Home রাজনীতি স্বাধীনতা দিবস কম পড়িয়াছে!

স্বাধীনতা দিবস কম পড়িয়াছে!

স্বাধীনতা দিবস কম পড়িয়াছে!
1
সুমনকল্যাণ মৌলিক

অযোধ্যায় রাম মন্দির শিলান্যাসের দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতবর্ষের ইতিহাসে ৫ আগস্ট দিনটিকে স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ‘ হিন্দু হৃদয় সম্রাট ‘ সব কথা সোজাসুজি বলবেন এমন দায় তার নেই কিন্তু ভক্তজনেরা যা বোঝার তা ইতিমধ্যে বুঝে গেছেন।তবে ছিদ্রান্বেষীদের মধ্যে প্রশ্নটা উঠতে শুরু করেছে যে ১৫ আগস্টের মত একটা জলজ্যান্ত স্বাধীনতা দিবস এবং ২৬ জানুয়ারির মত প্রজাতন্ত্র দিবস (ধারে ও ভারে সেটাও কম নয়) থাকা সত্বেও মোদিজির আরেকটা নতুন স্বাধীনতা দিবসের দরকার পড়ল কেন! এ ব্যাপারে বাম ও লিবারেল ডেমোক্র্যাট মহলে একটা সোজাসাপটা উত্তর আছে। বহু চর্চিত উত্তরটি হল ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও তার শাখা প্রশাখার অনুপস্থিতি এবং প্রকাশ্যে ব্রিটিশদের পক্ষাবলম্বন।

সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও জনপ্রিয় কলমচি জহর সরকার জাতীয় সংগ্রামে সংঘ পরিবারের তীব্র বিরোধিতার কথা ( আবাপ,১৫ আগস্ট, ২০২০) আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। জহরবাবু প্রতি আগস্ট মাসে বর্তমান বিজেপি নেতৃবৃন্দের বিপাকে পড়ার কথা উল্লেখ করেছেন। তবে বিষয়টা শুধু আগস্ট মাস কেন্দ্রিক নয়। কারণ পাঠ্য পুস্তক কেন্দ্রিক ইতিহাস চর্চাই হোক বা সামাজিক পরিসরে ব্যক্তি ও সমষ্টির স্মৃতিতে স্বাধীনতা আন্দোলনের যে ছবি রয়েছে তাতে কংগ্রেস প্রধান ভূমিকায় থাকলেও আরে বহু ধারার উজ্জ্বল উপস্থিতি রয়েছে। দীর্ঘ দিন সরকারি ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কংগ্রেস যতই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একমাত্রিক আখ্যান তৈরির চেষ্টা করুক না, সেই মুক্তি আন্দোলনের চালচিত্রে রয়েছে সশস্ত্র বিপ্লবীদের আত্মবলিদান, রয়েছে কমিউনিস্ট তথা বামপন্থীদের কথা।’ ভারত ছাড়ো ‘ আন্দোলনের সময় বিভ্রান্তিমূলক অবস্থান নিলেও শ্রমিক – কৃষকদের সংগ্রামে, নৌবিদ্রোহে, শেষ পর্বে তেভাগা – তেলেঙ্গানার মাটিতে কমিউনিস্টদের লড়াকু অবস্থান যাবতীয় সীমাবদ্ধতা সত্বেও শেষ বিচারে গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার ধারা প্রবল হওয়ার সাথে সাথে তথাকথিত ছোটোলোকরাও ইতিহাসে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন। কিন্তু হলফ করে বলা যায় যে এই বিস্তৃত চালচিত্রের কোথাও সংঘীদের উপস্থিতি নেই।

