ভারতের নতুন কোভিডের ওষুধ নিয়ে চিন্তিত বিশেষজ্ঞরা, কেন?
পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: জুনের ২০ তারিখে মুম্বইয়ের গ্লেনমার্ক ওষুধ সংস্থা ঘোষণা করে, তারা বাজারে ফ্যাবিফ্লু নামে একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ এনেছে, যা ‘মৃদু থেকে মাঝারি’ উপসর্গ থাকা কোভিড রোগীর চিকিৎসায় সক্ষম। এই ওষুধটির জেনেরিক নাম ফ্যাভিপিরাভির। গ্লেনমার্ক প্রতিটি ট্যাবলেটের(২০০ মিলিগ্রাম) দাম করেছে ১০৩ টাকা। সংস্থার ঘোষণা অনুযায়ী, কোভিড রোগীকে প্রথম দিন ২ বারে ১৮০০ মিলিগ্রাম করে মোট ৩৬০০ মিলিগ্রাম ওষুধ খেতে হবে। পরবর্তী ১৩ দিন, প্রতিদিন দুবারে ৮০০ গ্রাম করে মোট ১৬০০ মিলিগ্রাম ওষুধ খেতে হবে।
এক বিবৃতিতে গ্লেনমার্ক জানায়, এই ওষুধ ভারতে কোভিডের চিকিৎসায় এক ‘যুগান্তকারী ঘটনা’। ভারতের সংবাদ মাধ্যমগুলি বলে এটি ‘ভারতের প্রথম কোভিড ১৯-এর ওষুধ’। সাধারণ ভাবে সকলেই একে ‘সুসংবাদ’ বলে চিহ্নিত করে। গ্নেনমার্ক আরও একধাপ এগিয়ে দাবি করে, এই ওষুধ ‘খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে’।
ভারতে এই মুহূর্তে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ করোনা-রোগী থাকায় ওষুধ নিয়ে এই উত্তেজনা স্বাভাবিক। গত সপ্তাহে ফ্যাবিফ্লু ছাড়াও করোনার আরও দুটি ওষুধকে ছাড়পত্র দিয়েছে ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। কোভিফোর ও সিপ্রেমি। কিন্তু সে দুটিই ইঞ্জেকশন এবং হাসপাতালে ভর্তি রোগীর উপরই কেবল সেগুলি প্রয়োগ করা যাবে। তাই মুখ দিয়ে খাওয়ার ওষুধ হিসেবে ফ্যাবিফ্লু-কে নিয়ে উৎসাহ অনেক বেশি। ওষুধ বেরনোর পরের দুদিনে বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে গ্লেনমার্কের শেয়ারের দর ৩৫% বৃদ্ধি পায়।
যদিও সরকারি আধিকারিকরা বলছেন, এই ওষুধ শুধুই পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য। যাকে তাকে খাওয়ানোর জন্য নয়। ভারতের স্বাস্থ্য বিভাগের অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল ড. রাকেশ ভার্মা বলেন, ‘এই ওষুধ সরাসরি রোগীরা কিনতে পারবেন না। কেবলমাত্র চিকিৎসকদের পরামর্শেই তা বিক্রি করা যাবে। তাও তাতে রোগীকে লিখিত সম্মতি দিতে হবে”। বলাই বাহুল্য, ভারতের মতো স্বাস্থ্য সচেতনতার দেশে, মহামারি পরি্স্থিতিতে চিকিৎসক কোনো ওষুধ খেতে বলার পরও কোনো রোগী তা খেতে নাও চাইতে পারেন, এমন হওয়াটা নেহাতই কষ্টকল্পনা।
ওষুধ বাজারে আসার পর চাপে পড়ে যান চিকিৎসকরাও। ২২ জুন হায়দরাবাদের চিকিৎসকরা সংবাদমাধ্যমকে জানান, রোগীদের এই নতুন ওষুধ লেখার ব্যাপারে তারা বাধ্য হয়ে পড়ছেন বলে মনে করছেন। অন্যদিকে সারা ভারত ড্রাগ অ্যাকশন নেটওয়ার্ক নামে ওষুধ সংক্রান্ত একটি অসরকারি সংগঠনের যৌথ আহ্বায়ক মালিনী আইসলা বলেন, “ফ্যাবিফ্লুর কার্যকারিতা সম্পর্কে প্রমাণ এতই কম যে একে নিয়ে এত হইচই-এর কোনো অর্থ নেই”।
