পুলিশি হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে গণ আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত ২৬ মে, তা এক মাস পেরিয়ে গিয়েছে। অভূতপূর্ব এই আন্দোলন গোটা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি তার ঢেউ পৌঁছে গিয়েছে দুনিয়ার নানা প্রান্তে। আন্দোলন থামার কোনো লক্ষণ এখনও নেই। এই পরিস্থিতিতে গোটা আন্দোলনের চরিত্র এবং শাসক শ্রেণির অবস্থানের বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছে সে দেশের একটি বিপ্লবী গণ সংগঠন ‘রেভলিউশনারি ইউনাইটেড ফ্রন্ট’। আমরা সেই প্রবন্ধের প্রাসঙ্গিক অংশের ভাবানুবাদ করলাম। উৎসাহীরা গোটা ইংরাজি প্রবন্ধটি পড়তে পারেন এই লিংকে।
আমেরিকায় পুলিশি নিষ্ঠুরতা এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন গোটা দেশ এবং গোটা দুনিয়াকে অনুপ্রাণিত করেছে। জর্জ ফ্লয়েডের খুন এবং বৃহত্তর পুলিশি নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে জনগণ জেগে উঠেছেন। শাসক শ্রেণি নানা ভাবে এই আন্দোলনকে দমন করার, নিজেদের পছন্দ মতো চেহারা(অহিংস)দেওয়ার এমনকি আন্দোলনের অংশ হয়ে ওঠার চেষ্টা করে চলেছে। তবে সার্বিক ভাবে দেখলে, কোনো চেষ্টাই এখনও অবধি সফল হয়নি। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কড়া হাতে আন্দোলন দমনের পক্ষে ছিলেন। সামরিক বাহিনীকে নামানোর পক্ষেও সওয়াল করেছিলেন। কিন্তু শাসক শ্রেণির মধ্যে এ বিষয়ে মতৈক্য হয়নি। বরং আন্দোলন মোকাবিলার পথ নিয়ে তাদের মধ্যে তীব্র দ্ব্ন্দ্ব সামনে এসেছে।
অন্যদিকে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে শাসক শ্রেণির অপর অংশ বিরোধী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নানা ভাবে চেষ্টা করেছে আন্দোলনকে হাইজ্যাক করার। তাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বিডেন ‘হিংসাত্মক আন্দোলনকারীদের বুকের বদলে পায়ে গুলি করা’র কথা বললেও আন্দোলনের অংশ হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন। এমনকি নিজের বদলে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করার প্রস্তাবও দিয়েছেন। যদিও তাতে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের ধ্বজাধারী বিডেনের অতীতের রেকর্ড জনগণ ভোলেননি। যে সব প্রদেশে ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় আছে, সেখানে তারা প্রতিবাদীদের কিছু দাবি মেনে নিয়েছে। সব মিলিয়ে মার্কিন শাসক শ্রেণি এখনও অবধি নরমে-গরমে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলন দমনের জন্য বেশ কিছু কড়া আইন আনলেও ফ্যাসিস্ট কায়দায় স্টিম রোলার চালানোর পথে তারা এখনও হাঁটেনি। অদূর ভবিষ্যতে হাঁটবে বলেও মনে হচ্ছে না।
গণ আন্দোলন এবং তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব
মিনিয়াপলিসের পুলিশ জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার পরে যে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা দ্রূত দেশজোড়া পুলিশি নিষ্ঠছুরতার বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনে পরিণত হয়। জর্জ ফ্লয়েড, ব্রেওনা টেলর সহ পুলিশের হাতে খুন হওয়া সব মানুষের মৃত্যুর প্রতিবাদে দেশের ৩৫০টিরও বেশি শহরে মানুষ পথে নামেন। কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট, ফ্ল্যাশ ব্যাং বুলেট, গণ গ্রেফতারি এবং কার্ফুকে অগ্রাহ্য করে মানুষ আন্দোলন চালিয়ে যান।
মিনিয়াপলিশের জনগণ একটি থানা জ্বালিয়ে দিয়ে পুলিশকে পালাতে বাধ্য করেন। নিয় ইয়র্কে হাজার হাজার মানুষ দিনের পর দিন রাত ৮টার কার্ফু অগ্রাহ্য করে পথে নামেন। বাধ্য হয়ে মেয়র ডে ব্লাসিও পরিকল্পিত দিনের এক দিন আগেই কার্ফু তুলে নেন। এখন শহর জুড়ে প্রতিবাদী মিছিলগুলো আবর্তিত হচ্ছে তার পদত্যাগের দাবিতে। দেশের বিভিন্ন শহরে মানুষ ক্রিস্টোফার কলোম্বাস, রবার্ট ই লি, ফিলাদেলফিয়ার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার ও মেয়র ফ্রাঙ্ক রিজোর মতো কুখ্যাত বর্ণবিদ্বেষীদের মূর্তিগুলি ভেঙে দিয়েছে বা বিকৃত করে দিয়েছে।
আন্দোলনের মধ্যে নানারকম দ্বন্দ্ব রয়েছে। তার মধ্যে একটি হল পুলিশকে ‘হাঁটু গেঁড়ে বসতে’ বলা, সেটা পুলিশ করে দেখানোর পর হইহই করে তাদের ধন্যবাদ জানানো। এই ভঙ্গিটি দেখে মনে হয় প্রতিবাদ-আন্দোলনের প্রতি পুলিশ সম্মান জানাচ্ছে কিন্তু সম্প্রতি দেখা গেছে বহু পুলিশ হাঁটু গেঁড়ে বসার এক মিনিট পরেই প্রতিবাদী জনগণের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। কোনো কোনো প্রতিবাদে ‘হাঁটু গেঁড়ে বস’ শ্লোগানের জায়গা নিয়েছে ‘চাকরি ছেড়ে দাও’। ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও তাদের বশংবদ বিভিন্ন অসরকারি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত কিছু গোষ্ঠীও আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, তাকে দখল করার জন্য, নিজেদের পক্ষে কাজে লাগানোর জন্য। আন্দোলনের ক্ষতিসাধনই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। বোস্টনের একটি প্রতিবাদী মিছিলকে লোকালয় থেকে এতদূরে নিয়ে গিয়ে শেষ করা হয়, যাতে প্রতিবাদীরা তারপরেও কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যেতে না পারে এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের গায়ে কোনো আঁচ না পড়ে। ডেলাওয়ারের একটি প্রতিবাদী সভায় জো বিডেন গিয়ে নিজের বেশ কিছু ছবি তোলান। যা অবশ্যই তার নির্বাচনী প্রচারের অংশ। এছাড়া বেশ কিছু সুবিধাবাদী লোকজন আন্দোলনের অংশ হয়ে শাসক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা চালায়।
এগুলি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই ধরনের চেষ্টা দেশজুড়েই হয়েছে। এগুলি আন্দোলনকে দখল করা এবং জনগণের উদ্যোগ ও প্রতিবাদকে নির্বাচনী বুথের কানাগলিতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনারই অংশ। যদিও লড়াই চলছে এবং আন্দোলন বেশ কিছু সাফল্যও পেয়েছে কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলদের আন্দোলন দখলের চেষ্টারও কিছু প্রভাব পড়েছে। সমাজের নানা স্তরের বিপুল সংখ্যক মানুষ আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই পুলিশি নিষ্ঠুরতা এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে সংযোগকে বোঝার চেষ্টা করেছেন এবং বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করেছেন। বাকিদের নজরের কেন্দ্রে থেকেছে পুলিশ এবং তারা পুলিশের পেছনে এক পয়সাও খরচ না করার দাবিতে পথে হেঁটেছেন। কেউ কেউ অবশ্য আরও সংকীর্ণ। তারা কেবল পুলিশি ‘বাড়াবাড়ি’ বন্ধ করতে চান এবং মনে করেন ‘কয়েকজন খারাপ লোক’ রয়েছে বলেই এসব হচ্ছে।
এইসব বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আন্দোলনের বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রবণতাটি বোঝা যায়। সামগ্রিক ভাবে যেটা মনে হচ্ছে, তা হল, বেশিরভাগই চান পুলিশের পেছনে পয়সা খরচ বন্ধ করা হোক এবং পুলিশ দফতর তুলে দেওয়া হোক। এটাই বর্তমান আন্দোলনের শক্তি ও দুর্বলতা। শক্তি, কারণ আমেরিকার পুলিশি ব্যবস্থার মধ্যে বর্ণবাদ এবং নিষ্ঠুরতা যে সহজাত ভাবেই রয়েছে, তা এই আন্দোলন প্রকাশ করে দিয়েছে। যারা মনে করে, সবই ‘কিছু খারাপ লোকের কাণ্ড’, এর মধ্যে দিয়ে তাদের কাছে প্রকৃত পরিস্থিতিটা অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। পুলিশি ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে একের পর এক বেশ কিছু দাবি তোলা হয়েছে, যা শাসক শ্রেণি কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না।
পুলিশের শরীরে আরও বেশি বডি ক্যামেরা এবং ‘পুলিশের মধ্যে ঢুকে থাকা বর্ণবিদ্বেষ’-এর সম্বন্ধে প্রশিক্ষণের প্রতিশ্রুতিতে তৃপ্ত না হয়ে বহু আন্দোলনকারী পুলিশ দফতর তুলে দেওয়ার দাবিতে অনড় থেকেছেন। শাসক শ্রেণি এইসব দাবি মানতে মোটেই আগ্রহী নয়। মার্কিন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুলিশ একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে। বহু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার চালানোর ক্ষেত্রে তারাই প্রথম সারিতে থাকে, তারা আন্দোলন-প্রতিবাদ সামাল দেয়, ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষা করে, আন্দোলনকারীদের ওপর নজরদারি চালায়, গৃহহীনদের হেনস্থা করে এবং আরও নানা কিছু করে। তাদের জন্য নির্ধারিত বিশাল বাজেট দিয়ে সামরিক বাহিনীর জন্য বাড়তি সরঞ্জাম কেনা হয়। অতএব, পুলিশ বাজেটকে বাড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বড়ো বড়ো অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কায়েমি স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে।
যাই হোক, এই পুলিশ কেন্দ্রিকতা আন্দোলনের একটি দুর্বলতাও বটে। কারণ এটা নয় যে পুলিশকে সমালোচনা করা যাবে না, বরং কারণ হল, জনগণের ক্রোধ এবং বিক্ষোভ যদি পুলিশের মধ্যেই সংকীর্ণ হয়ে থাকে তাহলে যে বৃহত্তর পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে রক্ষা এবং সেবা করার জন্য পুলিশি ব্যবস্থা রয়েছে, সেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব সহকারে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসা যাবে না। পুলিশের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ ন্যায্য। সাধারণ ভাবে মার্কিন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুলিশই সামনের সারিতে থাকা নিপীড়ক। তারাই প্রতিবাদীদের থামায় ও দমন করে। তারাই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়। তারাই জনগণকে গ্রেফতার করে। তারাই অত্যাচার ও হত্যা করে। কিন্তু তাদের এই নিষ্ঠুরতা আসলে বৃহত্তর পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে সেবা করারই অঙ্গ। তাই পুলিশি নিষ্ঠুরতাকে উচ্ছেদ করতে হলে গোটা ব্যবস্থাটাকেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত পাল্টে ফেলতে হবে।
তবে বলা দরকার, চলতি আন্দোলনের যা শক্তি, তাতে শাসক শ্রেণির থেকে সত্যিকারের কিছু সুবিধা আদায় করা সম্ভব। গণ আন্দোলনের কিছু সাফল্য ইতিমধ্যেই মিলেছে।তার মধ্যে রয়েছে পুলিশ বাজেটে ব্যাপক ছাঁটাই, পুলিশের হাতে অস্ত্র না দেওয়া, অত্যাচার ও হত্যার জন্য পুলিশকে শাস্তি দেওয়া, ক্রিস্টোফার কলোম্বাস ও রবার্ট ই লি-র মতো বর্ণবিদ্বেষীদের মূর্তি ভাঙা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মিনিয়াপলিস সিটি কাউন্সিল পুলিশ বিভাগ তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বদলে ‘জনগণ নির্ভর গণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও বিষয়টা অস্পষ্ট। গোটা দেশে বর্ণবিদ্বেষীদের মূর্তি নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। বহু শহরের পুলিশ বাজেটে কাটছাঁট করা চলছে। যদিও এই সব অর্জিত সাফল্য এবং ভবিষ্যতের সাফল্যগুলির সঙ্গে আশঙ্কাও জড়িয়ে রয়েছে। রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটিক- শাসক শ্রেণির দুটি দলই আন্দোলনকে দখল, নিয়ন্ত্রণ ও দমন করতে ওঁত পেতে রয়েছে।