নিজস্ব প্রতিবেদন: একটি গণসাংস্কৃতিক সংগঠনের তরফে সুন্দরবনের উমপুন-দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে শোনা গেল ভয়ঙ্কর এক কথা। লকডাউনে কাজ হারিয়ে মরিয়া হয়ে জঙ্গলে ঢুকছেন বহু ব-দ্বীপবাসী। তাঁদের অনেকেরই প্রাণ যাচ্ছে সুন্দরবনের বাঘের থাবায়।
প্রথমে শুনে মনে হতে পারে, এ আর নতুন কী? এমনই তো দস্তুর সুন্দরবনের জঙ্গলমহলে। নতুন হল, লকডাউনের মাস তিনেক সময়ে বাঘের হামলায় নিহতের সংখ্যাটা। খোদ গ্রামবাসীরা পর্যন্ত বলছেন, এত কম সময়ে বাঘের হানায় এত মৃত্যু তাঁরা কখনও দেখেননি।
কথা হচ্ছিল কুমিরমারি ব-দ্বীপের বাসিন্দাদের সঙ্গে। উলটো দিকে মরিচঝাঁপির জঙ্গল। সেই মরিচঝাঁপি, সরকারি বাহিনীর হাতে উদ্বাস্তু গণহত্যার জন্য যে দ্বীপ কুখ্যাত। উদ্বাস্তু উচ্ছেদের পর, গত চল্লিশ বছরে যে দ্বীপ হয়েছে বাঘের ডেরা। গ্রামবাসীদের দাবি, শুধু মরিচঝাঁপির জঙ্গলেই গত ক’ মাসে কুমিরমারির সাত থেকে আট জনের মৃত্যু হয়েছে বাঘের থাবায়। ওই একই জঙ্গলে একই কারণে আশপাশের অন্যান্য ব-দ্বীপের নিহতদের হিসেব ধরলে, সংখ্যাটা নাকি কুড়ি ছাড়াবে। এবং, এটা নাকি শুধু মরিচঝাঁপি জঙ্গলের ঘটনা নয়; লকডাউনের ক’ মাসে সুন্দরবন এলাকার একাধিক জঙ্গলে নাকি এ ঘটনা ঘটছে। অবিশ্বাস্য!
হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য। কারণ, প্রতিটি মৃত্যুই অনথিভুক্ত। কারণ, পুলিশি হয়রানির ভয়। কারণ, দ্বীপবাসীরা জঙ্গলে ঢোকেন বন দফতরের আইন ভেঙে, রোজগারের জন্য মরিয়া হয়ে। মৃত্যু অনথিভুক্ত এবং রাষ্ট্রের চোখে নিহত ব্যক্তি ‘আইনভঙ্গকারী’। তাই, বন দফতরের তরফে তাঁর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্নই নেই। কারণ, আইনি ঝঞ্ঝাট থেকে বাঁচতে নিহতের পরিবার ক্ষতিপূরণের দাবিটাই তো তোলে না। যদিও, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের মূল রোজগেরে মানুষটি নিহত হওয়ায় পরিবার পথে বসে।
আসলে, পয়সা রোজগারের জন্য মরিয়া ব-দ্বীপবাসীরা জঙ্গলের খাঁড়িতে কাঁকড়া আর মাছ ধরতে ঢোকেন; আর, তাঁদেরকে ধরে বাঘ। কুমিরমারির বাসিন্দারা জানালেন, লকডাউনের সময়টায় তাঁদের দ্বীপের বহু লোকই মরিচঝাঁপির জঙ্গলের সরু খাঁড়িগুলোয় ডিঙি নৌকো নিয়ে কাঁকড়া ধরতে যাচ্ছেন। আগে যাঁরা ও কাজে যাননি, তেমন বহু মানুষও যাচ্ছেন। বাদ নেই মহিলারাও। কারণ, কাঁকড়া ধরতে পারলে রোজগার প্রচুর। কারণ, কাঁকড়া রফতানি হয়। কপাল ভালো হলে, পরিবারের দু’ জন মিলে জঙ্গলে ঢুকে তেমন সংখ্যায় কাঁকড়া ধরতে পারলে, কয়েক ঘণ্টার কাজেই হাতে আসতে পারে বেশ কয়েক হাজার টাকা। আর, কপাল মন্দ হলে ঠাঁই হতে পারে বাঘের পেটে। লকডাউনের মাঝে যেমনটা হয়েছে কুমিরমারি দ্বীপের সাত-আট জনের।
কিন্তু লকডাউনের মাঝে বাঘের হানা বেড়ে যাওয়ার রহস্যটা কী? গ্রামবাসীরা অনেকে যা বলছেন, তা হয়তো অবৈজ্ঞানিক; কিন্তু সে বক্তব্যে ধরা পড়ছে সরকারি বন দফতরের সঙ্গে বন-সংলগ্ন মানুষের নিদারুণ শত্রুতার কথা। কী বলছেন গ্রামবাসীরা? বলছেন, গ্রামবাসীদের জঙ্গলে ঢোকা আটকাতে না-পেরে, জঙ্গলে মানুষখেকো বাঘ ছেড়ে দিয়েছে বন দফতর। যাতে ভয়ে আর কোনও গ্রামবাসী জঙ্গলে না-ঢোকে।
কথাটা শুনে, গায়ে কাঁটা দিল। যেমনটা দিয়েছিল বছর দশেক আগে, আয়লার পর ত্রাণ-উদ্যোগে শামিল হয়ে এই কুমিরমারি দ্বীপেই গিয়ে আর এক গ্রামবাসীর কথায়। সে বার, মেঘলা রাতে নদীপাড়ে বসে বয়স্ক সেই মানুষ লোককাহিনীর ঢঙে বলে যাচ্ছিলেন মরিচঝাঁপি গণহত্যার স্মৃতি। বয়সের ভারে মাঝে মাঝে খেই হারাচ্ছিলেন। কিন্তু কথা শেষ করেছিলেন এই বলে যে, সেই গণহত্যার পর থেকেই নাকি সুন্দরবনের বাঘেরা মানুষখেকো হয়ে যায়। নদীতে ভেসে যাওয়া নিহত মানুষের লাশ খেয়ে। হয়তো নেহাতই লোককল্পনা। কিন্তু ইতিহাস আর বর্তমান মেশানো সেই মেঘলা রাতে, এই প্রতিবেদক-সহ বাকি ত্রাণকর্মীদের কারওরই আর সাহস হয়নি উলটো দিকের মরিচঝাঁপি জঙ্গলের দিক তাকিয়ে বেশি ক্ষণ আর সেই নদীর পাড়ে বসে থাকার। এ বারও হল না।
বন দফতর বা পরিবেশপ্রেমীদের বক্তব্য কিন্তু পরিষ্কার। তাঁরা বলছেন, বাঘ তো আর মানুষের বসতিতে ঢুকে মানুষ মারছে না। মানুষই সরকারি নিষেধ অমান্য করে বাঘের ডেরায় অনুপ্রবেশ করছে। ফলে, বাঘের হানায় গ্রামবাসীদের মৃত্যু দুঃখজনক হলেও এ সব ক্ষেত্রে তেমন কিছু করার নেই। এক, জঙ্গলে লোকজনের আনাগোনা বন্ধ করা ছাড়া। ঠিকই তো! বিশেষত, এই এনআরসি-এনপিআর-সিএএ-এর জমানায় কেউ একবার ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেলে, কর্তৃপক্ষের আর কী-ই বা করার থাকে, তাকে হয়রান করা ছাড়া?
কিন্তু, প্রাণের এ হেন ঝুঁকি নিয়েও জঙ্গলে কেন ঢুকছেন সুন্দরবনবাসী? কারণ, পেট বড়ো বালাই। কুমিরমারির মতো ব-দ্বীপে চাষের জমি যেটুকু আছে, তা এক-ফসলি। বাকি রোজগারের উপায় মৌমাছি পালন, হাঁস-মুরগি পালন, পুকুরে মাছ চাষ। দ্বীপবাসীদের বক্তব্য, এ সব থেকে আয়ের সুযোগ সকলের নেই; থাকলেও, তেমন আয় হয় না। চাষের কাজে ব্যাঙ্ক বা প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের অভাব বিপূল। আর, রফতানিযোগ্য কাঁকড়া ধরার কাজে পয়সা ভালোই। তাই, প্রাণ হাতে নিয়েই তাঁরা জঙ্গলে ঢোকেন। আর, মারাও যান। কিন্তু, তা বলে এত? হ্যাঁ, কারণ, লকডাউনের বাজারে কাজ হারিয়ে অনেক বেশি লোক জঙ্গলে ঢুকছেন, আর তাই বাঘের হানায় মরছেনও বেশি। হিসেবটা সোজা, এবং গরিবখেকো।
ছবি: গ্রামবাসীদের সৌজন্যে