পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: গত মার্চে নরেন্দ্র মোদির সরকার তাড়াহুড়ো করে লকডাউন ঘোষণা করায় লক্ষ লক্ষ দিনমজুর এক রাতের মধ্যে কাজ হারান। সরকারের তরফে আর্থিক সাহায্য প্রায় ছিল না বললেই চলে। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক মাইলের পর মাইল হেঁটে শহর থেকে গ্রামে ফিরেছেন। অনেকেই পথে প্রাণ দিয়েছেন। অতিমারি থেকে নিজেদের রক্ষা করার কোনো উপায় তাদের কাছে ছিল না।
গত অক্টোবরে নিউইয়র্কে গরমের ছুটি ও প্রথম দফার লকডাউন পেরিয়ে সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা কাজে ফেরেন। যথাযথ কাজের পরিবেশ পাওয়ার বদলে তারা ক্লাসপিছু একটি স্যানিটাইজারের বোতল বা কয়েকটি মুখোশ পেয়েছেন। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার ফলে অনেক জায়গায় ড্যাম্প ধরে সিলিং ভেঙে গিয়েছে, কোথাও বা মেঝে ও ডেস্কে ইঁদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে।
গত এপ্রিলে সিঙ্গাপুরে পরিযায়ী শ্রমিকদের ভিড়ে ঠাসা ডরমিটরিতে ছড়িয়ে পড়ে কোভিড। ওই শহরের আকাশছোঁয়া বাড়িগুলো তারা নিতান্ত কম মজুরিতে বানিয়ে এসেছেন এতদিন। নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির সেই স্বপ্নের শহর অচিরেই শ্রমিকদের কাছে দুঃস্বপ্নের নগরীতে পরিণত হয়। কারণ, তাদের ডরমিটরির এলাকাগুলিতে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। যআতে ভাইরাস শহরের অন্যত্র ছড়াতে না পারে। সুস্থরা অসুস্থদের সঙ্গে একসাথে থআকতে বাধ্য হয় ফলে দাবানলের মতো ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। সংক্রমিতের সংখ্যা দিনে গড়ে ১০০০ ছাড়িয়ে যায়।
দুনিয়ার গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের জীবনে এই অতিমারি যে যন্ত্রণা, অনিশ্চয়তা ও সমস্যা বয়ে এনেছে, এগুলি তারই কয়েকটি উদাহরণ।
গত সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলা হয়, আর্থিক মন্দা বরাবরই গরিবদের বেশি সমস্য়ায় ফেলে কিন্তু বর্তমান অতিমারি জনিত মন্দা গরিবদের যে বিশাল সংকটে ফেলেছে, তা আগের কোনো মন্দায় দেখা যায়নি। দুনিয়া জুড়ে ৪০ কোটি মানুষ চাকরি খুইয়েছেন। দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন ৫০ কোটি মানুষ।
শ্রেণি বিভাজনের উল্টো দিকে, অর্থাত প্রযুক্তি, ওষুধ ও খুচরো ব্যবসার অতিধনী মালিকরা সংকটের শুরু থেকেই ধরণার জলের মতো পয়সা কামিয়েছে।
সেপ্টেম্বরে ‘ক্ষমতা, মুনাফা ও অতিমারি’ নামে অক্সফ্যাম একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, মার্চের মাঝামাঝি থেকে মে-র শেষ পর্যন্ত দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী ২৫ জনের সম্পত্তির পরিমাণ ২৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৃদ্ধি পায়। তাদের মিলিত সম্পত্তি বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
শ্রমিক শ্রেণিকে নিজেদের ব্যবস্থা করে নেওয়ার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, কোথাও হয়তো সামান্য কিছু উচ্ছিষ্ট ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বৃহৎ সংস্থাগুলিকে লক্ষ কোটি ডলার আর্থিক সাহায্য করেছে সরকারগুলো।
এছাড়াও বহু সংস্থা অতিমারিকে কাজে লাগিয়ে বিপুল পরিমাণে ছাঁটাই করেছে। কিন্তু তাদের মুনাফা ও শেয়ার হোল্ডারদের লভ্যাংশ একটুও কমেনি বরং বেড়েছে। মার্কিন পোশাক বিক্রেতা কোহল একটি বড়ো উদাহরণ। তারা এ সময় শেয়ার হোল্ডারদের ১০৫ মিলিয়ন ডালার দিয়েছে কিন্তু বেশিরভাগ কাজ হয়ে আয়ওয়া সত্ত্বেও তাদের বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার পোশাক প্রস্তুতকারকদের ১৫০ মিলিয়ন ডলার মেটায়নি।
সংস্থার এই সিদ্ধান্তের ফলে হাজার হাজার গরিব পোশাক শ্রমিককে উপার্জনহীন করে দেয়। বাংলাদেশের এক তরুণী সন্তানসম্ভবা শ্রমিক দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, “ওরা আমাদের মজুরি, ক্ষতিপূরণ বা প্রাপ্য সুযোগসুবিধা কিছুই মেটায়নি। ৬ বছর ধরে কাজ করার ফলে আমার অনেক টাকা পাওনা ছিল। কারখানা থেকে বলা হয়েছে, য়ে সব পোশাক আমরা তৈরি করে ফেলেছি, সেগুলোও বরাতকারী সংস্থা বাতিল করে দিয়েছে। আমি খুব কম মজুরিতে আমার যাবতীয় শক্তি ব্যয় করে পোশাক বানিয়েছি। প্রস্তুতকারক সংস্থা এবং ফ্যাশন ব্র্যান্ড এগুলি বেচে মুনাফা করতে পারবে কিন্তু আমাদের দুর্দশার কথা কেউ ভাবছে না”।
অ্সফ্যাম রিপোর্টে বলা হয়েছে, “ কোভিড ১৯-এর ফলে যে অসাম্য তৈরি হয়েছে, তা কোনো দুর্ঘটনা নয়। অন্যের থেকে শক্তি কেড়ে নিয়ে ধনীদের মুনাফা বাড়ানোর যে অর্থনৈতিক মডেল চলছে, এটা তারই ফল। অতিমারি কোনো আর্থিক, জাতিগত ও লিঙ্গগত বৈষম্য তৈরি করেনি, এটা কেবল তা বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে”।