আবার আইকন কেন্দ্রিক ইতিহাস চর্চায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান দুই বাজি বি আর সাভারকর ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী  হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টাও যথেষ্ট গোলমেলে। সাভারকার সশস্ত্র বিপ্লবী হিসেবে জীবন শুরু করলেও দ্বীপান্তর পর্বে ব্রিটিশ দের মুচলেকাদান এবং পরে সোজাসুজি ব্রিটিশদের পক্ষাবলম্বন তার দেশভক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়। অন্যদিকে বঙ্গতনয় শ্যামাপ্রসাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন ইউনিয়ন জ্যাককে অসম্মান করার জন্য ছাত্র পিটিয়েছিলেন।ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় প্রকাশ্যে ব্রিটিশদের হয়ে ওকালতি করেছেন। ইতিহাস শ্যামাপ্রসাদকে ভারতের সংসদীয় রাজনীতির ঊষালগ্নে ক্ষমতার কুশলী খেলোয়াড় হিসাবে মনে রাখবে,কাশ্মীরের ‘ ভারতভুক্তি’র সময়  তার অবস্থানও আলোচনায় থাকবে কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে নৈব নৈব চ।

বাকি থাকে অন্য ধারার ‘ আইকন ‘ আত্মসাৎ করার গল্প, কিন্তু সেক্ষেত্রেও সংঘ পরিবারের সমস্যা কম নয়। জনস্মৃতিতে হোক বা সামাজিক সংলাপে স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের আধিপত্যবাদের আখ্যানের ( আরো নির্দিষ্ট করে বললে গান্ধী- নেহেরু পরিবার)  বিপরীতে সবচেয়ে দুই জনপ্রিয় আইকন অতি অবশ্যই সুভাসচন্দ্র বসু ও ভগৎ সিং।

কিন্তু এরা দুজনেই ব্রাহ্মণ্যবাদ জারিত হিন্দুত্বকে বিরোধ করেছেন। ১৯৪০ সালের ১২ মে সুভাষচন্দ্র এক বক্তৃতায় বলছেন — ” সন্ন্যাসী সন্ন্যাসিনীদের ত্রিশূল হাতে হিন্দু মহাসভা ভোট ভিক্ষায় পাঠিয়েছে…… ধর্মের সুযোগ নিয়ে ধর্মকে কলুষিত করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে…… এই বিশ্বাসঘাতকদের আপনারা রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে সরিয়ে দিন “। আর ভগৎ সিং-এর সমাজতান্ত্রিক ধারণায় বিশ্বাস তাকে করে তুলেছে সংঘ পরিবারের স্বাভাবিক শত্রু। গুজরাটি অস্মিতাকে ব্যবহার করে সর্দার প্যাটেলকে আত্মসাৎ করার একটা চেষ্টা হয়েছে বটে কিন্তু এই সত্যকেও ভুলিয়ে দেওয়া মুশকিল যে ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পরে সর্দার প্যাটেল আর এস এস-কে নিষিদ্ধ করেন। এই বিপন্নতা বোধ থেকে নতুন স্বাধীনতা দিবসের খোঁজ একটা যুক্তি হতে পারে কিন্তু একমাত্র নয়।

