অতিমারির মধ্যে মন্ত্রীদের গ্রেফতারি প্রমাণ করল জনগণের স্বার্থ নিয়ে ফ্যাসিস্টদের মাথাব্যথা নেই
পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে একটি চ্যানেলে সৌগত রায়ের একটি সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। সেখানে তিনি নারদ মামলা নিয়ে নিজের মতামত দিচ্ছিলেন। বললেন, ভোটের জন্য অনেকেই টাকা দেয়, শুধু দলের টাকায় হয় না। এটা কোনো গোপন বিষয় না। ভুল একটাই হয়েছে, নারদের স্টিং অপারেশনের সময় তিনি অচেনা লোকের থেকে টাকা নিয়েছেন।
সুভদ্র অধ্যাপক মানুষ। বয়স যথেষ্ট হয়েছে।আর ভোটে লড়বেন না, জানিয়েও দিয়েছেন। খোলামেলা কথা বলেছেন। সংসদীয় রাজনীতির ওপেন সিক্রেট বলতে তার অসুবিধা হয়নি। শাসক শ্রেণির রাজনীতিতে এসব চিরকালই হয়ে এসেছে। দুর্নীতি ও চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র এই রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। বিভিন্ন দলগুলো পরস্পরের সম্পর্কে এগুলো জানে। তাদের মধ্যে বোঝাপড়া থাকে। এসব নিয়ে দরাদরি চলে। দরাদরিতে তাল কাটলে অর্থাৎ শাসক শ্রেণির নিজেদের মধ্যে কোনো কারণে দ্বন্দ্ব তীব্র হলে, এক পক্ষ নিজেদের স্বার্থ ও ক্ষমতা অনুযায়ী এই সব মামলাকে অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে কাজে লাগায়। এক্ষেত্রেও নতুন কিছু হয়নি।
২০১৪ সালের মামলায় ২০২১ সালে রাজ্যের ২ মন্ত্রী, এক বিধায়ক, এক প্রাক্তন মন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সাত বছর ধরে কেন মামলা চলল? কারণ এতদিন বিজেপি-তৃণমূলের দ্বন্দ্ব তেমন পর্যায়ে পৌঁছয়নি। এছাড়া এই মামলার কুমির ছানা দেখিয়ে কিছু হেভিওয়েট তৃণমূল নেতাকে কিনে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল বিজেপির। তা না হলে দুর্নীতির অমন স্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কেন এতদিন এদের গ্রেফতার করা হল না!! আরেকটি বিষয়ও বহু আলোচিত। তাহলে ফিরহাদ, সুব্রত, মদন, শোভনকে গ্রেফতার করা হলেও মুকুল, শুভেন্দুকে কেন গ্রেফতার করা হয়নি? মুকুলের ক্ষেত্রে যেটা যুক্তি, তা হল তাকে ভিডিওতে টাকা নিতে দেখা যায়নি। হাস্যকর যুক্তি। তাহলে আর সাত বছর ধরে তদন্ত কেন হল! বাচ্চারাও বোঝে, তিনি বিজেপিতে গিয়েই গ্রেফতারি থেকে বেঁচে গেছেন। বাকি রইলেন শুভেন্দু। তবে শুধু শুভেন্দু নন, রয়েছেন কাকলি, সৌগত, প্রসূনের মতো কয়েকজন তৃণমূল সাংসদও। এক্ষেত্রে যেটা বলা হচ্ছে, তা হল- ঘটনার সময় এরা লোকসভার সাংসদ ছিলেন, এদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে লোকসভার অধ্যক্ষ অনুমোদন দেননি। এখন বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই, চার্জশিটে নাম না থাকার লোভ দেখিয়ে এদেরকে দলে টানার জন্যই দলের স্পিকারদের অনুমতি দিতে নিষেধ করেছিল মোদি-শা জুটি। শুভেন্দু দল বদলেছেন। অন্যদের তৃণমূল আটকেছে। তবে শুভেন্দুর পদক্ষেপের জেরে আপাতত লাভবান হয়েছেন কাকলি, প্রসূন, সৌগতরা। শুভেন্দুর মতো তাদের নামও চার্জশিটে নেই।
যাই হোক, এবার গ্রেফতারিতে আসা যাক। পশ্চিমবঙ্গের ভোটে বিপুল ভাবে হেরে সারা দেশে ভাবমূর্তির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে মোদি-শা জুটির। রাজ্যের বিজেপির কর্মীরা তো বটেই, নেতারাও মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন। তাদের উদ্দীপিত করতে ফলাফলের পরদিন থেকেই নানা পদক্ষেপ করে চলেছে বিজেপি। কখনও নাড্ডা এসেছে, কখনও রাজ্যপাল দলীয় নেতার মতো নানা জায়গায় গিয়ে কর্মীদের মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। সারা দেশে গণ মাধ্যমকে ব্যবহার করে বিজেপির ওপর তৃণমূলের সন্ত্রাসকে তুলে ধরা হয়েছে। নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক হিংসাতে সাম্প্রদায়িক রং লাগাবার চেষ্টা করা হয়েছে ফেক ভিডিও ছড়িয়ে। সেই তালিকায় শেষতম সংযোজন সোমবারের গ্রেফতারি।
কিন্তু এই সময়কালটা লক্ষ্যণীয়। গোটা দেশের মতো রাজ্যেও অতিমারি পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। কোভিড মোকাবিলায় মোদির ভূমিকা নিয়ে গোটা দেশে নিন্দার ঝড় চলছে। তা থেকে নজর ঘোরানোর জন্য এই গ্রেফতারিকে কাজে লাগাতে চায় বিজেপি। পাশাপাশি রাজ্য প্রশাসনের কোভিড মোকাবিলা কর্মসূচিকেও ঘেঁটে দিতে চায়। গত দু-তিন দিনে মুখ্যমন্ত্রী ও মুখ্যসচিবের সহোদররা কোভিড সংক্রান্ত জটিলতায় মারা গিয়েছেন। অর্থাৎ প্রশাসনের একেবারে শীর্ষমহল কিছুটা নড়বড়ে। কলকাতার মুখ্য প্রশাসক হিসেবে কোভিড মোকাবিলার দায়িত্বে ছিলেন ফিরহাদ হাকিম, তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগে কলকাতার মেয়রের দায়িত্ব সামলেছেন সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও শোভন চট্টোপাধ্যায়। তাঁরাও গ্রেফতার। এই ধরনের গ্রেফতারিতে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ দেখাবে, সেটা স্বাভাবিক। লকডাউন চলায়, তার ব্যাপকতা কিছুটা কম হলেও যেটুকু হচ্ছে, তাতেও অতিমারি পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা। সেটা হলে, তার দায়িত্ব পুরোপুরি রাজ্য প্রশাসনের উপর চাপানো যাবে। সামনে অনেকগুলি পুরসভার নির্বাচন রয়েছে। যে সব পুরনো বাম সমর্থকরা ‘বিজেপিই তৃণমূলকে টাইট দিতে পারবে’- এই আশায় বিজেপিকে ভোট দিয়ে আপাতত ভেঙে পড়েছেন, তাদের ভোট ধরে রাখার এটা একটা মরিয়া চেষ্টাও বটে। আর তৃণমূল কর্মীদের বিক্ষোভে যদি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে, তবে তা দেখিয়ে রাজ্যে জরুরি অবস্থাও জারি করার চেষ্টা হতে পারে।
তবে এসবই হিমশৈলের চূড়া মাত্র। শাসক শ্রেণির রাজনীতির কামড়াকামড়ির বেশির ভাগটাই হয় জনগণের চোখের আড়ালে। এমনটা হতেই পারে, সারদা মামলায় এ রাজ্যের সিআইডির শুভেন্দু অধিকারীকে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা রয়েছে। সেটা জেনেই এই পদক্ষেপ করল কেন্দ্রের এজেন্সি। অথবা হয়তো আরও বড়ো কিছু। সাম্রাজ্যবাদী ও মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের যে গোষ্ঠীর হয়ে বিজেপি কাজ করে, তাদের কিছু পলিসি পশ্চিমবঙ্গে লাগু করতে হয়তো তৃণমূল বাধা দিচ্ছে। নিজেদের পছন্দের গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে চাইছে। হয়তো তা নিয়েই দ্বন্দ্ব তীব্র আকার নিয়েছে। মনে রাখতে হবে, কোভিড ঘিরে দুনিয়া জুড়ে লক্ষ কোটি টাকার ব্যবসা চলছে। টিকা কেনার জন্য দু-একদিনের মধ্যেই গ্লোবাল টেন্ডার ডাকতে চলেছে রাজ্য। এই পরিস্থিতিতে এই ধরনের দ্বন্দ্ব তীব্র হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
এ সবই অবশ্য অনুমান। কারণ যাই হোক, জনস্বাস্থ্যের এহেন জরুরি অবস্থায়, লকডাউনের মধ্যেও বিজেপির মতো ফ্যাসিস্ট দল যে জনগণের কথা ভাবতে একটুও আগ্রহী নয়, এ দিনের গ্রেফতারি তারই প্রমাণ। তাদের বাংলা দখলের ভাবনা ছিল শুধুই নিজেদের স্বার্থে। তারা পুঁজিপতিদের যে অংশের স্বার্থ দেখে- তাদের ও নিজেদের দলের একাধিপত্যের লক্ষ্যে। তার সঙ্গে রাজ্যের মানুষের ভালোমন্দের কোনো সম্পর্ক ছিল না। শাসক শ্রেণির সব দলের ক্ষেত্রেই এটা সত্য। তবে বিজেপি-আরএসএসের মতো ফ্যাসিস্টরা তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। এরা পা থাকে মাথা অবধি জনবিরোধী। এদিনের গ্রেফতারি তারই প্রমাণ।