লকডাউন তুলুন, বয়স্ক ও অসুস্থদের সুরক্ষিত রাখুন, কোভিড কোনো বিপর্যয় নয়, একটি রোগ, সেভাবে মোকাবিলা করুন
ডাঃ জয় ভট্টাচার্য ও সঞ্জীব আগরওয়াল
(ডাঃ জয় ভট্টাচার্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানভোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের প্রফেসর। সঞ্জীব আগরওয়াল মুম্বইয়ের ‘গুড গভর্নেন্স ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা। এই প্রতিষ্ঠান বর্তমানে কোভিডের চিকিৎসা পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত)
দীর্ঘ লকডাউন। তারপর সেমি লকডাউন। মাঝেমধ্যে শাটডাউন। কোভিডের মোকাবিলায় শাসক শ্রেণির যাবতীয় কৌশল আমরা লক্ষ্য করছি। অন্য সব কিছুর মতোই এই কৌশলও বিদেশ থেকে টোকা। যদিও আমরা দেখছি, ওই দেশগুলোর তুলনায় ভারতে করোনায় মৃত্যুহার অনেক কম। তবু কি এই টোকা লকডাউন চালিয়ে যাওয়া ঠিক হচ্ছে? যেখানে এর অর্থনৈতিক প্রভাব হয়েছে ভয়ঙ্কর। কোটি কোটি মানুষের রুটিরুজি চলে গেছে। বহু শ্রমজীবী, শ্রম দিতে না পেরে সরকারের দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়েছেন। বহু ছোটো শিল্প কবে ঘুড়ে দাঁড়াবে, কেউ জানে না। এই লকডাউনের পেছনে রোগ প্রতিরোধের যুক্তির আড়ালে অন্য কিছু আছে কিনা, তা নিয়ে ক্রমেই সন্দেহ বাড়ছে। কারণ এই সময়েই একের পর এক জনবিরোধী, দেশবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে কেন্দ্র। অন্যদিকে যোনা যাচ্ছে, লকডাউন তুলে দিলে, স্বাভাবিক মেলামেশার মধ্য দিয়ে দ্রুত গোষ্ঠী প্রতিরোধ তৈরি হয়ে যাবে সমাজে। সেক্ষেত্রে ভ্যাকসিন বাজারে এলেও মানুষের তা কাজে লাগবে না। তাই নানা ভাবে লকডাউন চালিয়ে সমাজের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়তে দেওয়া হচ্ছে না। ওষুধ সংস্থাগুলির সঙ্গে বোঝাপড়ার জেরেই কি এই কৌশল নিচ্ছে সরকারগুলো? সব মিলিয়ে শাসক শ্রেণি এমন এক আতঙ্কের পরিবেশ সমাজে তৈরি করতে পেরেছে, যাতে যে কোনো যৌক্তিক আলোচনাকেই ‘রোগকে লঘু করে দেখা’ বলে তকমা দিয়ে দিচ্ছে মধ্যবিত্তের একটা বড়ো অংশ। বলাই বাহুল্য তারা সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সও যথেষ্ট। এই অবস্থায় আমরা মনে করছি, করোনা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা জরুরি। করোনার আড়ালে রাজনৈতিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধ থামিয়ে দেওয়ার ফ্যাসিবাদী চক্রান্ত চলছে কিনা, তা বোঝা জরুরি। সেই উদ্দেশ্যেই দ্যপ্রিন্ট ডট ইন পোর্টালের এই লেখাটি আমরা ভাবানুবাদ করলাম। ভিন্ন মত থাকলে আপনারা জানান। লেখা পাঠান, সেগুলোও আমরা প্রকাশ করব।
যথেষ্ট বড়ো সংখ্যক নমুনা নিয়ে ভারতে সেরোলজিক্যাল সমীক্ষা হয়েছে। তাতে চমৎকার তথ্যপ্রমাণও মিলেছে। তা কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে যুক্তিসংগত ভাবে কোভিড মোকাবিলার সুযোগ ভারত পেয়েছে। এই রোগ নিয়ে কোনো আতঙ্ক বা ত্রাস তৈরি হওয়ার কোনো কারণই নেই এদেশে।
জনসংখ্যার কত অংশের রক্তে কোভিডের অ্যান্টিবডি রয়েছে, তা সেরো সার্ভে থেকে জানা যায়। এর থেকে সংক্রমণ পরিস্থিতির প্রমাণ আগেভাগে পাওয়া যায়। আইসিএমআর যে সমীক্ষা করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে কয়েক কোটি ভাবরতবাসী ইতিমধ্যেই কোভিডে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে গেছেন। থাইরোকেয়ার ও অন্যান্য পরীক্ষাগারের করা সেরো সমীক্ষাতেও এই তথ্যের প্রমাণ মিলেছে।
এটা শুনে খারাপ খবর বলে মনে হলেও, এটি আসলে সুসংবাদ। এই বিশাল সংখ্যাক সংক্রমিত মানুষের সামান্য কিছু উপসর্গ দেখা দিয়েছিল এবং এরা কেউ মারা যাননি। এরা আর সংক্রমিত নন আর সংক্রমণ ছাড়াচ্ছেন না।
যেহেতু এই সমীক্ষার আগেও দেশে বহু মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন, তাই আইসিএমআর-এর তথ্য অনুযায়ী ভারতে কোভিডের মৃত্যুহার ০.১%-অর্থাত ১০০০ জন সংক্রমিত মানুষের মধ্যে মাত্র ১জন। সংখ্যাটা তার থেকে কমও হতে পারে। এখন বলা হচ্ছে ভারতে মৃত্যুহার ২.১৫ শতাংশ, সেটা ঠিক নয়। কারণ এর আগেই সেরো সমীক্ষায় পাওয়া গেছে যে বহু সংক্রমিত মানুষের পরীক্ষা হয়নি বা তারা গণনায় ধরা পড়েননি। কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রকৃত বিপদ বুঝতে গেলে সেই সংখ্যাগুলিও হিসেবে রাখা উচিত।
লকডাউন করা নিরর্থক
রোগের প্রকোপ বোঝার জন্য ‘সংক্রমিতের সংখ্যা বৃদ্ধি’ বা ‘দ্বিগুন হওয়ার সময়কাল’-এর থেকে সেরোলজিক্যাল নজরদারি অনেক ভালো ও বিশ্বাসযোগ্য পদ্ধতি। কারণ সংক্রমিতের সংখ্যাবৃদ্ধি নির্ভর কর জনসংখ্যার কত অংশের রক্তপরীক্ষা হচ্ছে, তার উপর।
একই ভাবে, ‘সুস্থতার হার’ বলাটাও অবৈজ্ঞানিক, কারণ এতে রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেখিয়ে লোকের মনে ভয় সঞ্চার করা হয়। এই দুরকম তথ্যেই বিশাল সংখ্যক পরীক্ষা না হওয়া সংক্রমিতের সংখ্যাটা উপেক্ষা করা হয়।
কোভিডের মতো একটা রোগ, যা ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু মৃত্যুহার মাত্র ০.১%(ভারতে), তার জন্য সংক্রমিতর সংখ্যা কমাতে লকডাউন করাটা একেবারেই অবৈজ্ঞানিক।
লকডাউন করে যে ভাইরাসকে রোখা অসম্ভব, তা ভারতের দীর্ঘ লকডাউনের পরও সংক্রমণের পরিমাণ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বড়ো জোর করে লকডাউন তোলার সময় যাতে রোগের প্রকোপ কম থাকে, লকডাউন সেটুকুই নিশ্চিত করতে পারে। এর দ্বারা কোনো ভাবেই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। বরং লকডাউনে জীবন ও জীবিকার মারাত্মক ক্ষতি হয়। এতে মানুষের চিকিৎসা পেতে দেরি হয়,আ তার কাজও হারান।
ব্যাপকবিস্তৃত মহামারি আসলে একটি সুখবর
এখন গোটা দুনিয়ার তথ্য এবং অভিজ্ঞতা আমাদের হাতের মুঠোয়, রোগের অগ্রগতি স্পষ্ট ভাবেই জানা রয়েছে। এটা পরিষ্কার যে, ভারতের বহু শহরের জনসংখ্যার ১০ শতাংশেরও বেশি মানুষ সংক্রমিত, গ্রামাঞ্চলে যদিও সংখ্যাটা কম।