জাপানে ফ্যাভিপিরাভির, অ্যাভিগান নামে বিক্রি হয়। সে দেশের ওষুধ সংস্থা তোয়ামা কেমিক্যাল এটি তৈরি করে থাকে। ২০১৪ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের নতুন রূপগুলির(স্ট্রেইন)চিকিৎসায় এটি ব্যবহার করার অনুমোদন দিয়েছে সে দেশের সরকার।
কোভিড১৯-এর চিকিৎসায় ফ্যাভিপিরাভিরকে পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে চিন ও রাশিয়া। অন্যদিকে মাঝারি থেকে গুরুতর কোভিড১৯ রোগীদের ওপর এটি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। গোটা দুনিয়ায় এই ওষুধটি নিয়ে ১৬টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে প্রাথমিক ভাবে এই ওষুধটি নিয়ে উৎসাহ দেখালেও এখন বলছেন, ফ্যাভিপিরাভির দিয়ে কোভিডের চিকিৎসা সম্ভব, এমন কোনো জোরালো প্রমাণ এখনও নেই।
কোভিড মহামারি সামলানোয় ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মোটেই সুবিধা করতে পারছে না। এখানে পরিষেবা দুর্বল, রক্ত পরীক্ষা বেশ কম হচ্ছে, রোগীদের চিকিৎসাতেও নানা খামতি দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে নতুন ওষুধ নিয়ে তাড়াহুড়োটা খুবই স্বাভাবিক।
সাম্প্রতিক কালে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির জেরে, সাধারণ মানুষ ওষুধটি ব্যাপক পরিমাণে কিনে জমিয়ে রাখতে শুরু করে। ওই ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়েও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গোটা দুনিয়ায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে যাবতীয় পরীক্ষানিরীক্ষা বন্ধ করে দেয়।
গ্লেনমার্ক জানিয়েছে, তারা ওষুধটি ১৫০জন করোনা আক্রান্তের ওপর প্রয়োগ করেছে। সংস্থার বক্তব্য, মহামারিতে ওষুধের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্বের কথা মাথায় রেখেই খুব বেশি রোগীর ওপর পরীক্ষা না করেই ওষুধটি বাজারে আনা হয়েছে। তাদের আরও দাবি ‘দুনিয়া জুড়ে কোভিডের চিকিৎসায় ফ্যাভিপিরাভিরের কার্যকারিতা নিয়ে যে সব গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, আমাদের প্রমাণগুলি সেগুলির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ’। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্লেনমার্কে তৃতীয় দফার পরীক্ষার রিপোর্ট কোথাও প্রকাশিত হয়নি, কাউকে দেখানোও হয়নি। ফলে ওই পরীক্ষা সংক্রান্ত তথ্যের কোনো স্বচ্ছতা নেই। সাধারণ ভাবে তৃতীয় দফার পরীক্ষায় যে কোনো ওষুধ কয়েকশো থেকে ৩০০০ পর্যন্ত রোগীর ওপর প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। তারপর দেখা হয়, যাদেরকে ওই ওষুধ দেওয়া হয়নি, তাদের থেকে ওইসব রোগীরা ভালো আছেন কিনা। পাশাপাশি এই পর্যায়ে ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার দিকেও নজর দেওয়া হয়।
