পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: ১০ জুলাই মালির রাজধানী বামাকো দখল করে নেয় হাজার হাজার মানুষ। গত এক মাসে তিন বার এমন ঘটল। অন্যান্য দাবির পাশাপাশি প্রতিবাদী জনতার মূল দাবি ‘ফ্রান্সকে তাড়াও!’ অর্থাৎ ফ্রান্সের নেতৃত্বে মালিতে ঘাঁটি গেঁড়ে থাকা সাম্রাজ্যবাদী সেনা ও রাষ্ট্রপুঞ্জের সেনাবাহিনীকে দেশছাড়া করার দাবি।
প্রতিবাদী জনতার মূল লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন সরকারি সম্পত্তি। জাতীয় সংসদ, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও বেতার ভবনে হামলা চালায় জনগণ। টিভি ও রেডিও অভিসে ঢুকে অ্যান্টেনার দখল নয়। দুটি সরকারি টিভিরই সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি শহরের দুটি সেতুও আটকে দেওয়া হয়। শহরের মূল মূল রাস্তা, রাজধানীতে ঢোকার রাস্তাগুলিতেও ব্যারিকেড করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
জনতাকে থামাতে না পেরে গুলি চালায় পুলিশ। তাতে চার জন মারা যায়, আহত হয় অনেকে। এছাড়া বিপুল কাঁদানে গ্যাসও ছোঁড়া হয়। যদিও তাতে জনতার ক্রোধ দমানো যায়নি। সারাদিন ধরে বিক্ষোভ চলতে থাকে। বিভিন্ন গুদামে সঞ্চিত পণ্য দখল করে প্রতিবাদী জনতা।
প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম বৌবাকার কেইটার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ফুঁসছিল জনতা। জনগণের দুরবস্থা, সরকারি আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি এবং দেশের উত্তর প্রান্তে চলতে থাকা সামরিক সংঘর্ষের বিরুদ্ধে ইন্ডিপেন্ডেন্স স্কোয়ারে বক্তব্য রাখেন প্রতিবাদী মানুষ। মালির উত্তরাংশ আংশিক ভাবে দখলে রেখেছে সালাফি মুসলিম গোষ্ঠী। বিভিন্ন সময়ে তারা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও দখলদারির বিরুদ্ধে তারা অবস্থানও নিয়েছে।
প্রতিবাদী জনতার দাবি ছিল, সোনা, ইউরেনিয়াম, তেল(সম্প্রতি পাওয়া গেছে)-এর মতো জাতীয় সম্পদ দেশের জনগণের কাজে লাগাতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিকদের তা লুঠ করতে দেওয়া যাবে না। কয়েকশো বছর ধরে এই লুঠপাট চলছে।
এই আন্দোলনের নাম ‘৫ জুনের আন্দোলন’। আন্দোলনটি মূলত স্বতস্ফূর্ত। তবে সর্বহারা আন্দোলনের অভাবে একে প্রভাবিত করছে সে দেশের ‘বিরোধী’ বুর্জোয়া-জমিদার রাজনৈতিক শক্তি। সাম্প্রতিক কালে উঠে আসা কিছু দাবিতে রয়েছে তাদেরই ছাড়া। এর মধ্যে রয়েছে, সংসদ ভেঙে দেওয়া, অর্ন্বর্তীকালীন সরকার গঠন, নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ এবং ৯ সদস্যের সংবিধান সভা ভেঙে দেওয়া। অভিযোগ, সরকার দুর্নীতিগ্রস্থ এবং সংবিধান সভার সঙ্গে সংসদের অশুভ আঁতাত রয়েছে। জনমতের চারে ১১ জুলাই দেশের প্রধানমন্ত্রী বউবউ সিসে নতুন সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন।
মালির বর্তমান অবস্থা ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ
সম্প্রতি নিজের সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি ও বিরোধীদের শান্ত করার জন্য বেশি কিছু সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট কেইটা। সেগুলি সবই ব্যাপক ভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়। চলমান আন্দোলন সে দেশে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মালির জনগণের ব্যাপক ক্ষোভের প্রকাশ। যার ফলে গোটা দেশই পুরোদস্তুর সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে আর উত্তরাংশ রয়েছে আধা সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণে।
২০১২ সালে মালির প্রেসিডেন্ট পদচ্যুত হওয়ার পর ফরাসি আগ্রাসন ‘বারখানে’ শুরু হয়। ওই সময়ই তুয়ারেগ বিদ্রোহীরা উত্তর মালির শহরগুলি দখল করে নেয়। তুয়ারেগরা একটি যাযাবর বিদ্রোহী গোষ্ঠী। তারা একশ বছর ধরে ওই অঞ্চলে লড়াই চালাচ্ছে। তুয়ারেগরা উত্তর মালির নাম দেয় আজাওয়াদ। তুয়ারেগরা অবশ্য পরবর্তী কালে উত্তর মালিতে আল কায়দার মতো কিছু জেহাদি মুসলিম গোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতা করেছে।
আজাওয়াদ স্বাধীনতার জাতীয় আন্দোলন(এমএনএলএ)যখন চলছিল, তখন তুয়ারেগ যোদ্ধাদের ‘বীর বিদ্রোহী’ বলে ঘোষণা করেছিল ফরাসি গণমাধ্যমগুলি। কিন্তু তারা উত্তরাংশ দখল করার পর তাদের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী বলে চিহ্নিত করে। ঔপনিবেশিক ঔদ্ধত্য থেকে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই’, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’-এর নামে মালিতে সেনা পাঠায় ফ্রান্স। সাম্রাজ্যবাদ যেমনটা করে থাকে!
ফ্রান্স সহ আটটি দেশ সেসময় ৩,৫০০ সেনা পাঠায়, যা এখন বেড়ে সাড়ে চার হাজার হয়েছে। পাশাপাশি মালিতে ‘স্থায়িত্ব’ আনার জন্য সাড়ে তেরো হাজার ‘শান্তি’ সেনা পাঠিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। যে গোষ্ঠীগুলি উত্তর মালিকে বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ করছে, কোনো সন্দেহ নেই তারা সামন্ততান্ত্রিক সালাফি মতাদর্শের সঙ্গে যুক্ত(সুন্নি ইসলামের একটি ধারা)। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী দখলদারদের বিরুদ্ধে তারা জাতীয় প্রতিরোধের কর্মসূচি পালন করে থাকে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সেনার কনভয়ের ওপর আক্রমণ করে তারা সম্প্রতি দুজন সেনাকে হত্যাও করেছে।
পাশ্ববর্তী নাইজারের ইউরেনিয়াম খনিতে পৌঁছনোর জন্য ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের কাছে উত্তর মালির গুরুত্ব ব্যাপক। ফ্রান্সের তাপ-পরমাণু চুল্লিগুলির এক তৃতীয়াংশ যায় ওই খনিগুলি থেকেই। ওই চুল্লিগুলি থেকে ফ্রান্সের ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়।
ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী ওরানো অর্ধ শতকেরও বেশি সময় ধরে নাইজারে রয়েছে। তারা দুনিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম ইউরেনিয়াম উৎপাদক। পাশাপাশি প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেল পরিবহণের জন্যও এই সাহেল অঞ্চলটি(উত্তরে সাহারা থেকে দক্ষিণে সুদানের সমতল ভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত)ফ্রান্সের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর মালি ও মৌরিতানিয়ার তাঔদেনি অববাহিকা থেকে নিখরচায়, স্বাধীন ভাবে প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল উত্তোলনের অধিকার ভোগ করে ফ্রান্স।
তবে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ আফ্রিকায় এই মুহূর্তে সাম্রাজ্যবাদী চিনও গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। এখনও সেনা পাঠানোর চেয়ে অন্যান্য পদ্ধতিতেই ক্ষমতা বাড়ানো পছন্দ করে তারা। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে মালির জনগণের ন্যায্য ক্ষোভের আন্দোলনকে কাজে লাগাতে তারাও ময়দানে থাকতে পারে, এমনটা মনে করছেন কেউ কেউ। উত্তর মালির প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর তাদেরও লোভ কম নয়।
What are interests of China in Mali ?