ভালো খবর হল, অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতে কোভিড ১৯ সংক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম। শেষ অবধি ভারতের বার্ষিক মৃত্যু সংখ্যার(প্রায় ১ কোটি)খুব কম অংশেরই কারণ হবে কোভিড।
ইশমিক হার্ট ডিজিজে ভারতে রোজ ৪০০০ মানুষ মারা যান। নানা আকারে লকডাউন চালিয়ে গেলে কোভিডের থেকে অনেক বেশি মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে হার্টের অসুখে মারা যাবেন।
লকডাউনের ফলে কোভিড ১৯ ছাড়া অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় দেরি হয় বা একেবারেই হয় না। গোটা চিকিৎসা পরিষেবার পরিচালন ব্যবস্থাটাই গোলমাল হয়ে যায়। প্রতিদিন কোভিডের জেরে মৃত্যুর হিসেব রাখা এবং লকডাউনের ফলে অন্যান্য রোগে মৃত্যু বা নেতিবাচক পরিণতিকে গুরুত্ব না দেওয়াটা একেবারেই আত্মধ্বংসী নীতি। যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতে গোটা পরিস্থিতিটা বোঝার জন্য, শুধু কোভিড ১৯ নয়, অন্যান্য রোগে মৃত্যু ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ঘটনাবলীর তথ্যও প্রকাশ করা উচিত।
শুধুমাত্র কোভিড ১৯ সংক্রমিতর সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রকাশ করাটা আসলে এক ধরনের ভুল তথ্য বণ্টন। এর ফল এজনমানসে এমনি স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। নভিভুক্ত সংক্রমণের তথ্যটা আসলে অতিমারি সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়। আসল সংক্রমণের সংখ্যাটা এ৭এত্রে অনেক কম চোখে পড়ে। রক্তপরীক্ষা না হওয়া কেসগুলো যোগ করলে আসল সংখ্যা য়েটা দাঁড়াবে, তা নথিভুক্ত কেসের প্রায় ১০ গুন।
মনে রাখবেন, ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়া মাহামারি আসলে সুসংবাদ। কারণ এর অর্থ হল অত্যন্ত কম মৃত্যুহার। এর চেয়ে ভালো, নিজে নিজে সেরে ওঠা অসংখ্য মানুষের সম্ভাব্য সংখ্যাটা মেনে নেওয়া এবং প্রচার করা। এতে কোভিডের মারণ ক্ষমতাটা মানুষ জানতে পারবে এবং অতিমারির শুরুর দিন থেকে যে অতিরিক্ত ভয় পাওয়া হয়ে গিয়েছে, সেটাও বুঝতে পারবে।
ভারতের যে পথে হাঁটা উচিত
উপরে উল্লিখিত তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী সুইডেনের মতো উদারপন্থী পথই ভারতের পক্ষে উপযুক্ত। এর অর্থ হল, জনগণকে সচেতন করা, প্রত্যেকে নিজের নিজের দায়িত্ব নেওয়া। এর ফলে শুরুতে ধীরে ধীরে সুস্থ ও কমবয়সি জনগণ স্বাভাবিক ভাবে সংক্রমিত হবেন এবং সেই সময়কালে গুরুতর অসুস্থদের জন্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা হবে।
যাদের বয়স ৬০-এর বেশি এবং যাদের অন্যান্য রোগ আছে, তাদেরকে সুরক্ষিত রাখতে হবে, তাদের রক্তপরীক্ষা করতে হবে এবং হয়তো নিভৃতবাসেও পাঠাতে হবে।
যেহেতু সংক্রমণ ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে গেছে, তাই উপসর্গহীন বা মৃদু উপসর্গযুক্তদের পরীক্ষা করা, চিহ্নিত করে পৃথক করাটা অসম্ভব। লকডাউন করে প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য অপেক্ষা করাও ঝুঁকিপূর্ণ কারণ এতে লকডাউনের ক্ষতিকর প্রভাব বাড়তে থাকবে। ব্যাপক ভাবে ‘চিহ্নিতকরণ, পরীক্ষা এবং পৃথকীকরণ’ প্রক্রিয়া রোগটিকে কলঙ্কে পরিণত করবে, যা এখনই যথেষ্ট মাত্রায় হয়ে গেছে। এতে প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ বাড়বে, চারদিকে ভাইরাল লোড বাড়িয়ে দেবে, যার শিকার হবেন স্বাস্থ্যকর্মী এবং উপসর্গহীন ও মৃদু উপসর্গযুক্ত মানুষজন। এর ফলে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে সংক্রমণের পরিমাণ বাড়াবে, তাতে মৃত্যুও বাড়বে।
বিপরীতে আর পাঁচটা সংক্রামক রোগের মোকাবিলার পদ্ধতির মতো বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা অর্থাত মতো প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টার্শিয়ারি চিকিৎসা পরিকাঠামো কাজে লাগালে অনেক ভালো ভাবে অতিমারির সঙ্গে লড়াই করা যাবে।
চিকিৎসার অসাম্য এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার দিক থেকে দেখলে ‘চিহ্নিতকরণ, পরীক্ষা এবং পৃথকীকরণ’ নীতি, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ও বটে। কারণ এতে উপসর্গহীন ও মৃদু উপসর্গ যুক্তদের ভাইরাল লোড জোর করে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে শুধু তাদের ভাইরাল লোডই যে বাড়ে তাই নয়, তা চারদিকেই বেড়ে যায়। এর ফলে মৃতের সংখ্যা বাড়ে। অন্যদিকে যাদের পরীক্ষা হয় না(ফলে নিভৃতবাসেও নেই), তাদের মধ্যে স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে এবং তারা সুস্থ থাকেন।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির সম্ভাবনার যে মডেলগুলি তৈরি হচ্ছে, তাতে সংক্রমণের ব্যপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ার সেরোলজিক্যাল প্রমাণগুলি যুক্ত করা দরকার। সঙ্গে নিচুমাত্রার মৃত্যুহারের তথ্যও তাতে দেওয়া দরকার। সেটা করার পর যেখানেই দেখা যাবে হাসপাতালে বেডের তুলনায় রোগীর সংখ্যা বেশি হয়ে আযওয়ার সম্ভাবনা নেই, সেখানেই সাহস ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লকডাউন তুলে দেওয়া উচিত। অসুস্থ ও বয়স্কদের অবশ্যই সুরক্ষিত রাখতে হবে।
মহামারি সামলানোর বিষয়টা জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয় হিসেবেই দেখা দরকার। বিপর্যয় বা আইনশৃঙ্খলার বিষয় হিসেবে নয়। পুলিশ বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়া দরকার, বিপর্যয় মোকাবিলা আইনটি তুলে নেওয়া দরকার, সাংবিধানিক স্বাধীনতা সম্পূর্ণ ভাবে ফিরিয়ে দেওয়া জরুরি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা এমন বহু রোগের সঙ্গে বসবাস করি, যেগুলি ব্যাপক ভাবে সংক্রমণ ছড়ায় কিন্তু মৃত্যুহার খুবই কম, কোভিডও সেগুলির থেকে আলাদা কিছু নয়, তা সকলকে স্পষ্ট বাবে জানানো দরকার।