এই প্রসঙ্গে সমালোচনা শুরু হয়েছে ভারত সরকারের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন বা সিডিএসসিও-র ভূমিকার। সিডিএসসিও-র পক্ষ থেকে ফ্যাবিফ্লু-কে ‘আপদকালীন পরিস্থিতির সাপেক্ষেই প্রয়োগের জন্য দ্রূত অনুমোদন’ দেওয়া হয়েছে। ‘রোগের গুরুত্ব, বিরলতা, অন্য চিকিৎসার অভাবের জন্যই চটপট অনুমোদন’ দেওয়া হয়েছে বলেছে জানিয়েছে গ্লেনমার্ক।
ভারতের ‘ওষুধ ও প্রসাধন আইন, ১৯৪০’-এ আপদকালীন পরিস্থিতিতে কোনো কিছুর অনুমোদন দেওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। মার্চ মাসে কোভিডের ওষুধ ও প্রতিষেধককে অনুমোদন দেওয়ার জন্য সিডিএসসিও ‘সর্বাধিক অগ্রাধিকার’ দেওয়ার নতুন নিয়ন্ত্রণ নীতি তৈরি করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্যাবিফ্লু সহ কোভিড১৯-এর কোনো পরীক্ষামূলক ওষুধের অনুমোদনের জন্য সিডিএসসিও কোন পদ্ধতি মেনে কাজ করেছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্যই প্রকাশ করেনি। ওষুধ সংস্থাগুলি কী কী প্রমাণ দেখিয়েছে, সেই প্রমাণগুলির কীভাবে মূল্যায়ন হয়েছে, কীসের ভিত্তিতে ওষুগুলির অনুমোদন দেওয়া হল, সেই সংক্রান্ত কোনো তথ্যই জনগণকে জানানো হয়নি।
গ্লেনমার্ক চারটি গবেষণার ফলাফল দেখিয়েছে। তার মধ্যে দুটি চিনের, একটি রাশিয়ার ও একটি জাপানের। ভারতের চিকিৎসকরা একে যথেষ্ট বলে মনে করছেন না। বিশেষত চিনের একটি পরীক্ষায় মাত্র ৩৫ জন মূদু উপসর্গ যুক্ত রোগীর ওপর পরীক্ষাটি করা হয়েছে। সেটিতেও ওষুধটি প্রয়োগের ফলে রোগীদের শরীরে ‘চিকিৎসাগত মাপকাঠিগুলি অনুযায়ী কী কী উন্নতি দেখা গেছে, তার কোনো বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ’ দেখানো হয়নি বলে জানাচ্ছেন তারা।
গ্লেনমার্কের দাবি, তারা ভারতের রোগীদের ওপর ওষুধটির পরীক্ষায় কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখেনি। যদিও কিডনি, লিভারের রোগী, গর্ভবতী ও স্তনদুগ্ধ রয়েছে এমন মহিলাদের ওপর এই ওষুধ প্রয়োগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ২০ বছরের কম বয়সিদের ওপরও ফ্যাবিফ্লুর প্রয়োগ নিষিদ্ধ।
চিকিৎসকরা মনে করছেন, মহামারি পরিস্থিতিতে পর্যাপ্ত সংখ্যাক রোগীদের ওপর ওষুধের প্রয়োগ করা যাবে না- এ যুক্তি চলে না। পৃথিবী জুড়ে এখন কোভিডের ওষুধ নিয়ে বহু পরীক্ষা হচ্ছে, সেগুলির রিপোর্ট প্রকাশিতও হচ্ছে। তাদের বক্তব্য, বেশ কিছু রোগীর ওপর ওষুধটি প্রয়োগ হলে, তা থেকে অন্তত কাজ চালানো কিছু প্রমাণ মেলে, যা থেকে চিকিৎসার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যেহেতু ওষুধটি থেকে কোনো ক্ষতি হলে, তা রোগীদেরকেই বহন করতে হবে, তাই ওষুধ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য রোগীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া অবশ্যই উচিত।
সব মিলিয়ে কোভিডের চিকিৎসায় ভারতবাসীর স্বাস্থ্যের চেয়ে বাণিজ্যিক সংস্থার স্বার্থকেই ভারত সরকার অগ্রাধিকার দিচ্ছে কিনা, এ প্রশ্ন উঠছে।
ছবি: ভাইস ডট কম