ভারত ও পৃথিবীর বহু কমিউনিস্ট পার্টি মনে করেন চিনের কমিউনিস্ট পার্টি সংশোধনবাদী। সে দেশে যেটা চলছে, সেটা মোটেই সমাজতন্ত্র নয়। অনেকে আরও এগিয়ে মনে করেন, চিন বর্তমানে একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ। এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ আমাদের মতো সংবাদ নির্ভর পোর্টালে কম। কিন্তু সম্প্রতি নরওয়ের ‘সার্ভ দ্য পিপল’ সংগঠনের সমাজতন্ত্র বিষয়ক একটি প্রবন্ধ আমাদের নজরে আসে। ওই প্রবন্ধের চিন সংক্রান্ত অংশটি আমাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। অত্যন্ত সংক্ষেপে সেখানে চিনের বর্তমান শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে সমাজতন্ত্রের বুনিয়াদি পার্থক্যটি চিহ্নিত করা হয়েছে। আগ্রহীদের জন্য ওই অংশটি আমরা ভাবানুবাদ করলাম। ওই প্রবন্ধের আরও কিছু অংশ আগামী দিনে অনুবাদের আগ্রহ রয়েছে আমাদের।
সোভি্য়েত সংশোধনবাদের সঙ্গে চিনা সংশোধনবাদের বহু মিল আছে। তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিল হল, উৎপাদিকা শক্তির ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করা। একে বলে উৎপাদিকা শক্তির তত্ত্ব। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই তত্ত্বর মূল বক্তব্য হল, সমাজতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধি। এই তত্ত্ব দাবি করে, প্রযুক্তির উন্নতি, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দক্ষতার বিকাশই হল সমাজতন্ত্রের বুনিয়াদ।
এই বিষয়টা সংক্ষেপে বোঝাতে গিয়ে দেং জিয়াও পিং বলেছিলেন, “বিড়াল যদি ইঁদুর ধরতে পারে, তাহলে সেটা সাদা না কালো, তা দেখার দরকার নেই”। এই বক্তব্য সংশোধনবাদ ও পুঁজিবাদী পদ্ধতিকে ন্যায্যতা দেয়, কারণ তাতে উৎপাদন বাড়ে অতএব জনগণের জীবনযাত্রার মান বাড়ে। লেবার পার্টির নেতা হ্যারল্ড বার্নস্টেন তাঁর আত্মজীবনীতে গত শতকের চার ও পাঁচের দশকের লেবার পার্টির এক সাধারণ সম্পাদকের কথা লিখেছিলেন, যিনি কিনা সিআইএ-র এজেন্ট ছিলেন। সেই সাধারণ সম্পাদক বলতেন, পতাকার রং লাল হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি শিশুদের গালে লালচে আভা। তাদের স্কুলে ঘর গরম করার যন্ত্র থাকলেই ওই লাল আভা তৈরি হতে পারে। আর তেমন স্কুল তৈরি করতে পারে সমাজ গণতন্ত্রীরাই(সোশাল ডেমোক্র্যাসি)।
মার্কসবাদী হিসেবে আমরাও উৎপাদনে গুরুত্ব দিই। ‘উৎপাদনই মানব সভ্যতার সবচেয়ে বুনিয়াদি বিষয়’- মার্কসবাদী এই সত্যকে সামনে নিয়ে আসে। এক্ষেত্রে সংশোধনবাদীরা এই সত্যটাই আঁকড়ে ধরে। কিন্তু এটা তারা নিতান্তই যান্ত্রিক ভাবে করে। আর বলতে চায়, উৎপাদনটাই প্রাথমিক ব্যাপার, অর্থনীতি সবকিছুর থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেটা বাস্তবসম্মত লাইন নয়।
মাওয়ের লাইন ছিল, “বিপ্লবকে আঁকড়ে ধর, উৎপাদন বাড়াও”। মাওয়ের কাছে সমাজতন্ত্রের মূল বিষয় ছিল বিপ্লব, আর সেটাই উৎপাদনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে- উলটোটা নয়। স্তালিনের বক্তব্য অনুযায়ী, সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক নীতি হল, জনগণের প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, ‘তাদেরকে ধনী বানানো নয়!’ চিনা সংশোধনবাদ সেই প্রবণতাকেই উৎসাহিত করছে। সর্বহারার একনায়কত্ব ছাড়া সমাজতন্ত্র থাকতে পারে না। শ্রেণি সংগ্রাম ছাড়া সাম্যবাদ অসম্ভব। বিপরীতে সর্বহারার একনায়কত্বের পতন হলে সমাজতন্ত্রেরও পতন হয় এবং পুঁজিবাদ পুনর্স্থাপিত হয়। সংশোধনবাদীরা ক্ষমতা দখল করার পর চিনের পরিবর্তন গোটা দুনিয়াকে দেখাচ্ছে, মাওয়ের এই অন্তর্দৃষ্টি কতটা ঠিক। যদি বিড়াল নতুন বুর্জোয়াদের দরজার সামনে শুয়ে থাকে, তাহলে সে যত ইঁদুরই ধরুক, তাতে জনগণের কিছু যায় আসে না।