স্বাধীনতা আন্দোলনে সংঘ পরিবারের অনুপস্থিতির প্রশ্নটির থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সংঘের পক্ষ থেকে তাত্ত্বিক ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রত্যাখ্যান,যা শুধু জাতীয় পতাকাকে বয়কটের গল্পে সীমাবদ্ধ নয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও তার পূর্ববর্তী হিন্দু মহাসভা যে হিন্দুস্তানের স্বপ্ন দেখতেন তার সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসন মুক্ত বহু ধর্ম ও ভাষাভাষীর দেশ হিসেবে স্বাধীন ভারতের স্বপ্নের কোন মিল ছিল না। সংঘের কল্পিত হিন্দুস্তানকে গোলওয়ারকর স্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন– ” হিন্দুস্তানে থাকবে এবং অবশ্যই থাকবে প্রাচীন হিন্দু জাতি এবং হিন্দু জাতি ছাড়া আর কেউ নয়। আর যারা এই জাতীয়, অর্থাৎ হিন্দু জাতি (রেস), ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষার মধ্যে পড়েন না, তারা স্বাভাবিক ভাবে ‘ প্রকৃত ‘ জাতীয় জীবনের গন্ডির বাইরে থাকবেন “। তাই যবন সর্পকে নিকেশ করা হিন্দুত্ববাদের রাষ্ট্র গঠনের প্রধান শর্ত। এক্ষেত্রে তাদের আদর্শ পুরুষ হিটলার ও মুসোলিনি। ফলে সংঘ প্রকল্পিত হিন্দু জাতীয়তা তথা হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ছিল বিঘ্ন স্বরূপ। গোলওয়ারকরের কথায় — ” আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ এবং সাধারণ বিপদের তত্ত্ব গুলি, যা আমাদের নেশনের ধারণার ভিত্তি গঠন করেছে তা আমাদের প্রকৃত হিন্দু জাতীয়তার ইতিবাচক ও অনুপ্রেরণাকারী অন্তর্বস্তু থেকে বঞ্চিত করেছে এবং আমাদের বহু স্বাধীনতা সংগ্রামকে প্রকৃত পক্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পরিণত করেছে। ব্রিটিশ বিরোধিতাকে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সঙ্গে একাসনে দেখা হয়েছে। এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গী স্বাধীনতা আন্দোলনের সমস্ত পর্যায়ে তার নেতাদের উপর ও সাধারণ মানুষের উপর এক বিপর্যয়কারী প্রভাব ফেলেছে ” ( ইন্ডিয়ান ফ্রিডম মুভমেন্ট অ্যান্ড আর এস এস,শামসুল ইসলাম, ২০১৮)। স্বাভাবিক ভাবেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ভারত ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করার কোনো তাগিদ সংঘ অনুভব করেনি বরং বাস্তবে ব্রিটিশদের তল্পিবাহকের ভূমিকা পালন করেছে (সাভারকারের মুচলেকা পত্র বা বাংলার গভর্নর স্যার জন হার্বার্টকে লেখা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-এর লেখা চিঠি দ্রষ্টব্য)।

ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে অনুপস্থিতি বা প্রত্যাখ্যান শুধু নয়, একই সঙ্গে সংঘের প্রস্তাবিত হিন্দু রাষ্ট্রের এক তাত্ত্বিক কাঠামোও কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে তার প্রচারকরা  ফেরি করে আসছেন। সাভারকার দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলেছেন – “তাই স্বরাজ্যের অর্থ হল পৃথিবীতে ভারত নামে একটি অঞ্চলের শুধু মাত্র ভৌগোলিক স্বাধীনতা নয়।হিন্দুদের কাছে হিন্দুস্তানের স্বাধীনতা তখনই বিবেচিত হবে যদি তা তাদের হিন্দুত্ব — তাদের ধর্মীয়, জাতিগত (রেসিয়াল)ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে নিশ্চিত করে। আমরা এমন ‘স্বরাজ্য’র জন্য সংগ্রামে নেমে পড়ব না বা প্রাণ দেব না যার বিনিময়ে আমাদের ‘সত্তা’ হিন্দুত্ব অর্জিত না হয়”।(সাভারকর সমগ্র, খণ্ড ৬,পৃষ্টা-২৮৯)

হিন্দু রাষ্ট্র সম্পর্কিত ঘোষণায় সংঘের প্রথম বক্তব্য হল-‘জার্মানি জার্মানদের, ব্রিটেন ব্রিটিশদের সুতরাং হিন্দুস্তান অবশ্যই হিন্দুদের’। যদিও কোন বিচারে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ‘হিন্দু জাতি’ হিসেবে বিবেচিত হবেন সে সম্পর্কে কোন যুক্তি গ্রাহ্য বক্তব্য পাওয়া যায় না।আর সেই হিন্দুস্তান গড়ে ওঠার সহায় অবশ্যই মনুসংহিতা এবং প্রতিবন্ধকতা সংবিধান সভায় গৃহীত ভারতের সংবিধান। ১৯৪৯ সালের ৩০ নভেম্বর সংঘের ইংরেজি মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এ ‘ দি কনস্টিটিউশন’ নামক কলামে বলা হয় — “ভারতের নতুন সংবিধানের সবচেয়ে খারাপ বিষয়টি হল যে এর মধ্যে ভারতীয়ত্ব বলে কিছু নেই……. মনুস্মৃতিতে যে ভাবে তার আইন সমূহ বিধৃত হয়েছে, তাকে এখনো সমগ্র পৃথিবী শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং আপনা থেকেই সেগুলোর প্রতি আনুগত্য দেখায় ও মেনে নেয়।কিন্তু আমাদের সংবিধান প্রণেতা পন্ডিতদের কাছে তার কোনো মূল্য নেই”।আর ২০১৭ সালে এসে মোদি সরকারের এক রাষ্ট্রমন্ত্রী অনন্তকুমার হেগড়ে স্পষ্ট ভাষায় বলে দেন – ‘খুব শিগগির আমরা সংবিধান পাল্টে দেব’।(ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৬.১২.১৭)

১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি যে ভারতীয় প্রজাতন্ত্র যাত্রা শুরু করেছিল, তার সূত্রগুলির বিপরীত ভাবনাই সংঘের মতাদর্শ। গোলওয়ারকর তার ‘বানচ অব থটস’ গ্রন্থের ‘ওয়ান্টেড এ ইউনিটারি স্টেট ‘ নামক পরিচ্ছেদে লিখেছেন,”সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর পদক্ষেপ হল আমাদের দেশের সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সম্পর্কে যা ভালো ভালো কথা বলা হয়েছে তাকে গভীরে কবর দেওয়া। এর ফলে ভারত নামক এক রাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান সমস্ত স্বয়ংশাসিত বা আধা স্বয়ংশাসিত রাজ্যগুলির অস্তিত্বকে বিলুপ্ত করা যাবে এবং ‘এক দেশ – এক রাষ্ট্র – এক আইনসভা – এক কার্যনির্বাহী ‘ ঘোষণা করা যাবে, যার মধ্যে কোনো খণ্ডতা, আঞ্চলিকতা, গোষ্ঠীবদ্ধতা, ভাষাগত অথবা অন্যান্য সমস্ত গৌরবের অস্তিত্ব থাকবে না যেগুলো আমাদের অখণ্ড ঐক্যের সর্বনাশের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে”। এখানে গোলওয়ারকর বিস্তারিত ভাবে এক কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত করে নানা জাতিসত্তা, ভাষাগত পরিচিতি, গোষ্ঠীগত স্বাতন্ত্র্য, ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যকে মুছে ফেলে একটি চরম অগণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছেন। এই রাষ্ট্র দর্শনের মধ্যে ফ্যাসিবাদি মতবাদ অবশ্যই এক অনুঘটকের কাজ করে। ১৯২৮ সালের ১৭ জানুয়ারি ‘কেশরী’ পত্রিকা বিশেষ ভাবে জোর ফেলেছিল মুসোলিনির রাজনৈতিক সংস্কারের উপর যেখানে সংসদে নির্বাচনের পরিবর্তে মনোনয়ন প্রথা চালু, পার্লামেন্টকে উচ্ছেদ করে ফ্যাসিবাদী গ্রেট কাউন্সিল চালু, সামাজিক সংগ্রামের নিষেধাজ্ঞার কথায়। ইতালির সনাজকে ফ্যাসিবাদী আদর্শ অনুযায়ী ঢেলে সাজানোর প্রশংসা করা হয়েছিল। সংঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বি এস মুঞ্জে ইতালি দেখে এসে তার দিনপঞ্জিতে লেখেন, “ফ্যাসিবাদের মতাদর্শ জনগণের মধ্যে একতার ধারণাকে তীব্র ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে….. ভারত ও বিশেষ করে  হিন্দু ভারতের দরকার, হিন্দুদের সামরিক ভাবে সংগঠিত করার জন্য এমন প্রতিষ্ঠান”।

সংঘ প্রকল্পিত রাষ্ট্রের সম্ভাব্য শত্রুদের তালিকাও কিন্তু প্রথম থেকেই নির্দিষ্ট। প্রধান তিন শত্রু যথা মুসলমান, ক্রিস্টান ও কম্যুনিস্টদের প্রতি খুবই বিশেষ ধরনের ব্যবহার নির্ধারিত করা আছে। প্রকৃতপক্ষে সংঘের শত্রুবৃন্দের মধ্যে শুধু এরাই নেই, আছে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা ও পরিবেশ রক্ষা কর্মী, ধর্মনিরপেক্ষ, কর্পোরেট শোষণ বিরোধী, শূদ্র – অতিশূদ্র ও আদিবাসী জনগণের উপর অপমান ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী, নারী স্বাধীনতার দাবিতে সরব কন্ঠ, জীবন – জীবিকা রক্ষার আন্দোলনকারী, প্রতিবাদে সরব শ্রমিক-কৃষক, মেরুদন্ডসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী ও আরো অনেকে। সংঘের চোখে হয় তারা ‘বিশ্বাসঘাতক’ অথবা ‘ জাতীয়তাবিরোধী’ কিংবা ‘দেশদ্রোহী’।

এতক্ষণের আলোচনা শেষে আমরা দুটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি। প্রথমত ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে সংঘ পরিবার অংশ গ্রহণ করেনি, বিরোধিতা করেছে এবং যে ভাবনাগুলোর উপর  ভারতের সংবিধান গড়ে উঠেছে তাকে সজোরে প্রত্যাখান করেছে। দ্বিতীয়ত একই সঙ্গে সংঘ তার কল্পিত ভারতবর্ষের তাত্ত্বিক অবস্থান তৈরি করেছে এবং তা অর্জন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

এখন আমরা দেখে নেব যে প্রায় ১০০ বছরে (আর এস এস ১৯২৫ সালে তৈরি হয়) সংঘ তার স্বপ্ন পূরণে কীভাবে ও কতদূর এগোল। যে কথাটি দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করতে হবে যে এই দীর্ঘ যাত্রা পথে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ তার ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ প্রকল্প ও সংসদীয় রাজনীতিতে শক্তি বৃদ্ধির কর্মসূচির সঠিক মেলবন্ধন ঘটাতে পেরেছে। গান্ধী হত্যায় সংঘ পরিবারের ষড়যন্ত্রমূলক ভূমিকার কথা প্রকাশিত হওয়ার পর সংগঠন সাময়িক ভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়লেও দ্রুত সে অবস্থা সামলে নিতে পেরেছে। তীব্র মুসলিম ও কম্যুনিস্ট বিদ্বেষ ও ব্রাহ্মণ্যবাদ জারিত এক মতাদর্শ সে নানা ধরনের গণ সংগঠন, পত্র- পত্রিকা, সাংস্কৃতিক জলসা, মন্দির ট্রাস্ট, শিক্ষায়তনের মাধ্যমে প্রথমে গোবলয়ে,পরে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে।

এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার তার এই সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রকল্প শুধুমাত্র সংঘ পরিবারের সাংগঠনিক কাঠামো ও ক্যাডারকূলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্মলগ্ন থেকে হিন্দুত্ব ভাবনার অনুসারীরা কংগ্রেস ও সশস্ত্র বিপ্লবী গোষ্ঠী – দুই শিবিরেই বিরাজ করতেন। লোকমান্য তিলক, অরবিন্দ ঘোষ,মদনমোহন মালব্য,লালা লাজপত রায় সহ বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর মতাদর্শ হিন্দুত্বের অনুসারী ছিল। স্বাধীনতার পরে কংগ্রেস সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে নরম হিন্দুত্বের অনুশীলন আসলে সংঘের ভাবনাকেই পুষ্ট করেছে। তার সঙ্গে রয়েছে সংঘের পেশাদার কর্মীবাহিনী, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যাদের সংখ্যা বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছে।

একই সঙ্গে সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে ব্যবহার করে (এটা ইতালি ও জার্মানিতেও আমরা দেখেছি)  প্রশাসনিক ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করতে সে সফল। প্রথমে জনসংঘ ও পরে বিজেপির মাধ্যমে সে শুধু তার একঘরে অবস্থানই কাটিয়ে ওঠেনি,একই সঙ্গে গোবলয় কেন্দ্রিক পার্টির তকমা মুছে ফেলে পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে তার উপস্থিতি জানান দিতে সমর্থ হয়েছে। প্রকৃত অর্থে ভারতে সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে কংগ্রেসের বিপরীতে একটি সর্বভারতীয় শক্তি হিসাবে বিজেপি শুধু নিজেকে প্রতিষ্ঠিতই করেনি, একই সঙ্গে আজকের দিনে তাকে ছাপিয়ে যেতেও সমর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে দুটো ব্যাপার সংঘের পক্ষে গেছে। প্রথমত আর্থিক নীতির প্রশ্নে সংঘের ভাবনা শুধু সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থের অনুকূলই নয়, একই সঙ্গে নব্বই-এর দশকে গৃহীত সংস্কার কর্মসূচি রূপায়নে তার দায়বদ্ধতা কংগ্রেসের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে কর্পোরেট লবির অকৃপণ সহযোগিতা ও সমর্থন তার উপর বর্ষিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত সংঘ খুব দক্ষতার সাথে ভারতীয় সংবিধানের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ও ভঙ্গুরতাকে কাজে লাগিয়ে (ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, ৩৭০ ধারা, রাষ্ট্র ভাষা সম্পর্কে সংবিধানের মাঝামাঝি অবস্থান) তাকে অকার্যকর প্রতিপন্ন করতে পেরেছে।

সংঘের ক্ষমতা বৃদ্ধির সালতামামি রচনা করা এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়,তাই মাত্র তিনটি ঘটনার উল্লেখ করব যা সংঘ কল্পিত হিন্দুস্তান গঠনের ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করছে। প্রথমটি রাম জন্মভূমি আন্দোলন। লালকৃষ্ণ আদবানির রথযাত্রা শুধু বিজেপির সাংসদ সংখ্যা ২০ গুন করেনি, তা একই সঙ্গে সংঘের সাংস্কৃতিক নবজাগরণ প্রকল্পের প্রায়োগিক সাফল্য। পুরুষোত্তম রামকে কেন্দ্র করে জঙ্গি হিন্দুত্বের প্রকাশ এখান থেকেই শুরু হয়। দ্বিতীয়টি হল বিজেপির গুজরাট মডেল যা সংঘের কাছে ছিল হিন্দুত্বের ল্যাবরেটরি। প্রশাসনিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কীভাবে দখল করা যায় তার অনুশীলন গুজরাটেই শুরু হয়। আজ বিচার ব্যবস্থা সহ সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ার পরিণতি দেখে যারা কপাল চাপড়াচ্ছেন তাদের জানা উচিত এ সমস্ত কিছুই ক্ষুদ্র মাত্রায় গুজরাটে ঘটেছে। তৃতীয়ত ২০১৪ সালে মোদির নেতৃত্বে দিল্লির মসনদে অধিষ্ঠান। সে সময় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা অশোক সিংঘল বলেছিলেন, “এর ফলে ৮০০ বছরের দাসত্বের অবসান ঘটল…. এটা কোন পরিমিত বিপ্লব নয়। এটি শুধু ভারতে আবদ্ধ থাকবে না বরং বিশ্বের কাছে এক নতুন মতাদর্শে হাজির করবে….. ২০২০ সালের মধ্যে সমগ্র দেশ হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হবে”।(টাইমস অব ইন্ডিয়া, ১৮.৭.১৫)।

সম্প্রতি জনতা পার্লামেন্ট নামক এক সভায় অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জে পি শাহ মন্তব্য করেছেন ভারত এক নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। এটাই তো সংঘ কল্পিত হিন্দুরাষ্ট্রের আসল চেহারা। ৩৭০ ধারা বিলোপ, নাগরিকত্ব সংস্কার,রামমন্দিরের সূচনা,অভিন্ন দেওয়ানি আইনের প্রস্তাবনা আর রাষ্ট্র তথা জনগণের সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে বেচে দেওয়া আসলে হিন্দু রাষ্ট্রের জয়ধ্বনি। এই বিজয় উদযাপনে সংঘ পরিবারের নতুন স্বাধীনতা দিবসের দরকার। ৫ আগস্ট তারই বার্তাবাহক।

কৃতজ্ঞতা:  সংঘ পরিবার ও হিন্দুত্ববাদ, আপডেট স্টাডি গ্রুপ ( সেতু প্রকাশনী)

 

Share Now:

Comment(1)

  1. ভালো লেখা। অনেক মানুষের কাছে যাক।

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *