কাতার বিশ্বকাপ ২০২২- অর্থ ও ক্ষমতার জগতের লোভের বহিঃপ্রকাশ
পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: এই জগতে সবকিছুরই একটি বিনিময় মূল্য আছে, এখানে চেতনা বা জীবনের মূল্য এবং প্রকৃতির মূল্য সম্পূর্ণ ভাবে গুরুত্বহীন করে দেওয়া হয়েছে। কারণ এখানে প্রাধান্যকারী একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল মূলধন ও ক্ষমতার লোভ ; যা প্রচুর অর্থের যোগান দেয়, রাজকীয় জীবন তৈরি করে, মুষ্টিমেয় মানুষকে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক করে এবং পুঁজির মালিক প্রভুদের পরজীবী শোষণমূলক জীবনকে শক্তিশালী করে।
২০১০ সালে কাতার বিশ্বকাপের ঘোষণা থেকেই মানবাধিকার লঙ্ঘন, ফিফা কর্তৃপক্ষের ঘুষ খাওয়া সহ বিভিন্ন অভিযোগের পাহাড় জমতে শুরু করে। তা সত্ত্বেও, ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজিত হলো। পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার আয়োজক দেশ হিসাবে কাতারকে নির্বাচন- এই ঘটনাটিই খেলার জগতে একটি বিস্ফোরণ ছিল। কাতার এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে পেশাদার ফুটবলের কার্যত অস্তিত্বই ছিল না। তাই কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজনের আবেদন কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিল না।
অথচ কাতারই দায়িত্ব পেল।পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অর্থের মূল্যে যে সবকিছুই সম্ভব, এই ঘটনাই তার প্রমাণ। ২০১৫ সালের মে মাসের শেষের দিকে, এফবিআই পরিচালিত একটি তদন্তে প্রতারণা, কারসাজি এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে ফিফার চোদ্দ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল।
আরেকটি বড়ো কেলেঙ্কারি হসামনে আসে পরবর্তী কালে।৮ টি নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণের সময় ৬৫০০ জনেরও বেশি শ্রমিক নিহত (পড়ুন হত্যা) হওয়ার ভয়াবহ ঘটনা শুধুমাত্র ফুটবল বিশ্বকে নয়, পুরো সমাজকে কলঙ্কিত করেছে। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান থেকে নিয়ে যাওয়া শ্রমিকদের মৃতদেহের ওপর গড়া স্টেডিয়ামে চলছে উন্মত্ত নাচগান। প্রখর রোদ ও তাপমাত্রায় পোড়া মানুষগুলোর শ্রমের উপর ভর করে আয়োজিত বিশ্বকাপ, গোটা দুনিয়ায় নিন্দার ঝড় বইয়ে দেয়। গ্রীষ্মে কাতারে দিনের তাপমাত্রা তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। ক্লান্তিকর কাজের দিনগুলিতে শ্রমিকদের অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। শ্রমিকরা ‘কাফালা’ নামক ক্রীতদাস-সদৃশ নিয়োগ ব্যবস্থার অধীন ছিল। এবং বিদেশি পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে তাদের নিয়োগের কারণে, তারা সে দেশে অন্য কোনো কাজে নিযুক্ত হতেও পারেনি।
এসবই শুধুমাত্র, ২৮ দিনের জন্য খেলা হবে এমন অসামান্য স্টেডিয়ামগুলি নির্মাণ করার জন্য। তারপর স্টেডিয়ামগুলিকে হয় ভেঙে দেওয়া হবে নয়তো বুর্জোয়া বিশ্বের ঘৃণ্য লজ্জাজনক স্মারক হিসাবে রেখে দেওয়া হবে।
বিশ্বকাপের ধুমধাম আয়োজনের পর কাতারের নারীদের অবস্থাও প্রকাশ্যে আসে। প্রকাশ্যে এসেছে তাদের ওপর ভয়ানক নিপীড়ন এবং পুরুষ ‘কর্তা’ দের প্রতি বশ্যতা। যেহেতু কাতার তথাকথিত ‘অভিভাবকত্ব ব্যবস্থা’ মেনে চলে, নারীরা সব কিছুতেই পুরুষদের আদেশ/ ফরমান মেনে চলতে বাধ্য। এর অনুসারে, প্রত্যেক মহিলার বিবাহ, বিদেশে পড়াশোনা, সরকারি চাকরি, অন্যান্য দেশে ভ্রমণের জন্য তার ‘পুরুষ অভিভাবকের’ অনুমতি প্রয়োজন।
এটা অবশ্যই বলা উচিত যে কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের সবচেয়ে বড়ো কেলেঙ্কারিটি মহিলাদের বা শ্রমিকদের নিপীড়নে ভর করে নয়, বরং মধ্যযুগীয় আইনশাস্ত্রকে কাজে লাগিয়েই হয়েছে, যা এখনও সেখানে বিদ্যমান।
এটা কারও কাছে অজানা নয় যে নারীদের নিপীড়ন বিশেষত শ্রমজীবী নারীদের দ্বিগুন শোষণ যেকোনো রাষ্ট্রের শোষণের বৈশিষ্ট্য। বরং এটা পুরো পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বস্তুগত ভিত্তির অংশ, যেখানে নারীদের সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়, যেখানে তারা পুরুষদের তুলনায় মজুরিতে বৈষম্যের শিকার হয়, যেখানে তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। তবে তারপরও, কাতার, যা এখন বুর্জোয়া বিশ্বের ভাবমূর্তির উজ্জ্বল নক্ষত্র, নারীদের সাথে যে আচরণ করে তা সম্পূর্ণ লজ্জাজনক।
সাধারণ ভাবে, বিশ্বকাপ ফুটবলের মত একটি ঐতিহ্যবহী অনুষ্ঠান বিশ্বের ক্রীড়াপ্রেমীদের ভাতৃত্ব, সহযোগিতায় আয়োজিত হওয়া উচিত। কিন্তু এই ব্যবস্থায় এটি মুষ্টিমেয় ক্ষমতাশালী কিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত। কাতার বিশ্বকাপ এর উলঙ্গ নিদর্শন। এটা শুধু কাতার বিশ্বকাপ ২০২২-এর একটি নির্দিষ্ট ঘটনা নয়। সমস্ত বিশ্বকাপের পর্দার আড়ালেই ব্যাপক আর্থিক ও ক্ষমতার কেলেঙ্কারি রয়েছে। তবে এটি অবশ্যই বলতে হবে যে কাতার বিশ্বকাপ আমাদেরকে এসবের চূড়ান্ত নিদর্শন দেখিয়ে দিয়েছে। ফিফার আড়ালে চলমান বিশাল অর্থের ব্যবসার কারসাজি প্রকাশ্যে এসে পড়েছে।
কাতার এই বিশ্বকাপ ক্রীড়া পরিচালনার স্থান হিসাবে একটি কলঙ্ক ছাড়া কিছুই না। এখানেই আমাদের স্পষ্ট মোটা দাগের কিছু উপসংহার টানা দরকার।
সর্বহারা শ্রেণির জন্য, বা বলা যায় সাধারণ মানুষের জন্য, কাতারকে কখনই বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রার্থী হিসাবে বিবেচনা করা উচিত হয়নি। সময়ের সাথে সাথে প্রকাশ্যে আসা বিভিন্ন ঘটনা এটাই প্রমাণ করেছে। ব্যাপক আন্দোলন বিক্ষোভের মাধ্যমে কাতারকে বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে বাতিল করতে হতো। বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে মাপকাঠি হওয়া উচিত কেবল খেলার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। কিন্তু বুর্জোয়াদের জন্য, ক্ষমতালোভী সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য, ক্রীড়া ব্যবসায়ীদের জন্য ; খেলাধুলা অর্থ উৎপাদনের কল ছাড়া আর কিছুই না। অফুরন্ত মুনাফা উৎপন্ন করে, এমন সবকিছুকেই বুর্জোয়া জগতে স্বাগত জানানো হবে, এমনকি যদি তা সাধারণ মানুষের রক্তের বিনিময়েও আসে।