Home খবর ইরান জুড়ে ঐতিহাসিক শ্রমিক ধর্মঘটের ঢেউ

ইরান জুড়ে ঐতিহাসিক শ্রমিক ধর্মঘটের ঢেউ

ইরান জুড়ে ঐতিহাসিক শ্রমিক ধর্মঘটের ঢেউ
1

পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: ১ আগস্ট থেকে একের পর এক শ্রমিক ধর্মঘটে টালমাটাল ইরান। ব্যাপক আর্থিক সংকটের জেরে ধর্মঘটের পথে হেঁটেছেন সে দেশের প্রায় ১৬টি শিল্পকেন্দ্রের শ্রমিকরা। তাদের দাবির মধ্যে বকেয়া বেতন যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে সরকারের ইউনিয়ন-বিরোধী আইনের বিরোধিতা। এছাড়া খরা কবলিত দেশের ব্যাপক গরমে কর্মস্থলের পরিবেশ যাতে কাজের উপযোগী হয়, সে কথাও উঠে এসেছে শ্রমিকদের দাবিতে। দক্ষিণ ইরানের পেট্রোকেমিক্যাল ও তৈল শোধনাগারগুলিতে একের পর এক ধর্মঘট দিয়ে শুরু হলেও পরে তা ছড়িয়ে পড়েছে ধাতু ও খনি শিল্পেও।

ইরানিয়ান বিপ্লবের পরবর্তী ৪০ বছরে এত বড়ো মাপের সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন দেখেনি ইরান। ইরানিয়ান বিপ্লবের সময় শেষ এত বড়ো মাপের শ্রমিক আন্দোলন হয়েছিল, সে দেশে। যার হাত ধরে বর্তমান ধর্মীয় শাসকরা ক্ষমতা দখল করে। ১ আগস্ট কুজেস্তানের দেশের সবচেয়ে বড়ো গ্যাস উৎপাদন সংস্থায় ধর্মঘট শুরু হয়, যা দ্রুত মধ্যে ইরানের শোধনাগারগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। সবচেয়ে বড়ো কথা, ৪ আগস্ট ইসফাহানে কয়েকজন শ্রমিক ধর্মঘট শুরু করেন, যাতে চোখের নিমেষে যোগ দেন তেল শিল্পের ১০ হাজার শ্রমিক।

১৬টি তেল উৎপাদক সংস্থার শ্রমিকরা ধর্মঘটে যোগ দিয়েছেন। যেটা ইরানের শাসক শ্রেণির পক্ষে যথেষ্ট সমস্যার। কারণ এগুলিকে কাজে লাগিয়েই দেশের ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে তারা। সে দেশের অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য তেমন নেই। অন্যান্য শিল্প সেভাবে গড়ে ওঠেনি। প্রায় সবটাই তেল নির্ভর।

প্রতিবাদীদের মধ্যে রয়েছেন রাজমিস্ত্রি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, ঝালাই মিস্ত্রি এবং নানা ক্ষেত্রের প্রচুর চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক। দুনিয়ার এই সবচেয়ে বড়ো প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডারে শ্রমিকরা টানা ২০দিন কাজ করে ১৯দিন ছুটি পান। কাজের দিনগুলিতে তারা কাজের জায়গার কাছে আবাসনে থাকেন। ধর্মঘটের লক্ষ্য হল, টানা ২০ দিন কাজের বৃত্তে ছেদ করা, যে কৌশল দেশের তেল উৎপাদনে বড়োসড়ো প্রভাব ফেলেছে।

কোন ঘটনার জেরে হাজার হাজার শ্রমিক কাজে সামিল হলেন? মাশাহর পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্সের শ্রমিক ইব্রাহিম আরাবজাদেহ ১২২ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় কাজ করতে গিয়ে মারা যান। যা শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।

এই ধরনের অসহনীয় পরিবেশে ইরানের তেল শ্রমিকরা কাজ করতে বাধ্য হন। দেশে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নেই। ফলে শ্রমিক আন্দোলন হলেই নেতাদের শাস্তির মুখে পড়তে হয়। তাদের ওপর নেমে আসে তুমুল নিপীড়ন। আমেরিকার চাপানো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, ৪০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি, কোভিড অতিমারি- সব মিলিয়ে ইরানের শ্রমিক শ্রেণির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।

মার্কিন নীতির ফলে ইরানের তেল উৎপাদন প্রায় ৮০ শতাংশ কমে গেছে। ফলে ইরানের শ্রমিক শ্রেণি ও গরিব মানুষকে শান্ত রাখা শাসক শ্রেণির পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক ইউনিয়ন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব না থাকা সত্ত্বেও তারা প্রতিবাদের পথে সামিল হয়েছেন।

ইরানের শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা ভয়ঙ্কর। তেল শিল্পের শ্রমিকদের ৭০ শতাংশই ঠিকা ব্যবস্থায় কাজ করেন। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা মুক্তাঞ্চলে কোনো শ্রম আইন নেই, সেখানে বস-দের একনায়কত্ব চলে। শীততাপ নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় শ্রমিকদের প্রবল গরমে কাজ করতে হয়। শ্রমিকদের স্বাধীন ভাবে ইউনিয়ন করার কোনো অধিকার শ্রমিকদের নেই। যে আইনি ইউনিয়ন আছে, তা রাষ্ট্রেরই অঙ্গ। যে সব শ্রমিকরা কেবল বেতনের বদলে কাজের চুক্তিতে সই করতে বাধ্য হন, তাদের কোনো স্বাস্থ্যবিমা, অবসরকালীন সুবিধা থাকেনা। নিয়োগ কর্তাদের খুশিমতো যে কোনো সময় তাদের বরখাস্ত করা যায়। তাদের বেতন দারিদ্র্য সীমার নীচে। দেশে কর্মহীনতা বৃদ্ধির পরিস্থিতিতে বহু শ্রমিক মাসের পর মাস বিনা বেতনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে সে দেশের তরুণদের মধ্যে ২৭ শতাংশ বেকার। কোভিড ১৯ পরিস্থিতিতে ঘরভাড়া দিতে না পেরে প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিক এই মুহূর্তে ভিটেছাড়া।

হাফত তাপেহ আখ কারখানার শ্রমিকরা ৫৩ দিন ধরে ধর্মঘট চালাচ্ছেন। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে বকেয়া বেতন মেটানো, ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের পুনর্বহাল, দুনীর্তিগ্রস্ত কর্তাদের তাড়ানো, সংস্থার আত্মসাৎ করা অর্থ ফেরাতে বাধ্য করা। এমনকি বেসরকারিকরণের বিরোধিতাও করছেন শ্রমিকরা। যা ঐতিহাসিক।

তেল ও গ্যাস শিল্পের শ্রমিকদের চলমান ধর্মঘট গোটা ইরানে সাড়া ফেলে দিয়েছে। অন্যান্য শিল্পের শ্রমিক ইউনিয়ন, ছাত্র, শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত কর্মী, নারী সংগঠনগুলি এই ধর্মঘটের সমর্থনে সামিল হয়েছেন। প্রায় ১২টি সংগঠন যৌথ ভাবে বিবৃতিও দিয়েছেন। শ্রমিকদের ওপর রাষ্ট্রীয় আক্রমণে্র বিরোধিতা করেছেন। অন্যান্য শিল্পের হাজার হাজার শ্রমিকও এই ধর্মঘটে সামিল হওয়ার ফলে, এই মুহূর্তে প্রায় ২২টি শিল্পক্ষেত্রে ধর্মঘট চলছে।

ইরানের তেল সংস্থাগুলি সে দেশের আর্থিক ও সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই ইসলামিক রাষ্ট্রটি তেল ও গ্যাস উৎপাদনের ওপর ব্যাপক ভাবে নির্ভরশীল, সে জন্য আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা দুনিয়ার অন্যতম সবচেয়ে বড়ো হাইড্রোকার্বন ভাণ্ডারের দেশটিতে এত বড়ো মাপের প্রভাব ফেলেছে। পরমাণু চুক্তি থেকে ট্রাম্প সরে দাঁড়ানোর পরই দুই দেশের সম্পর্কে তিক্ততা বাড়তে থাকে। জানুয়ারিতে কাশেম সোলেইমানিকে আমেরিকা হত্যা করার পর উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক ভাবেই ইরান ক্রমেই অন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চিনের হাতে পড়ে গেছে। চিন ও আমেরিকার সম্পর্কে বাড়তে থাকা ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে এই ঘটনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

যে সব ক্ষেত্রের শ্রমিকরা বর্তমান ধর্মঘটে অংশ নিয়েছে, তাদের মধ্যে তেহরানের বাস ড্রাইভার, কুজেস্তানের তেল শ্রমিক এবং হাফত তাপেহের আখ শিল্পের শ্রমিকদের সংগ্রামের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। চলতি ধর্মঘট নিয়ে ইরান সরকার এখনও কোনো বিবৃতি দেয়নি কিন্তু এই ধরনের পরিস্থিতিতে তারা বরাবরই তীব্র নিপীড়ন নামিয়ে আনে। শ্রমিকদের অত্যাচার করা হয়, অপহরণ করা হয় এমনকি খুনও করা হয়। সঙ্গে পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য কিছু আর্থিক সুযোগসুবিধাও দেওয়া হয়। এখন অবশ্য আর্থিক সুযোগসুবিধা দেওয়ার অবস্থা প্রায় নেই। তাই বর্তমান ধর্মঘট হয়তো শিল্পক্ষেত্রে কিছু সংস্কারের দাবি আদায় করতে সফল হবে অথবা কোনো দাবিই মেনে নেওয়া হবে না।

ফলাফল যাই হোক, বর্তমান ধর্মঘটের ঢেউ আগামি দিনে ইরানের শ্রমিক আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করবে। গত নভেম্বরে জ্বালানির খরচ বৃদ্ধি ও মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ইরানের বড়ো শহরগুলিতে প্রায় লক্ষ মানুষ মিছিল-প্রতিবাদে সামিল হন। প্রায় ৭০০০ লোককে গ্রেফতার করা হয়, কয়েকশোকে হত্য়া করা হয়। গত মে মাসে কোভিড সংক্রমিত এলাকাগুলিতে জলের সংকটের প্রতিবাদে বহু মানুষ পথে নামেন। ২০১৭ সাল থেকে ইরানের শাসক বিরোধী আন্দোলনে শ্রমিক ধর্মঘট একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মার্কিন চাপের জেরে বর্তমানে ইরানের শাসক শ্রেণিতে আরও মেরুকরণ সম্পূর্ণ হয়েছে, সেখানে এখন অতি রক্ষণশীলরা প্রধান ভূমিকায় চলে এসেছে।

এটা ঠিক যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চাপিয়ে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার জেরে ইরানের শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা আগের চেয়ে আরও খারাপ হয়েছে। তাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন জরুরি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, দেশের জনগণকে ধর্মীয় শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট করে ইরানের শাসকরা চিন-রাশিয়া-আমেরিকার মতো বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাহায্যে তাদের নিজেদের মুনাফা নিশ্চিত করেছে। দেশের স্বনির্ভর শিল্প-অর্থনীতি গড়ে তোলার কথা ভাবেনি। আমদানি-রফতানি নির্ভরতা থেকে বেরোতে চায়নি। দুর্বল অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে মার্কিন বিরোধী অবস্থান তীব্র করার আর্থিক দায় তারা দেশের জনগণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারও দিচ্ছে না। তাই প্রকৃত গণতন্ত্র অর্জনের লড়াইটাই এখন ইরানের শ্রমিক শ্রেণির প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। সেই লড়াইয়ের জন্য তারা ক্রমেই প্রস্তুতি বাড়াচ্ছেন। এক আখ শ্রমিকের কথায়, “ক্ষুধার্থ শ্রমিককে চাবুক মারলেও সে পথে ফিরে আসবেই”।

Share Now:

Comment(1)

  1. Bumpanthai ses katha. R eai sab desh r sasak ra sab samoy lal juju dakhe. Khete khawa manush der lal pataka k dhorte hobe.

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *