়ারিতে সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেছে কেন্দ্র। এখন আদিবাসীরা বলছে, জৈন সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের ওই পাহাড়ে যেতে বাধা দিচ্ছে। তাদের বক্তব্য, গোটা অঞ্চলটাই জৈনদের, তাই আদিবাসীরা সেখানে যেতে পারবে না। অথচ আদিবাসী সমাজ দীর্ঘদিন ধরে পরেশনাথ পাহাড়ে টুসু উৎসব পালন করে আসছে। কুড়মি এবং ঝাড়খণ্ডের অন্যান্য আদিবাসীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হল টুসু। শীতের ফসল কাটার পর পৌষ মাসে এই উৎসব হয়।

২০১৯ সালে শ্রী সামেদ শিখরকে পরিবেশের দিক থেকে সংবেদনশীল এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে কেন্দ্র। পরবর্তী কালে জেলা প্রশাসনের সুপারিশে ঝাড়খণ্ড সরকার এটিকে পর্যটনস্থল বলে ঘোষণা করে।

এ নিয়ে দেশ জুড়ে আন্দোলন শুরু করে জৈন সম্প্রদায়। তার জেরে মোদি সরকার ওই এলাকায় যাবতীয় পর্যটন এবং পরিবেশ-পর্যটন বন্ধ করার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। তারপরই এই সিদ্ধান্তকে বিরাট জয় হিসেবে বিবেচনা করে, কেন্দ্রীয় সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে জৈন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতারা আন্দোলন বন্ধ করার আবেদন জানান। পাশাপাশি তারা শ্রী সামেদ শিখরকে পর্যটনস্থল হিসেবে ঘোষণা করার রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তটিকেও ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি করছেন।

এর মধ্যে জৈন সম্প্রদায়, গোটা পরেশনাথ শৃঙ্গ অঞ্চলটিকেই তাদের নিজেদের এলাকা বলে দাবি করছে। অথচ এলাকার আদিবাসী জনগণ কয়েক শতাব্দী ধরে সেখানে টুসু উৎসব পালন করে আসছে। জৈনরা বলছে, গোটা অঞ্চলটিই ধর্মীয় স্থান। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে নতুন করে গোলমাল শুরু হয়েছে।

জৈন সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুদের দ্বারা পরেশনাথ পাহাড়ের দখলদারির বিরুদ্ধে আদিবাসীরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। জৈনদের বিক্ষোভের পর এবার আদিবাসীরা পরেশনাথ পাহাড়ে জড়ো হয়ে পাহাড়কে জৈনদের থেকে মুক্ত করার দাবি তুলছেন।

জৈন সাধুদের বিরোধিতার পর কেন্দ্রীয় সরকার একটি চিঠি দিয়ে গোলমাল মিটিয়েছে বটে, কিন্তু তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছে আদিবাসী সমাজ। তাদের বক্তব্য, কেন্দ্র তাদের ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে খেলা করছে।

বস্তুত, কেন্দ্রের বিজ্ঞপ্তির পর এলাকায় মদ-মাংস, আত্মত্যাগের অনুশীলনে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, কিন্তু এগুলো সবই সেখানকার অধিবাসী এবং আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের রীতির অংশ। আদিবাসীরা মনে করছেন, জৈনি ধন্নশেঠ ধর্মীয় গুরুরা গোটা এলাকাটা দখল করার ফন্দি করছিলেন বহুদিন ধরেই, কে্ন্দ্রের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর সেটা তারা আরও শক্তি নিয়ে করছেন, তাই আদিবাসী সমাজ এর বিরোধিতা করছে।

এ বিষয়ে, ঝাড়খণ্ড মজদুর সংগঠন সমিতি(এমএসএস)-এর শ্রমিক নেতা বাচ্চা সিং বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে, যেমন আগে ছিল, তেমন অবস্থাই বজায় রাখা দরকার। এলাকার আদিবাসীরা এ সবের মধ্যে ছিলেনই না, কিন্তু জৈন ধর্মগুরুরা এখন যেটা করছেন, তাতে বিতর্ক আরও বাড়বে। তিনি আরও বলেন, শ্রী সামেদ শিখর এবং পরেশনাথ জৈনদেরই, কিন্তু সেই একই পরেশনাথে আদিবাসীদের বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের দেবতাও রয়েছেন। তারা বহুদিন ধরে বছরে একবার তাদের উৎসব পালন করে থাকেন।

কীভাবে ঝামেলা শুরু হল?

শ্রী সামেদ শিখর মন্দিরে মহারাষ্ট্র থেকে কিছু লোক আসে। তারা দেখে কিছু মানুষ মন্দিরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের তারা বলে, ‘তোমরা তো জৈন নয়, এখান থেকে বেরিয়ে যাও’। স্থানীয় জৈনরা গোলমাল শুরু করেনি। কিন্তু মন্দিরে আসা অজৈন মানুষজন প্রতিবাদ করায়, কিছু জৈন চলে এসে মারামারি শুরু করে, তাতেই পরিস্থিতি গরম হয়ে যায়। এতে স্থানীয় আদিবাসীরা ক্ষুব্ধ হন।

এই খবর স্থানীয় গ্রামগুলিতে গিয়ে পৌঁছনোর পর সকল গ্রামবাসী ও দোকানদাররা সেখানে জড়ো হয়, তারা বিপুল সংখ্যায় থানায় যায়। কিন্তু পুলিশদের মনে হয়, গ্রামবাসীরা তাদের আক্রমণ করবে। তারা কয়েকজন গ্রামবাসীকে আটক করে, তাতে স্থানীয় মানুষ আরও রেগে যায়। মাহারাষ্ট্র থেকে আসা লোকগুলোকে প্রশ্ন না করে পুলিশ গ্রামবাসীদের আটক করায় সকলেই অবাক হয়ে যায়। অনেকেরই ধারণা, পরিকল্পনা করেই এই গোলমাল পাকানো হচ্ছে, কারণ আগে কখনও ওই এলাকায় এমনটা হয়নি। ঝামেলা করার জন্যই মহারাষ্ট্র থেকে ওই লোকগুলোকে পাঠানো হয়েছিল।

গোলমালের সময় থানায় স্থানীয় জেএমএম বিধায়ক এসে আদিবাসীদের বলেন, এরকম ঘটনা ভবিষ্যতে হবে না, পাহাড়ের ওপর সকলেরই অধিকার রয়েছে। পাহাড়ের ওপর এবং আশেপাশে বহু আদিবাসী গ্রাম রয়েছে। অন্যান্য সম্প্রদায়ের গ্রাম থাকলেও, আদিবাসী গ্রামই বেশি। গোটা পরেশনাথ পাহাড়কে নিজেদের বলে জৈনরা যে দাবি করছে, তা ঠিক নয়। বহু বছর ধরে স্থানীয় আদিবাসীরাই পরেশনাথ পাহাড়কে রক্ষা করছে। এই অঞ্চলে যেসব বিদেশি পর্যটক আসেন, আদিবাসীরাই তাদের দেখভাল করেন। তাদের জন্যই আজ পর্যন্ত সেখানে পর্যটকরা সুরক্ষিত রয়েছেন।

সমস্যার সূত্রপাত কীভাবে?

বিজেপির রঘুবর দাস যখন ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি সেখানকার কিছু এলাকাকে পরিবেশগত ভাবে সংবেদনশীল হিসেবে চিহ্নিত করেন, মোদি সরকার সেই মতো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। তারপর এ রাজ্যে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা সরকার এসে বোঝে, এ নিয়ে সমস্যা রয়েছে। তারা এলাকাকে পর্যটনস্থল বলে ঘোষণা করে। এতে অজৈন জনগণ অর্থাৎ আদিবাসীদের কাজের সুযোগ বাড়ার সম্ভাবনা।

কিন্তু জৈনদের সমস্যা হল, এটাকে পর্যটনস্থল ঘোষণা করলে, সবকিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে, তাদের মন্দির, মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণও। তাতে জৈনগুরুদের ক্ষমতা সংকটে পড়বে। মন্দিরে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা জমা পড়ে, সেটাও সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

সবচেয়ে জরুরি বিষয়

সবচেয়ে জরুরি বিষয় হল, জৈন ধর্মগুরুরা যে সরকারি অরণ্যভূমি দখল করে রেখেছে, তা দের হাত থেকে চলে যাবে। টাকা দিয়েও তা তারা রাখতে পারেব না। এটাই তারা সহ্য করতে পারছে না। স্থানীয় জনগণের জমিতেই তাদের মন্দির তৈরি হয়েছে আর তাদেরই ওরা চলে যেতে বলছে! স্থানীয়রা যে সেখানে কয়েক শতক ধরে পুজো করছে, সেটাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হচ্ছে। আদিবাসীদের জমিতে বসে ১০৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা থেকে আদিবাসীদের চলে যেতে বলা হচ্ছে! ফলে স্বাভাবিক ভাবেই আদিবাসীরা প্রতিবাদ করছেন। তারা চান, ১০৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ধর্মীয় ভাবে সংবেদনশীল এলাকা বলে ঘোষণা করা হোক (বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মতো), সেখানে মদ-মাংস নিষিদ্ধ থাকবে। এতে বিতর্ক হওয়ারই কথা।

ওই অঞ্চলে শ্রমিক সংগঠন এমএসএসের ১৮ হাজার সদস্য রয়েছে। তাদের পরিবারগুলিকে ধরলে সংখ্যাটা লাখ পেরিয়ে যাবে। সংগঠনের নেতা বাচ্ছা সিং-এর মতে, জৈনদের ধর্মীয় অধিকার বজায় থাকাই উচিত। কিন্তু আদিবাসীদের অধিকারও খর্ব হওয়া উচিত নয়। কারণ তারাই এই এলাকায় পুরনো বাসিন্দা। তাদের দেবতা মারাং বুরু এই পাহাড়ে আছেন বলে, তারা বিশ্বাস করেন। আদিবাসী ও অজৈনদের পাহাড়ে উঠতে না দেওয়ার যে ভাবনা জৈন বন্দির কর্তৃপক্ষ ভেবেছে, তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন বাচ্চা সিং। কারণ পরেশনাথ পাহাড়ের ওপর অধিকার স্থানীয় জনগণের। পরেশনাথ পাহাড়ে যে ১০জন ডোলি মজুর কাজ করেন, তারা এমএসএসের সদস্য। তাদের অনুদানে সেখানে একটি হাসপাতালও তৈরি হয়েছে।

(বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহ করে লিখিত)

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *