Home রাজনীতি চুরাশি বছর ধরে নিঃশব্দে মিলিটারি কলেজ চালাচ্ছে আরএসএস

চুরাশি বছর ধরে নিঃশব্দে মিলিটারি কলেজ চালাচ্ছে আরএসএস

চুরাশি বছর ধরে নিঃশব্দে মিলিটারি কলেজ চালাচ্ছে আরএসএস
0

স্বদেশ রায়

রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)-এর শাখাগুলিতে লাঠি খেলা, ছোরা খেলা, মার্শাল আর্টসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, এ খবর নতুন নয়। কিন্তু যা সচরাচর আলোচনায় আসে না, ফলে অনেকেরই অজানা, তা হল চুরাশি বছর ধরে একটি মিলিটারি কলেজ চালাচ্ছে আরএসএস। ‘ভোঁসলে মিলিটারি স্কুল’ নামে মহারাষ্ট্রের নাসিকে এই কলেজটি তৈরি করেছিলেন আরএসএস প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের আদর্শগত গুরু বালকৃষ্ণ মুঞ্জে। ইতালির ফ্যাসিস্ত শাসক মুসোলিনির অনুপ্রেরণায় মুঞ্জে ১৯৩৭ সালে এই মিলিটারি কলেজটি তৈরি করেন। কলেজটি পরিচালনা করে আরএসএস প্রভাবিত সংস্থা সেন্ট্রাল হিন্দু মিলিটারি এডুকেশন সোসাইটি।

ভোঁসলে মিলিটারি স্কুলের ঘোষিত উদ্দেশ্য হল ভারতের সেনা বাহিনীতে চাকরি পাবার উপযুক্ত করে ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়া।সেনা বাহিনী ছাড়াও আইএএস, আইপিএস সহ অন্যান্য সরকারি চাকরি এবং বিশেষ করে আইটি সেক্টরে চাকরি পাবার উপযুক্ত করে তোলার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া। কলেজের ওয়েবসাইট থেকে জানা যাচ্ছে যে প্রথাগত বিজ্ঞান ও অন্যান্য শিক্ষাক্রমের পাশাপাশি এখানে বিশেষ ভাবে যুদ্ধ বিদ্যা শেখানো হয়। ছোটো ও বড়ো আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে শেখানোর পাশাপাশি এখানে শেখানো হয় লাঠি, তরবারি ও আগ্নেয়াস্ত্র সহ মিলিটারি ড্রিল প্রভৃতি। কলেজের অধ্যক্ষ হলেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এম এম মাসুর।

তবে ভোঁসলে মিলিটারি স্কুল স্থাপন করার আসল উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছিলেন মুঞ্জে নিজেই। তিনি বলেছিলেন, “গণহত্যার খেলা সফল ভাবে খেলবার জন্য আমাদের ছেলেদের তৈরি করতে হবে যাতে শত্রুপক্ষ যত বেশি সম্ভব আহত এবং নিহত হয়” (মুঞ্জে পেপারস)। শত্রুপক্ষ বলতে তিনি কোন সম্প্রদায়ের কথা বলেছিলেন তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়।

এহেন কলেজটি মহারাষ্ট্র সরকারের শিক্ষা দফতর দ্বারা স্বীকৃত। ১৯৯৫ সালে ইন্ডিয়ান পাবলিক স্কুল কনফারেন্সও এই কলেজটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কংগ্রেস, বিজেপি, শিবসেনা প্রভৃতি কোনও দলের শাসনকালেই আরএসএস প্রভাবিত এই কলেজটির কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলা হয়নি। যদিও ২০০৮ সালের মালেগাঁও বিস্ফোরণে যুক্ত থাকার অভিযোগে নয় বছর জেলে থাকা এবং অধুনা মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় সেনা বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল শ্রীকান্ত পুরোহিত কিছুদিন এই কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন। গত ৮৪ বছরে এই কলেজটি থেকে কতজন ছাত্র সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন, এবং এর ফলে ভারতের সেনাবাহিনীর মধ্যে আরএসএস-এর সংগঠন কতটা মজবুত হয়েছে, আইএএস, আইপিএস প্রভৃতি সরকারি প্রশাসনের উচ্চতম স্তরে মিলিটারি ট্রেনিং প্রাপ্ত আরএসএস প্রভাবিত কতজন অফিসার তৈরি হয়েছে, সে সম্বন্ধে কোনও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রাক্তন প্রধান ভি কে সিংহ চাকরি থেকে অবসর নেবার পরে পরেই যেভাবে বিজেপি সরকারের মন্ত্রীর পদ পেয়েছিলেন, তা থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে আরএসএস-এর প্রভাব বিস্তারের খানিকটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাছাড়া ভোঁসলে মিলিটারি স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন পদ্মভূষণ প্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল এম এল চিব্বার সহ একাধিক লেফটেন্যান্ট জেনারেল, এয়ার মার্শাল অজিত ভোঁসলে, আইপিএস অফিসার আর সেঠিয়াসুন্দরম, চিন্ময় পন্ডিত, মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন কংগ্রেস মন্ত্রী ভারত বোন্দ্রে এবং শ্রীকান্ত জিচকার। ১৯৯৯ সালে নাগপুরে এই কলেজের আরও একটি শাখা খোলা হয়েছে।

এই দুটি কলেজ ছাড়াও উত্তরপ্রদেশের শিকারপুরে আরও একটি মিলিটারি কলেজ তৈরি করার কাজ শুরু করেছে আরএসএস। ভারতীয় সেনা বাহিনীতে কেবল মাত্র অফিসার পদে যোগ দেবার উপযুক্ত করে এখানে ছাত্রদের ট্রেনিং দেওয়া হবে। তাছাড়া সেন্ট্রাল হিন্দু মিলিটারি এডুকেশন সোসাইটির বদলে নতুন এই কলেজটি চালাবে আরএসএস-এর সংগঠন বিদ্যা ভারতী।

ভোঁসলে মিলিটারি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা বালকৃষ্ণ মুঞ্জে ১৯২৭ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত হিন্দু মহাসভার সভাপতি ছিলেন। মুঞ্জের পরে হিন্দু মহাসভার সভাপতি হন বিনায়ক দামোদর সাভারকার। মুঞ্জে, সাভারকার এবং আরএসএস প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার – এই তিনজনেরই ঘোষিত লক্ষ্য ছিল হিন্দু যুবকদের সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা যাতে ভারতে বসবাসকারী অহিন্দু, বিশেষত মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের পদানত করে রাখা যায়। কিন্তু এই তিনজনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং চিঠিপত্র থেকে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে তাঁদের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ বাড়িয়ে তুলে ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে পথভ্রষ্ট করা এবং  হিন্দু, অহিন্দু নির্বিশেষে সমগ্র ভারতবাসীকে ব্রিটিশের পদানত করে রাখা। সেই উদ্দেশ্যেই মুসোলিনির ব্ল্যাক শার্ট আর হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর অনুকরণে একটি আধাসামরিক বাহিনী গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তারা।

মুঞ্জে, সাভারকার এবং হেডগেওয়ারের উত্তরসূরি মোহন ভাগবত, নরেন্দ্র মোদিরা শাসন, শোষণ টিকিয়ে রাখার সেই একই পথ অনুসরণ করে চলছে। মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় সেনা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে দেশে ‘জাতিয়তাবাদী ভাবাবেগের বৃদ্ধি’ এবং সেই সঙ্গে ‘বেকারি বৃদ্ধির’ কথা মাথায় রেখে তারা যুব সম্প্রদায়কে তিন বছরের জন্য চাকরি দিতে চায়। সেই সঙ্গে তারা আরও জানিয়েছে যে বাহিনীতে স্থায়ী চাকরির বদলে তিন বছরের মেয়াদে চাকরি দেবার ব্যবস্থা থাকলে অবসরকালীন ভাতা, বেতন বৃদ্ধি প্রভৃতি করতে হবে না। ফলে খরচ বাঁচবে। ২০১৮ সালেই নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছিলেন যে ন্যাশনাল ইয়ুথ এম্পাওয়ারমেন্ট স্কিম অনুযায়ী দেশের দশ লক্ষ যুবককে সামরিক শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা করবে কেন্দ্রীয় সরকার।

Share Now:

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *