Home জনস্বাস্থ্য করোনার জুজু ও ছাত্রছাত্রীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

করোনার জুজু ও ছাত্রছাত্রীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

করোনার জুজু ও ছাত্রছাত্রীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
0
সৌহার্দ্য কর

১৫ মার্চ, ২০২০ – কোরোনা সংক্রমণ রুখতে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৫ দিনের জন্য বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় রাজ্য সরকার। তার এক সপ্তাহ, অর্থাৎ ২২ মার্চ কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে পরিকল্পনাহীন ভাবে লকডাউন হয় গোটা দেশে। কোটি কোটি স্থানান্তরিত শ্রমিক, যাদের বাজারি মিডিয়া ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ নামে আখ্যায়িত করে, লকডাউনের ফলে তাদের সন্তানদের নিয়ে পায়ে হেঁটে, পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়ে, হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে গ্ৰামে ফেরার সব অমানবিক দৃশ্যের সাক্ষী থেকেছি আমরা। এই পরিকল্পনাহীনতার দায় অবশ্যই কেন্দ্র এবং সমস্ত রাজ্য সরকারের। ঠিক একই পরিকল্পনাহীনতার পরিচয় আজ আমরা ছাত্রছাত্রীরাও পাচ্ছি, কারণ এক বছর এক মাস অতিক্রম করে গেলেও করোনার জুজু দেখিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজও বন্ধ।

বিশ্বায়নের ফলে বিদেশি পুঁজির সাথে সাথেই উচ্চ মধ্যবিত্তদের সিনেমার তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে হলিউড। ঠিক সেইজন্যই বোধহয়, ভারতের কর্পোরেট মিডিয়াও ব্যস্ত করোনাকে, বাড়ির বাইরে বেরোলেই ‘জম্বি’ (হলিউডের একপ্রকাশের রাক্ষস) তেড়ে এসে খপ করে খেয়ে নেবে প্রকার একটা রূপ দিতে। যদিও তথ্য বলছে অন্য কথা, যেমন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী কেবল ২০১৯ সালে টিবি র কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ৭৯,০০০ অর্থাৎ প্রতি তিন মাসে গড়ে ২০,০০০-এর কাছাকাছি । যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান অনুযায়ী ৭৯,০০০ সংখ্যা টা ভুল, বরং ভারতে টিবির কারণে মৃত্যুর হার বছরে ৪.৪ লাখের কাছাকাছি। উল্টোদিকে ২০২০ সালের করোনা সংক্রমণের খবর তুঙ্গে থাকা মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুনের মাঝামাঝি, অর্থাৎ সাড়ে তিন মাস সময়ে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ১৫,০০০ এর কাছাকাছি। টিবি নিয়ে সাম্প্রতিক কালে আমরা এমন হুলস্থূল পরে যাওয়া প্রচার বা পদক্ষেপ দেখিনি মিডিয়া বা সরকারের পক্ষ থেকে, খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই টিবি যা করোনার থেকে বেশি মানুষের জীবন কেড়ে চলেছে, তা নিয়ে চিন্তিত নই , ভয়ও নেই, স্কুল কলেজ বন্ধ বা লকডাউনও হয়নি কখনও।

স্কুল কলেজে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে একটা ভূত , কোরোনার ভূত। হ্যাঁ, সরকারের মতে সিনেমা হল, শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, বার এসব জায়গায় এই ভূত ধাওয়া না করলেও, স্কুল কলেজে অবশ্যই করবে , তাই এই ভূত থেকে বাঁচতে স্কুল কলেজ খুলতে রাজি নয় রাজ্য সরকার। একটি সুস্থ সমাজ, শক্তিশালী দেশ গড়ে তোলার জন্য জনগণের খাওয়া দাওয়া, নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ার মতই দরকারি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। আমরা আগেরবার দেখেছিলাম বাড়িতে বসে অনলাইনে অর্ডার করে জিনিসপত্র কেনা বাবুরাই রাস্তায় শ্রমজীবী মানুষদের দেখে সবচেয়ে বেশি নাক উঁচু করে ‘বাঁচলে তবে না খাবে’ বলে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিল। আজ সেই বাবুরাই স্কুল কলেজে করোনার ভূত দেখতে পাচ্ছে। যে স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিয়ে চিন্তিত তারা, আগামী দিনে সেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দায় ঘাড়ে তুলে নেওয়া ডাক্তারির ছাত্রছাত্রীরা আজ বাড়িতে বসে অনলাইনে ডাক্তারি শিখতে বাধ্য হচ্ছে। অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে যদি ডাক্তারি শেখা যেত তাহলে ঘরে ঘরে ছাত্রছাত্রীরা ইউটিউব দেখেই ডাক্তার হয়ে যেত। একই কথা খাটে প্রযুক্তি বিদ্যার ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রেও। আইটিআই , পলিটেকনিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে পড়া লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী, যাদের কারিকুলামে ল্যাব, ওয়ার্কশপ বাধ্যতামূলক, কিন্তু তা কখনই অনলাইনের মধ্যে সম্ভব নয়, তাই তাদের, আগামীর দেশ নির্মাণের ভারপ্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা পরিপূর্ণ হচ্ছে না। ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়াও অনেক প্রয়োগমূলক বিষয়ের ছাত্রছাত্রীরাই নিঃসন্দেহে পিছিয়ে পড়ছে, যা আগামীদিনে এক বিশাল সমস্যার সৃষ্টি করবে।

বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা, ডাক্তারি সহ বিভিন্ন প্রয়োগমূলক বিষয়ে তো বটেই, এমনকি ইংরেজি , ইতিহাসের মত বিষয়ও অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে পড়ানো, সৃষ্টি করছে নতুন বৈষম্য, ‘ডিজিটাল ডিভাইড’। সস্তা শ্রমিকের জন্য পরিচিত ভারতের শ্রমজীবীদের ক্রয় ক্ষমতা নিতান্তই কম। তাদের পক্ষে সম্ভব নয় তাদের সন্তানদের জন্য স্মার্ট ফোন, দ্রুত গতির ইন্টারনেট ব্যবস্থার মত বিলাসবহুল শিক্ষা ব্যবস্থার সুবিধা কেনা সম্ভব নয়। ২০১৭-১৮ এর ন্যাশনাল সার্ভে স্কিমের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের মাত্র ২৪% বাড়িতে অনলাইন ক্লাস করার জন্য প্রয়োজনীয় হাই স্পিড ইন্টারনেটের ব্যবস্থা আছে। গ্ৰামেগঞ্জে বাস করা ৬৬% জনগণের অবস্থা আরো শোচনীয়, যেখানে মাত্র ১৫% বাড়িতে অনলাইন শিক্ষার সুযোগ আছে। আপাত দৃষ্টিতে পরিকল্পনাহীন অনলাইন শিক্ষা ঠিক মনে হলেও, তা সম্পুর্ন সঠিক নয়। এই লকডাউনের সময়কেই কাজে লাগিয়ে কেন্দ্র সরকার লাগু করে নয়া শিক্ষা নীতি ২০২০ , যার দরুন উন্নয়নের নামে হবে শিক্ষার বেসরকারীকরণ এবং অনলাইন শিক্ষার প্রসার ।

দি ওয়্যার-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে প্রতি ১০ লাখ কোরোনা আক্রান্তদের মধ্যে ১৩০ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এবং তার জন্যই না কি লকডাউন,  স্কুল কলেজ বন্ধ রাখা ইত্যাদি। কিন্তু সমাজ যান্ত্রিকভাবে, ঐকিক নিয়মে চলে না। সাম্প্রতিক মার্কিন পিউ রিসার্চ থেকে জানা যায় যে ৩.২ কোটি মানুষ যারা ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণি’ হিসেবে পরিচিত ছিল, তারা লকডাউনের ফলে মধ্যবিত্তের তকমা হারিয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই ধারণা করা যায় যে লকডাউনের ফলে কর্মসংস্থান হারিয়ে, জীবন জীবিকা নির্বাহের সামান্যটুকু উৎসও হারিয়েছে অনেকে, যার ফলে ক্ষুধায় মৃত্যুর হার বেড়েছে ভারতে, যা হয়ত আগামী রিপোর্টে দেখা যাবে। শুধু তাই নয়, কাজ হারিয়ে অবসাদে ভুগে আত্মহত্যার সংখ্যাও বাড়বে। করোনা লকডাউনের কারণে সুচিকিৎসার অভাবেও মৃত্যু হয়েছে গ্ৰামে বাস করা বহু মানুষের। ঠিক একইভাবে স্কুল কলেজ বন্ধ রেখে অনলাইন ক্লাস করা ছাত্রছাত্রীদের অনেকেরই চোখের, মাইগ্ৰেনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে যা আগামী দিনে স্বাভাবিক জীবনের অনেক ক্ষতি করবে। আবার অনলাইন ক্লাস করতে না পেরে, পরীক্ষা না দিতে পেরে ছাত্রছাত্রীদের আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। অতয়েব কেবল লকডাউন, স্কুল কলেজ বন্ধ রাখলেই যে মৃত্যুর হার কম থাকবে এমন উদ্ভট চিন্তা ভিত্তিহীন। বরং স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীদের এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *