দিল্লির রাজপথে এক পক্ষকাল পার করে এক নতুন মহাভারতের জন্ম দিচ্ছেন আমাদের অন্নদাতারা। কর্পোরেট স্বার্থবাহী কৃষি আইন — ২০২০ বাতিলের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে গোটা দেশে। গাড়ির উপর লাফিয়ে উঠে আন্দোলনরত তরুণ বন্ধ করে দিচ্ছেন জলকামান, প্রৌঢ় কৃষকের মেহনতি হাত উপড়ে ফেলছে পুলিশি ব্যারিকেড। কিষান রমণী চিৎকার করে বলছে ‘ইয়ে ইনকিলাব হ্যায়’। গুরুদোয়ারার লঙ্গরে, মসজিদের রান্নাঘরে রচিত হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক ভারতের ছবি। সময় সাক্ষী, ২০১৪ সালে কর্পোরেট লবির মদদপুষ্ট ‘ হিন্দি – হিন্দু- হিন্দুস্তানের’ কুচক্রী ফেরিওয়ালারা দিল্লির তখতে বসার পর থেকে শ্রমজীবী জনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করা মানুষদের উপর যে ধারাবাহিক আক্রমণ শুরু হয়েছে তার বিরুদ্ধে বারংবার গর্জে উঠেছেন কৃষকেরা। আজ করোনা অতিমারির সুযোগে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প, শ্রমিকের অধিকার, কৃষকের ভবিষ্যত, দেশবাসীর খাদ্য নিরাপত্তাকে কর্পোরেট হাঙরদের কাছে বন্ধক রাখতে তৎপর কেন্দ্রীয় সরকারকে এক মুখের মত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পেরেছে এই আন্দোলন। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিল্লির সিংহু বর্ডারের ধরনা অঞ্চলের ৫ টি এলাকার নামকরণ করেছেন বিগত সময়ের শহিদদের নামে। প্রথমটি বাবা বান্দা সিং নগর, যিনি কৃষকদের জমিদারদের হাত থেকে জমির অধিকার কেড়ে নেওয়ার ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের নেতা ছিলেন। দ্বিতীয়টির নামকরণ করা হয়েছে চাচা অজিত সিং-এর নামে, যিনি পঞ্জাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের অমর সংগীত ‘ পাগড়ি সামাল জাঠ্’-এর রচয়িতা। বর্তমান আন্দোলনে মহিলাদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতিকে মর্যাদা দিতে তৃতীয় অঞ্চলটির নামকরণ করা হয়েছে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী গুলাব কাউরের নামে। চতুর্থ এলাকাটি শহিদ – এ – আজম ভগৎ সিং-এর নামে। শেষ নামটি শহিদ সাধু সিং তখত পুরা, যিনি বিজেপি – আকালি দলের মদতপুষ্ট জমি মাফিয়াদের হাতে খুন হন জমি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে। প্রেস গ্যালারির নামকরণ করা হয়েছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের আরেক শহিদ আশফাক উল্লা খানের নামে। এই নামকরণ ঘোষণা করে বিদ্রোহের ঐতিহ্য ও মেজাজ।
এই উত্তাল কৃষক তরঙ্গকে ভয় পেয়েছে দিল্লির সরকার। স্বাভাবিক ভাবেই চেনা ছকে আন্দোলনকে ভাঙতে চেয়েছে শাসকেরা। প্রথমে লাঠি,টিয়ার গ্যাস,জলকামান ও পেশিশক্তির সাহায্যে আন্দোলনকে গুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলেও ১২ লক্ষ কৃষকের সম্মিলিত প্রতিরোধে সশস্ত্র বাহিনী পিছু হটে ও কৃষকেরা দিল্লি প্রবেশে সমর্থ হয়। এরপর শুরু হয় দালাল কর্পোরেট মিডিয়া ও বিজেপির আইটি সেলের সাহায্যে আন্দোলনকারীদের ‘ খালিস্তানি’,পাকিস্তানি, ‘ মাওবাদী ‘ বলে দাগিয়ে দেওয়ার পালা। এ খেলাটা নতুন নয়। এর আগেও আমরা দেখেছি ‘ ভিমা- কোঁরেগাও ‘ আন্দোলনের সময়, জে এন ইউ-এর ছাত্র বিক্ষোভের সময়, এন আর সি– সিএএ বিরোধী উত্তাল প্রতিরোধের সময় আন্দোলনকারীদের ‘আর্বান নকশাল ‘, ‘ দেশদ্রোহী ‘, ‘ইসলামিক সন্ত্রাসী ‘ অভিধায় আখ্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু এবার এই কৌশল এখনও পর্যন্ত কাজে দেয়নি বরং এই দেগে দেওয়ার রাজনীতির বিরুদ্ধে কৃষকদের জঙ্গি মেজাজ স্তাবক মিডিয়া গোষ্ঠীগুলিকে ভীত করেছে। যেভাবে রিপাবলিক টিভি, টাইমস নাও, জিটিভির সাংবাদিকদের লড়াকু কৃষকেরা ঘেরাও করেছেন, তাড়া করেছেন তা অভূতপূর্ব। এই সাংবাদিককুলকে এখন পুলিশি ঘেরাটোপে ধরনামঞ্চ থেকে দূরে রিপোর্টিং করতে হচ্ছে। অন্যদিকে অল্টারনেটিভ মিডিয়া, ছোটো বড়ো নিউজ পোর্টাল,উত্তর ভারতের স্থানীয় নিউজ চ্যানেল ও অবশ্যই সোসাল মিডিয়ার কুশলী ব্যবহার কৃষকদের ভাষ্যকে জনগনের কাছে পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়েছে। শাসকেরা চেষ্টা করেছে আন্দোলনকে পঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকদের বিক্ষোভ বলে সীমায়িত করার। আলোচনায় পঞ্জাবের কৃষক সংগঠনগুলিকে আহ্বান ছিল সেই বিভেদকামী পলিসির অংশ। কিন্তু তা সফল হয়নি। কৃষকদের নেতৃত্ব এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে ইতিবাচক ভূমিকা দেখিয়েছে আলোচনার টেবিলে। সরকারের কাল হরণের প্রচলিত পদ্ধতিকে জনগণের সামনে উন্মোচিত করার জন্য যেমন তারা কখনও মৌনব্রত অবলম্বন করেছে, আবার ‘ কমিটি ‘ গঠনের প্রস্তাবকে সজোরে নাকচ করেছে। সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য তারা সরকারের দেওয়া জলখাবার ও চা পর্যন্ত প্রত্যাখান করেছে। একই সঙ্গে এই আন্দোলন বাধ্য করেছে বিজেপি বিরোধী প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে ( এদের অনেকেই এর আগে কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরে কৃষির কর্পোরেটকরণ প্রক্রিয়ায় সামিল ছিল) আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে। এই রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির সবচেয়ে বড়ো সাফল্য হল ৮ ডিসেম্বরের ভারত বনধ যা শুধু রাজনৈতিক দল নয়, দেশের প্রায় সমস্ত গণ সংগঠনগুলির আন্তরিক সমর্থন পেয়েছে। আবার রাজনৈতিক দলগুলি যাতে নিজেদের স্বার্থে আন্দোলনকে ব্যবহার করতে না পারে তার জন্য কৃষক নেতারা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে আহ্বান রেখেছে দলীয় পতাকা ও ব্যানার ছাড়া আন্দোলনে সামিল হতে।
কোনো নির্দিষ্ট দাবি ভিত্তিক আন্দোলন যখন তার পরিধি অতিক্রম করে বৃহত্তর গণ আন্দোলনে রূপান্তরিত হয় তখন তার সামাজিক অভিঘাত তীব্র হয়। এই আন্দোলনের ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই ঘটছে। যেহেতু আন্দোলনের ভরকেন্দ্র পঞ্জাব তাই সেখানকার সামাজিক অভিঘাত অনেক বেশি। পঞ্জাবের সাংস্কৃতিক জগৎ এই বিদ্রোহের সমর্থনে সামনের সারিতে। যেহেতু কৃষি ভিত্তিক গ্রাম সমাজ পঞ্জাবের সামাজিক জীবনের হৃৎপিণ্ড স্বরূপ তাই কৃষক যখন খেত ছেড়ে রাস্তায় তখন গায়ক,চিত্রতারকা,খেলোয়াড়, লেখক পুরস্কার ফেরত দিয়ে আন্দোলনের পক্ষে সওয়াল করছেন। এই আন্দোলন আন্তর্জাতিক স্তরে তার ছাপ ফেলতে শুরু করেছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সমর্থন, রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্বেগ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন ও জার্মানিতে আন্দোলনের সমর্থনে মিছিল নরেন্দ্র মোদির মিডিয়া নির্মিত সুপারম্যান ইমেজকে রীতিমত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। এককথায় এই আন্দোলন আজ এক বৃহত্তর গণ বিদ্রোহে রূপান্তরিত হওয়ার যাবতীয় সম্ভাবনাকে হাজির করছে।
এই কৃষক বিদ্রোহের তাৎপর্য অনুধাবন করার ক্ষেত্রে প্রথমেই দরকার আন্দোলনের কালানুক্রমিকতার সন্ধান। স্বতঃস্ফুর্ত তার পূজারীরা যতই এই আন্দোলনকে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করুন না কেন, এটা মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ৯০-এর দশকে ভারতে নয়া সংস্কার পর্ব চালু হওয়ার পর থেকেই শাসকশ্রেণির তরফে কৃষি ক্ষেত্র থেকে রাষ্ট্রের দায় প্রত্যাহার পর্ব শুরু হয়। ডিজেল,বীজ,সার থেকে কৃষি ভর্তুকি হ্রাস,গণ বণ্টন ব্যবস্থাকে দুর্বল করা এবং বিভিন্ন ধরনের সংস্কার ও পলিসির মাধ্যমে কৃষিতে কর্পোরেট অনুপ্রবেশের পথ প্রস্তুত করা ছিল রাষ্ট্রের দায় প্রত্যাহারের ব্যবহারিক ফল। একদিকে এর ফলে যেমন কৃষিকাজের খরচ বেড়ে যায় এবং সেই খরচ জোগাড়ে কৃষক মহাজনের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে কারণ প্রাতিষ্ঠানিক ঋনের অপ্রতুলতা। ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থা এক ধ্বংসাত্মক দিকে যাত্রা শুরু করে। ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সময়পর্বে ভারতে অন্তত ৫ লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করে। কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে উৎপাদিত ফসল রাস্তায় ফেলে নষ্ট করে দিচ্ছে — এ এক অতি পরিচিত দৃশ্য হয়ে দাঁড়ায়। ২০০০ সালের সূচনালগ্ন থেকে কর্পোরেট উন্নয়ন মডেলকে বাস্তবায়িত করার জন্য দাসত্বের নয়া সনদ ‘ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ‘ ( সেজ) চালু হয় ফলে কৃষকেরা তাদের উর্বর জমি থেকে উচ্ছেদ হতে শুরু করেন।
এখানে বলার বিষয় হলো কৃষক সমাজের উপর রাষ্ট্র পরিচালকদের এই আগ্রাসন কিন্তু কৃষকরা মুখ বুজে মেনে নেননি বরং তাদের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের কারণে শাসকদের সাময়িক পশ্চাদপসরণ করতে হয়েছে। পূর্ব ও মধ্য ভারতে (কলিঙ্গনগর,পস্কো,সিঙ্গুর,নন্দীগ্রাম, ভাট্টিপারসাল) উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় ঔপনিবেশিক জমি অধিগ্রহণ আইন বাতিল করে কৃষকদের সন্মতি মোতাবেক ‘ right to fair compensation and transparency in land acquisition ( rehabilitation and resettlement act) 2013 ‘ চালু হয়। যদিও এই আইনে অনেক খামতি ছিল তবুও শাসকশ্রেণির তা না পসন্দ হওয়ার কারণে নরেন্দ্র মোদি তা বাতিল করতে চান। যদিও দেশজোড়া প্রতিবাদের মুখে তা সফল হয়নি। আবার কৃষকদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে ব্যালটে রূপান্তরিত করার জন্য নরেন্দ্র মোদির ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল কৃষকের আয় দ্বিগুন করার বা স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন। অভূতপূর্ব নির্বাচনী সাফল্য অর্জিত হলেও দিল্লির মসনদে আসীন হওয়ার পরেই নরেন্দ্র মোদি সরকার কর্পোরেট অ্যাজেন্ডা রূপায়ণে তৎপর হয় ফলে কৃষকেরা বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে ফসলের ন্যায্য দাম,ঋণভার থেকে মুক্তির জন্য লড়াইয়ে নামে। ২০১৭ সালের জুন মাসে কৃষকদের বিক্ষোভ চলাকালীন মধ্যপ্রদেশের মান্দাসৌরে বিজেপি সরকারের পুলিশ গুলি চালালে ৬ জন কৃষক শহিদ হন। এই সময় রাজস্থানেও কৃষক ও আদিবাসীরা ধারাবাহিক প্রতিরোধে সামিল হয়। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে সারা ভারত কৃষক সভার উদ্যোগে মহারাষ্ট্রে ‘ লং মার্চ’ অনুষ্ঠিত হয় যা সারাভারতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ঐ বছরই নভেম্বর মাসে সারা ভারত কৃষকসভা সহ বিভিন্ন বামপন্থী ও সোসালিষ্ট ভাবনায় অনুপ্রাণিত সংগঠন রাজধানীতে সমবেত হন ‘ অল ইন্ডিয়া কিষান সংঘর্ষ কমিটির ‘ ব্যানারে। স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষে সেটাই ছিল সর্ব বৃহৎ কৃষক জমায়েত যেখানে কৃষকেরা তাদের দাবিসনদ পেশ করে। সেই দাবি সনদের প্রধান দুটি দাবি ছিল ভারতীয় সংসদে ‘ ঋণ ভার থেকে কৃষকদের মুক্তি বিল’ এবং ‘ কৃষকদের উৎপাদিত কৃষি পণ্যের নিশ্চিত লাভজনক ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পাবার অধিকার বিল’ পাশ করানো। এই ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকারগুলি নানা প্রকল্প ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। এই প্রকল্পগুলোর নাম ধাম আলাদা হলেও বিষয়বস্তু মোটের উপর একরকম — চাষের জন্য আগাম অনুদান, পেনশন, চাষির মৃত্যুতে অনুদান, ফসল বিমার প্রিমিয়াম, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সামান্য বৃদ্ধি, সর্বোপরি কৃষি ঋণ মকুবের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু এ ধরনের প্যাকেজ ভারতীয় কৃষির মূলগত সমস্যাগুলির সমাধান করতে পারেনি। আবার ভারতের বর্তমান শাসকেরা কোনোভাবেই কৃষিকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রকল্প থেকে সরে আসতে পারবে না, তাই তারা নতুন আইন পাশ করেছে। ভারতীয় কৃষকও তাদের পূর্বেকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পুনরায় প্রতিরোধের ময়দানে নেমে পড়েছে।
দিল্লির কৃষক আন্দোলনে ধনী কৃষকদের ব্যাপক সংখ্যায় উপস্থিতি একটি চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই আলোচনায় প্রবেশ করার আগে সাধারণভাবে সরকার কর্তৃক প্রচারিত বিভ্রান্তিমূলক সংবাদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। এই আন্দোলন শুধু পঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা সমবেত হয়েছে — এটা একটা পরিকল্পিত মিথ্যাচার। পঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকদের সংখ্যাধিক্য থাকলেও উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, হিমাচলপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের কৃষকরা এতে উপস্থিত হচ্ছেন ও দিনে দিনে সংখ্যাটা বাড়ছে। একই ভাবে ধনী কৃষকরা যথেষ্ট সংখ্যায় থাকলেও মধ্য ও ক্ষুদ্র কৃষকরা এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। ‘ সংযুক্ত কিষান মোর্চা’ নামক যে সমন্বয়টি তৈরি হয়েছে তাতে ৫ শতাধিক সংগঠন রয়েছে। ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের বিভিন্ন গোষ্ঠী ( উগরাহান,চাডুনি,টিকায়েত,রাজওয়াল,ডাকুন্দা) যেমন রয়েছে তেমনি আছে তাজিন্দার সিং ভির্কের তরাই কিষান সভা,রামপাল চাহালের ভরসনের গণ সংঘর্ষ সমিতি, সত্যবানের অল ইন্ডিয়া কিষান খেত মজদুর সংগঠন, ডঃ সুনিলমের কিষান সংঘর্ষ সমিতি, বামপন্থী কৃষক নেতা ডঃ দর্শন পালের ক্রান্তিকারী কিষান ইউনিয়ন, হান্নান মোল্লা, অশোক ধারওয়ালের অল ইন্ডিয়া কিষান সভা, যোগেন্দ্র যাদব,অভীক সাহাদের জয় কিষান আন্দোলন, মেধা পাটেকরদের এন এ পি এম সহ বহু ছোটো – বড়ো সংগঠন। তাই শুধু ধনী কৃষকদের নেতৃত্বে ও স্বার্থে এই আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে — এই তথ্য সঠিক নয়।
এবার আসা যাক ধনী কৃষকদের প্রশ্নটিতে। যদি তর্কের খাতিরে একথা মেনেও নেওয়া যায় যে ধনী কৃষকরা এই আন্দোলনের চালিকা শক্তি তাহলে কি কর্পোরেট ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থবাহী কৃষি আইনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা এই বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত থাকে না? সোজা কথাটা হল এই আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব ধনী কৃষকেরাই। এরাই প্রথম ও দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাজাত সুযোগ পাওয়ার ফলে একটি শক্তিশালী শ্রেণি হয়ে উঠেছে এবং এরা আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী। ভারতের মতো আধা সামন্ততান্ত্রিক ও আধা ঔপনিবেশিক দেশে তত্ত্বগত ভাবে এদের মধ্যে জাতীয় বুর্জোয়ার আকাঙ্খা প্রকাশিত। ৯০’ এর দশকে গৃহীত সংস্কার কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষিতে কর্পোরেট অনুপ্রবেশের পথ প্রশস্ত করার যে প্রকল্প ভারতের শাসকরা নিয়েছে তার দ্বারা এরা আক্রান্ত। তাই তারা লড়াইয়ে নেমেছে। বৃহৎ মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া অম্বানি-আদানিদের পণ্য বয়কটের শ্লোগানও উঠেছে এই আন্দোলন থেকে। এই বিদ্রোহ দেখিয়ে দিচ্ছে যে ভারতবর্ষ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বা নিদেন পক্ষে পঞ্জাব- হরিয়ানাতে কৃষিতে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে গেছে বলে যারা মনে করেন তাদের মূল্যায়ন বাস্তবোচিত নয় বরং নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে যারা লক্ষ্য বলে মনে করেন তাদের কাছে এই ধনী কৃষকরা দোদুল্যমান মিত্র। তাই কর্পোরেটরাজের বিরুদ্ধে ধনী কৃষকদের বিদ্রোহকে স্বাগত জানাতে হবে। একই সঙ্গে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্বে বামপন্থীদের উপস্থিতি। বামপন্থী নেতৃত্ব যদি একথা বলতে পারেন যে শুধু এই তিনটি আইন প্রত্যাহারই নয়, একই সঙ্গে আন্দোলনের দাবি সনদে যুক্ত করতে হবে আমূল ভূমি সংস্কার, খাস জমি বণ্টন, জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন সংশোধন প্রত্যাহার, কৃষি উপকরণের মূল্য হ্রাস, সর্বজনীন গণবন্টন ব্যবস্থা, কৃষি বিপণন ব্যবস্থায় সরকারের ভূমিকা বৃদ্ধি, কৃষি মজুরি বৃদ্ধির মত বিষয়গুলি, তাহলে আগামী দিনে আরো দীর্ঘস্থায়ী কৃষক বিদ্রোহের সম্ভাবনা তৈরি করা যাবে। আমরা জানি কৃষক সমাজ বিভিন্ন বর্গে বিভক্ত যেমন ধনী কৃষক, মধ্য কৃষক, প্রান্তিক কৃষক, খেতমজুর। এদের স্বার্থের মধ্যে বিভিন্নতা, দ্বন্দ্ব যেমন আছে, তেমনই কোনো একটি বিষয়ের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ঐক্যও আছে। তাই যতদিন যাবে, এই আইন তার ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়ার কারণে বিভিন্ন বর্গের কৃষকদের মধ্যে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের সূচনা করবে।
এই আন্দোলন অসীম সম্ভাবনাময়। কৃষক আন্দোলন হিসাবে শুরু হলেও আগামীতে তা এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনে রূপান্তরিত হবার যাবতীয় উপাদান মজুত। এই নতুন আইনের মূল লক্ষ্য গ্রাম ভারতের অর্থনীতিতে কর্পোরেটদের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা। খাদ্য সরবরাহের শৃঙ্খলটি কর্পোরেটদের হস্তগত হলে শুধু ধনী কৃষকদের নয়, অন্যান্য কৃষিজীবী মানুষ এবং শহরাঞ্চলের দরিদ্র জনতার খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। যেমন ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে আইনি অধিকার হিসাবে ঘোষণা ও সরকারকে আরও বেশি করে ফসল কিনতে হবে — এ দাবি শুধু কৃষকদের দাবি নয়। কারণ সরকার এম এস পি-তে ফসল কিনবে গণ বন্টন ব্যবস্থার জন্য। আর কর্পোরেটদের লক্ষ্য গণবন্টন ব্যবস্থাকে দুর্বল করা। করোনাকালে এটা প্রমাণিত যে এখনও পর্যন্ত গণ বন্টন ব্যবস্থা চালু থাকার জন্য দেশের বহু লোক খাদ্যাভাবে মারা যাননি। এই কর্পোরেট আইন ও নতুন বিদ্যুৎ আইন মধ্য ও ক্ষুদ্র কৃষকদের অস্তিত্বকেও বিপন্ন করে তুলবে। তারা বাধ্য হবে সরকারি নিয়ন্ত্রণ মুক্ত কর্পোরেট ক্রেতাদের অত্যন্ত কম দামে তাদের পণ্য বিক্রি করতে। আবার চুক্তি চাষের সুযোগ নিয়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলি চাইবে কৃষকরা যাতে খাদ্য শস্যর বদলে ব্যয় সাপেক্ষ অর্থকরী ফসলের চাষে আগ্রহী হয়, লক্ষ্যটা হল ভারতকে খাদ্য শস্য আমদানির বাজারে রূপান্তরিত করা। এককথায় এই আইন ভারতের কৃষি ব্যবস্থায় এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ডেকে আনবে। মনে রাখা দরকার যে জিডিপিতে কৃষির অংশ যত কমই হোক না কেন, এই ক্ষেত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশের ৫৫% মানুষ যুক্ত। তাই কৃষকেরা প্রতিবাদে রাস্তায় নামলে দেশব্যাপী তার প্রতিক্রিয়া হবেই। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দিল্লির শাসকদের সঙ্গে কর্পোরেটদের স্বার্থ ( বিশেষ করে আম্বানি ও আদানি গোষ্ঠী) যে এক সূত্রে বাঁধা সেই সত্যটা জনমানসে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। এই আন্দোলনকে সফল করতে দেশের শ্রমজীবী ও গণতান্ত্রিক মানুষদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শ্রমিক স্বার্থ ধ্বংসকারী শ্রমকোড-এর বিরুদ্ধে যদি এই সময় আরেকটা বড়ো প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় তাহলে দিল্লির শাসকরা আরও পিছু হটতে বাধ্য হবেন।
এই কৃষক আন্দোলনকে তার সঠিক পরিণতির প্রয়োজন এমন এক গতিশীল নেতৃত্ব যে নেতৃত্ব শ্রেণীদৃষ্টিকোন থেকে বিচার বিশ্লেষন করে প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়ে তার পরিণতির দিকে পরিচালিত করা।এটাই এখনকার কর্তব্য ও দায়িত্ব ।কাজ ও পথ সহজ নয় ,একমাত্র সঠিক নেতৃত্ব জয় চিনিয়ে নিতে পারবেই ।জনতার জয় আবশ্যম্ভাবি।
সুন্দর লেখা। অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। প্রশ্ন হচ্ছে বর্তমান পৃথিবীর সর্বগ্রাসী দক্ষিণপন্থার সাময়িক জয় এবং কর্পোরেট পুঁজির বিপুল চাপের সামনে সম্ভাবনাকে কতটা বাঁচিয়ে রাখা যাবে। সমাজের অন্যান্য স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া এককভাবে বেঁচে থাকা মুশকিল। অতীতের আন্দোলনের শিক্ষা এ কথা বলে।
কৃষি নীতির আরেকটি ভয়ংকর দিক হচ্ছে আইনী বিচার পাবার রাস্তা প্রায় লুপ্ত। এবং প্রশাসকেরা বিচারের ক্ষমতা পাচ্ছে।