পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: গত ২৬ মে মার্কিন পুলিশ জর্জ ফ্লয়েডকে খুন করার পর ইতিমধ্যে দুনিয়ার ৭৫০টি শহর প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিবাদের তীব্রতা অনেক গুন বেশি মার্কিন শহরগুলিতে। সেখানকার বিভিন্ন প্রদেশ ও শহরের প্রশাসন জনতাকে শান্ত করতে নানা পদক্ষেপ করেছে। সেখানকার ওয়াশিংটন প্রদেশের সিয়াটল শহরের প্রতিবাদী আন্দোলন আলাদা ভাবে নজর কেড়ে নেয়। কারণ সেখানে প্রতিবাদ চলাকালীন এক ৯ বছর বয়সি মেয়েকে পুলিশ পেটায়, স্থানীয় প্রশাসন কাঁদানে গ্যাসে ৩০ দিন নিষেধাজ্ঞা জারি করার দুদিনের মধ্যেই পুলিশ প্রতিবাদীদের ওপর কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ করে। এমনকি আন্দোলনকারীদের চিকিৎসাতেও বাধা দেয় বলে অভিযোগ। এসবের মধ্যেই সেখানে একটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে। শহরের পুলিশ বিভাগের ছেড়ে যাওয়া একটি অঞ্চল জুড়ে ‘ক্যাপিটল হিল স্বশাসিত অঞ্চল’ তৈরি করেছে স্থানীয় নৈরাজ্যবাদীদের একটি গোষ্ঠী। কোনো কোনো মহলের দাবি, তাদের সঙ্গে রয়েছেন কিছু সংগ্রামী বাম শক্তিও।
আন্দোলন ও গোলাপি ছাতা
মিনিয়াপোলিসের জনগণ পথে নামার তিন দিন পর, ২৯ মে প্রতিবাদে নামে সিয়াটলবাসী। ৩০মে ৯ বছরের এক কিশোরীকে মারে এক পুলিশকর্মী, পাশাপাশি এক ভিডিওতে দেখা যায় একজন অফিসার এক প্রতিবাদীর ঘাড়ে হাঁটু চাপা দিয়ে রেখেছেন। ঠিক যেভাবে জর্জ প্লয়েডকে খুন করা হয়েছিল। প্রতিবাদীদের দমন করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস, লঙ্কা গুঁড়ো স্প্রে ইত্যাদি ‘কম মারণ শক্তি সম্পন্ন’ পদ্ধতি ব্যবহার করতে থাকে। অন্যদিকে প্রতিবাদীরা রাসায়নিক অস্ত্র থেকে নিজেদের বাঁচাতে ছাতা ব্যবহার করা শুরু করে। পুলিশ একজন প্রতিবাদীর থেকে গোলাপি ছাতা কেড়ে নেয়। ঘটনার জেরে গোটা শহরে আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয় গোলাপি ছাতা।
৫ জুন সিয়াটলের মেয়র জেনি দুরকান কাঁদানে গ্যাসে ৩০ দিনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তার দুদিনের মধ্যেই নিষেধাজ্ঞা ভেