পুলিশের বেঁধে দেওয়া রুট থেকে বেরিয়ে যাওয়া, ট্র্যাক্টর চালিয়ে পুলিশকে ভয় দেখানো, লালকেল্লায় ঢুকে পড়া, সেখানে পতাকা টাঙানোতে বড়ো পুঁজিপতিদের মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমগুলো ‘গেল গেল’ রব তুলেছে। গত দুমাসে যখন প্রায় দেড়শো কৃষক মারা গেছেন দিল্লির সীমান্ত ঘিরে বসে থেকে, তখন কিন্তু কোনো সংবাদমাধ্যম এসব কথা তোলেনি, বলেনি মোদির কেন্দ্রীয় সরকার বড়ো নির্দয়।
ব্যারিকেড গড়ে, মহিলা পুলিশদের রাস্তায় সার বেঁধে বসিয়ে দিয়ে, জলকামান দিয়ে , টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে, লাঠিচার্জ করে, কৃষকদের বাধ্য ছেলের মতো ছকবাঁধা আন্দোলনে থাকতে বলেছিলসরকার। অর্থাৎ তুমি আন্দোলন কর কিন্তু আমার কথা শুনে চল, দিন আনি দিন খাই-এর মতো মিছিল কর কিন্তু মরণপণ লড়াই কোরো না, ঠান্ডায় দু’মাস মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকার পর যখন দিল্লির রাস্তায় ঢোকার বিজয় অর্জিত হল, তখন উল্লাস প্রকাশ কোরো না। লড়ছো লড়ো, মরো কিন্তু কোনো বিকল্প ছবি তুলে ধোরো না।
আজ কৃষক বিক্ষোভের যে ছবিটি গোটা কিষাণ প্যারেডের চুম্বক- তা হল লালকেল্লায় কৃষকদের প্রবেশ, তাদের হাতে একদিকে তেরঙা, অন্যদিকে নানা সংগঠনের পতাকা। এই ছবি এক বিকল্প চিত্রকল্পের জন্ম দিয়েছে, নিপীড়িত, শোষিত, মানুষের সামনে এক নতুন আশার আলো দেখিয়েছে। আগামী ভারতবর্ষের ইতিহাসে এ ঘটনা খোদাই হয়ে রইল।
গণ আন্দোলনের নেতৃত্ব আন্দোলনের ধরন নির্ধারণ করে কিন্তু চাপিয়ে দেয় না বা ধরাবাঁধা একটা বা দুটো ধরনকেই মেনে চলতে হবে, এরকম কোনো ফর্মুলা জারি করে না। পৃথিবীর কোনো দেশ তো ছাড়ুন, ভারতের ইতিহাসেই তা কখনও হয়নি। যখনই এরকম কোনো চাপিয়ে দেওয়া গণ্ডির মধ্যে আন্দোলনের ধরনকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে, তখনই তা এক বিশ্বাসঘাতকতা, এক হতাশার জন্ম দিয়েছে। চৌরিচৌরার ঘটনায় গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলন প্রত্যাহার মনে পড়ে? ১৯৪২-এর আগস্টে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের আহ্বানও কোনো বেঁধে দেওয়া ধরন মেনে চলেনি। এই পশ্চিমবাংলার মেদিনীপুরে ভারত ছাড়ো আন্দোলন সরাসরি এক বিকল্প সরকার, বিকল্প বাহিনী, বিকল্প কর ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিল, যেমনটা হয়েছিল মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলায়, যেখানে তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতৃত্বের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন সম্পর্কে ভুল মূল্যায়ন উপেক্ষা করে স্থানীয় ভাবে কমিউনিস্ট ও সমাজবাদীরা এক বিকল্প সরকারের জন্ম দিয়েছিলেন।
লেনিন নামের এক বিপ্লবী নেতা ‘গেরিলা যুদ্ধ’ নামের এক লেখায় লিখছেন-“সমস্ত পুরনো সমাজবাদের থেকে মার্কসবাদের পার্থক্য হল, সংগ্রামের কোনো একটা ধরনের সাথে সে আন্দোলনকে বেঁধে ফেলে না। সংগ্রামের সবরকম বৈচিত্র্যময় রূপগুলোকে স্বীকার করে, আর সে কখনওই ‘উদ্ভাবন’ করে না বা ‘পাকিয়ে তোলে’ না, বরং সংগ্রামের গতিপথে বিপ্লবী শ্রেণিগুলোর লড়াইয়ের যে ধরনগুলো জন্ম নেয়, তাকে সাধারণীকরণ করে, সংগঠিত করে, সচেতন রূপ দেয়। মার্কসবাদ, সমস্ত বিমূর্ত মনগড়া ফর্মুলা আর কঠোর নিয়মের এক্কেবারে শত্রু, আন্দোলন যেমন যেমন বিকাশ ঘটবে, জনগণের শ্রেণি সচেতনতা যেমনযেমন বাড়বে, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংকট যত তীক্ষ্ণ হয়ে উঠবে, আন্দোলন আক্রমণ আর রক্ষণ এই দুয়েরই নতুন নতুন আর বৈচিত্র্যময় রূপের জন্ম দেবে, মার্কসবাদ দাবি করে এই গতিশীল আন্দোলনের প্রতি মনোযোগী দৃষ্টি। সুতরাং, মার্কসবাদ সংগ্রামের কোনো ধরন বা রূপকেই পুরোপুরি খারিজ করে দেয় না। সেই মুহূর্তে যা সম্ভব বা বর্তমান, শুধু সেই ধরনগুলোর মধ্যেই মার্কসবাদ নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে না, বরঞ্চ সাআজিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের সাথে সাথে ঐ সময়ে লড়াইরত মানুষদের কাছে এতদিন অপরিচিত যে সব রূপ অনুবার্য ভাবেই হাজির হয়, সেগুলোকেও স্বীকৃতি দেয়। বলা যায় মার্কসবাদ এখানে শেখে গণ অনুশীলন থেকে, পুঁথিঘরের কোণে বসে পদ্ধতি মেনে চলনেওয়ালাদের মতো সংগ্রামের ধরন সম্পর্কে জনগণকে শেখাতে যায় না”।
আর আরেক বিপ্লবী নেতা মাও বলেছিলেন, হুনান কৃষক আন্দোলনের তদন্ত রিপোর্ট লিখতে গিয়ে- “কৃষকরা জমিদারের বাড়ি যখন দখল করতো, তার শুয়োরগুলো মেরে, শস্য রান্না করে খেয়ে, নরম বিছানায় গড়াগড়ি দিত। ভদ্রবাবুরা এসবকে বলেন অতি বাড়াবাড়ি। বিপ্লব কোনো ডিনার পার্টি, কিংবা কোনো প্রবন্ধ লেখা, ছবি আঁকা কিংবা সেলাই করার কাজ নয়, ধীরেসুস্থে, সূক্ষ্ণ, শান্ত, নরম, দয়ালু, সজ্জন, বাঁধুনি দেওয়ার মতো নয়। এ হল এক বিদ্রোহ, এক শ্রেণি কর্তৃক আরেক শ্রেণির উৎখাত”।
দিল্লির কৃষকরা বিপ্লব করতে জড়ো হননি। কিন্তু আর পাঁচটা নিয়মবাঁধা, গতানুগতিক আন্দোলনের থেকে সে আলাদা হয়ে থআকবে যেমন দিল্লির হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় পরিবার ছেড়ে দু’মাস ধরে মাটি কামড়ে পড়ে থাকায়, তেমনি সে আলাদা হয়ে থাকবে ২৬ জানুয়ারি লালকেল্লায় হাজির হওয়ার মধ্যে দিয়েও। তারও আগের দু-মাস ধরে রেল-রাস্তা অবরোধ, টোলট্যাক্স বয়কট, জিও বয়কট, টাওয়ার উপড়ানোর মধ্যে দিয়ে যে দাঁতে দাঁত চাপা লড়াইয়ের মানসিকতা তৈরি হয়েছে, নদী যেমন চারপাশের পাহাড়ের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে নিজের হাত-পা ছড়িয়ে দেয়, দিল্লিতে ঢুকে মঙ্গলবার কৃষকরা সেটাই করেছেন। আশ্চর্যের কী ১৯৩০-এর দশকে ভারতে বা চিনে, চৌরিচৌরা বা হুনানে বা মেদিনীপুরে বা সাতারায় ‘বাড়াবাড়ি’ হয়েছিল, এদিন দিল্লির বুকেও হয়েছে।
কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বকে চাপ সামলাতে হবে, কাজেই তাদের বক্তব্য এই মুহূর্তে বাদ দেওয়া যাক। অমরিন্দর সিং, আপ, শশী থারুর সহ আর কেউ কেউ যখন কৃষক আন্দোলনের কেউ না হয়েও উলটো সুর গান, তখন বোঝা যায় তারা চাইছেন এমন আন্দোলন, যা শুধু সরকারকে বিব্রত করবে রাষ্ট্রে নয়। অথচ সংবিধানের ভূমিকায় বলা আছে- আমরা ভারতের জনগণ, এই সংবিধান আমাদেরকে দিলাম, জনতাই সার্বভৌম।
মঙ্গলবার কৃষকরা জনগণের সম্পত্তি পোড়াননি, পুড়িয়েছেন কর্পোরেটের আইন, কোনো ভাঙচুর করেননি, ভেঙেছেন ব্যারিকেড, কোনো পতাকা নামাননি শুধু নিজেদের পতাকা তুলে ধরেছেন, ঘোষণা করে দিয়েছেন যে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেই রাস্তায় জনতার আওয়াজকে উপেক্ষা করা যাবে না, আর জন্ম দিয়েছেন নতুন লড়াইয়ের ধরন, নতুন ভারতের আশার।