পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: প্রায় দুবছর পর মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সে দেশের সেনা, পুলিশ ও সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর ওপর পরপর হামলা চালাল ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’। সাম্প্রতিকতম হামলার ঘটনাটি ঘটেছে গত ২২ জুন।
মায়ানমারের বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী রাখাইন(সাবেক আরাকান)প্রদেশের উত্তরাংশে ঐতিহাসিক কাল থেকে রোহিঙ্গাদের বাস। রোহিঙ্গারা ধর্মপালনের দিক থেকে মুসলমান হলেও সে দেশের অন্যান্য মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের থেকে নিজেদের পৃথ জাতিগত পরিচয় বহন করে থাকেন। তারা মনে করেন গত ষাট বছরে মায়ানমারে বারবার শাসক পালটালেও তাদের ওপর অত্যাচার একই রকম রয়ে গেছে। বস্তুত রোহিঙ্গারা যে আরাকান প্রদেশে থাকেন, সেখানেও তারা সংখ্যালঘু। সংখ্যাগুরু বৌদ্ধরা। এছাড়া ওই প্রদেশে সংখ্যাগুরুদের জাতিসত্তার আলাদা আন্দোলনও রয়েছে। সেই আরাকান আর্মিও মায়ানমার রাষ্ট্রের সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রাম চালাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও বৈরিতামূলক।
রোহিঙ্গাদের পৃথক আত্মপরিচয়কে অস্বীকার করতে চেয়ে মায়ানমার সরকার তাদের নাগরিকত্ব দেয়নি। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা ২০১৬ সালে তৈরি করেন নিজেদের সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ বা আরসা। আরসার নেতা আতাউল্লা আবু আম্মার জুনিনি। অনেকেই মনে করেন আরসা একটি ইসলামপন্থী সংগঠন। কিন্তু জুনিনির দাবি, এই বক্তব্য ভিত্তিহীন। তারা ধর্মনিরপেক্ষ এবং তাদের মূল লক্ষ্য রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষা করা। আরসার বিশেষত্ব হল, অন্যান্য সশস্ত্র সংগ্রামী বাহিনীর মতো এদের যোদ্ধারা যুদ্ধের পোশাক পরেন না। সাধারণ পোশাক পরে থাকেন। পাশাপাশি টুইটারে ১৫ দিন অন্তর তারা বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের মতামত জানান।
২০১৬ সালে থেকে মায়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীগুলির সঙ্গে একের পর এক সশস্ত্র লড়াইতে জড়িয়েছে রোহিঙ্গারা। প্রথম দিকে কেবল বাঁশ ও রাম দাঁ-কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে বন্দুক ব্যবহার শুরু করে তারা। ২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর এক আক্রমণের জবাব দিতে গিয়ে কিছু সাধারণ মানুষকে মারে আরসা। তাদের দাবি ছিল, এরা পুলিশকে তাদের বিরুদ্ধে খবর দিয়েছিল। সেই সময়ই উত্তর রাখাইনে হিন্দুদের গণহত্যার ঘটনা ঘটে। মৃতদের পরিবারগুলি প্রথমে জানায়, এলাকার সংখ্যাগুরু বৌদ্ধরা ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিছুদিন পরেই মায়ানমার সরকারের প্রতিনিধিদলকে তারা জানায়, আরসার ভয়ে তারা ওই বিবৃতি দিয়েছিল, আসলে গণহত্যা ঘটিয়েছে রোহিঙ্গারাই। রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে ওই ঘটনা সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট করার জন্য বৌদ্ধরা ওই কাজ করেছে। যাই হোক, ঘটনার পর রোহিঙ্গাদের এলাকায় বিশাল আক্রমণ নামায় মায়ানমার সেনা। প্রচুর মানুষকে খুন করা হয়। ১০ লক্ষ রোহিঙ্গার মধ্যে সাত লক্ষেরও বেশি সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ আশ্রয় নেন। অনেকেই ছড়িয়ে পড়েন ভারত সহ এশিয়ার নানা দেশে। মায়ানমারের প্রায় দেড় লক্ষ রোহিঙ্গা এখন রাষ্ট্রপুঞ্জের শিবিরে রয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে প্রায় দুবছর ফের সশস্ত্র হামলা চালাল আরসা।
গত ২৯ মে মায়ু নদীর তীরে রাথেয়ুতং শহরে থানায় হামলা চালিয়ে চারজন পুলিশকে মারে আরসা। এলাকা থেকে ১০জন আটক করে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে পুলিশদের পরিবারের লোকেরাও ছিল। ২ দিন পরে পরিবারের লোকদের মুক্ত দেওয়া হয়, আটকে রাখা হয় পুলিশদের।
১৩ জুন ওই একই শহরে সীমান্তরক্ষী বাহনীর ওপর আক্রমণ চালায় আরসা। কেউ না মরলেও বেশ কয়েকজন আধা সেনা গুরুতর আহত হয়।
১৪ জুন কেয়াউক তাও শহরে এক সাব ইন্সপেক্টরকে ছুড়ি দিয়ে খুন করা হয়। তিনি তখন থানা থেকে বাড়ি ফিরছিলেন।
২২ জুন রাথেয়ুতুং শহরে একটি পুলিশের জিপের ওপর হামলা চালায় আরসা। ঘটনায় ৩ জন পুলিশের মৃত্যু হয়েছে।
এরপরই বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী লেত কার গ্রামের ২০০ বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে মায়ানমার সেনা। আরও বড়ো আরসা বিরোধী অভিযান চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। সেজন্য বেশ কিছু গ্রাম খালি করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।