পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: চিলির বিপ্লবীরা কিছুদিন আগে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, গোটা লাতিন আমেরিকা শুকনো কাঠ হয়ে রয়েছে। ফুলকির অপেক্ষায় রয়েছে। এই মুহূর্তে তার প্রমাণ দিচ্ছে পেরু। গত বছর চিলি ও ইকুয়েডরের জনগণের বিদ্রোহ গোটা দুনিয়ার নজর কেড়েছিল। এবার সেই তালিকায় নাম লেখালো পেরু।
দুর্নীতি, কর্মহীনতা, দারিদ্র্য পেরুর জনগণের নিত্য সঙ্গী। সাম্প্রতিক কোভিড অতিমারিতে তা অনেক গুন বেড়ে গিয়েছে। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন। মৃত্যু হার এ দেশে সর্বাধিক। এ সবের মধ্যেই দুর্নীতির অভিযোগের মুখে পড়ে গত ১০ নভেম্বর পদত্যাগ করেন প্রেসিডেন্ট মার্টিন ভিজকারা। নতুন প্রেসিডেন্ট হন ম্যানুয়েল মেরিনো। এরপর বিশাল বিক্ষোভ শুরু হয় দেশ জুড়ে। ১২ নভেম্বর দেশজুড়ে কয়েক লক্ষ মানুষ পথে নামে। তাদের ওপর ব্যাপক দমন চালায় রাষ্ট্রীয় বাহিনী। আহত হন বহু। এই বিক্ষোভে শ্রমিকদের সঙ্গে অংশ নিয়েছিল ছাত্রযুব, কৃষক, মধ্যবিত্তরাও। পরিস্থিতি দেখে নতুন মেরিনো সরকারের একের পর এক মন্ত্রী পদত্যাগ করতে শুরু করেন। ১৪ নভেম্বর আরও বড়ো একটি মিছিল কাঁপিয়ে দেয় গোটা দেশকে। সেদিনও বহু মানুষ আহত হন এবং মারা যান দুই যুবক। সরকারের সঙ্গে বৈঠক বাতিল করে সেনাবাহিনী। বোঝাই যাচ্ছিল, পেরুর শাসক শ্রেণি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে ১৫ নভেম্বর বিকেলে পদত্যাগ করেন মেরিনো। তারপর দুদিন পেরুতে কোনো সরকার ছিল না। ১৭ নভেম্বর সংসদ নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচন করে ফ্রান্সিসকো সাগাস্তি-কে। জনগণের দাবি ছিল, ভিজকারাকে তাড়ানোর ভোটাভুটিতে যিনি ভিজকারার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন, এমন কাউকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা যাবে না। সেটা মেনে নেওয়া হয়েছে। এই নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লক্ষ্য, প্রাথমিক ভাবে ব্যবস্থাটাকে রক্ষা করা। তাছাড়া সাগাস্তির দলটি নতুন, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তেমন নেই। ফলে এতে আপাতত পথের জনতাকে শান্ত করা যাবে বলে মনে করছে পেরুর শাসক শ্রেণি। এই নতুন সরকারকে বলা হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যাদের অধীনে ২০২১ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
লাতিন আমেরিকার বহু দেশেই বুর্জোয়া শাসকরা স্থিতাবস্থা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েই চলেছে। প্রতিটি দেশেই রাজনীতিবিদরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নানা দুনম্বরি চুক্তি করে জনগণের কোটি কোটি টাকা পকেটে পুড়েছে। তাদের জন্য একের পর এক আইন পালটেছে।
একটি হিসেব অনুযায়ী, দুর্নীতির জন্য লাতিন আমেরিকার দেশগুলির প্রতিবছর ১৪০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। যা ওই অঞ্চলের জিডিপির ৩ শতাংশ। চাতীয় ও আন্তর্জাতিক বুর্জোয়ারা সেখানে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সরকারি নিয়মগুলিও মেনে চলেন না। দুর্নীতি, টাকা তছরুপ, কর ফাঁকি সেখানে রোজকার ব্যাপার।
পেরু অবশ্য এই গড়টাও ছাপিয়ে গিয়েছে। সেই দেশের শেষ ৬জন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তাদের কেউ কেউ জেলে গেছে, কারও বিরুদ্ধে মামলা চলছে। দুর্নীতি, খুন ও টাকা চুরির অপরাধে ২৫ বছর জেল খাটছেন আলবার্তো ফুজিমোরি। আলেজান্দ্রো তোলেডোকে আমেরিকায় গ্রেফতার করা হয় এবং বিচারের জন্য পেরুতে ফেরত পাঠানো হয়। ঘুষের অভিযোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে অ্যালান গার্সিয়া ২০১৯ সালে আত্মহত্যা করেন। লাভা জাতো দুর্নীতির মামলায় ব্রাজিলে নির্বাসনে রয়েছেন ওলান্তা হুমালা। পেদ্রো পাবলো কুজিনকি-কে ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরানো হয়, টাকাচুরির মামলায় তাকে আপাতত গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। সাম্প্রতিকতম বরখাস্ত প্রেসিডেন্ট হলেন মার্টিন ভিজকারা, তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়া ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
একটি রিপোর্ট প্রকাশ পেরুর ৫০ শতাংশ সাংসদের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তারা নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্যই একের পর এক প্রেসিডেন্টকে বরখাস্ত করে সব দোষ তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়। ভিজকারার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সত্যি হলেও, তার অপসারণ আসলে শাসক শ্রেণির মধ্যেকার দ্বন্দ্বের ফল। যার জেরে পেরুর জনগণের জীবন গভীর সংকটে রয়েছে। প্রথম দিকে প্রেসিডেন্টদের অপসারণ পেরুর মানুষকে খুশি করলেও, তারা এখন শাসক শ্রেণির চালাকি অনেকটাই ধরে ফেলেছে। সবটাই যে তাদের চোখে ধুলো দেওয়ার কৌশল সেটা তাঁরা বুঝছেন। সত্যি বলতে, বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী লবিগুলির লড়াইয়ের ফলাফলই ছাপ ফেলছে পেরুর শাসক শ্রেণির কুকুরের কামড়াকামড়িতে।
সাম্প্রতিক গণ আন্দোলনে ফুজিমোরির আমলে তৈরি সংবিধান বদলের দাবি উঠেছে। দাবি উঠেছে নতুন সংবিধান পরিষদ তৈরির। যা কিনা ‘নতুন সামাজিক চু্ক্তি’র ভিত্তিতে তৈরি হবে। বোঝাই যায়, পচাগলা ব্যবস্থাটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য বুর্জোয়ারা জনগণের মধ্যে থেকে এই দাবি তুলছে। একাংশ বলছে, আগামী বছরের নির্বাচনের পাশাপাশি নতুন সংবিধান পরিষদ তৈরির জন্যও ভোটগ্রহণ করা হোক।
বলাই বাহুল্য নতুন বুর্জোয়া সংবিধান মেহনতি মানুষের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। কারণ মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে কোনো ‘নতুন সামাজিক চুক্তি’ হওয়া অসম্ভব। তবু পেরুর জনগণের এই লড়াইকে স্যালুট জানাতে হবে। নেতৃত্ব যে দাবিই তুলুক, এই বিদ্রোহ একদন নীচ থেকে গড়ে উঠেছে। প্রথম লড়াইতে তারা জয়ী হয়েছেন। আন্দোলনে স্বতস্ফূর্ততার সুযোগ নিয়ে বুর্জোয়ারা নতুন সংবিধান বানিয়ে জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার নীল নকশা বানালেও, পেরুর শাসক শ্রেণির হাঁটু কেঁপে গিয়েছে। তারা এখন আতঙ্কগ্রস্ত।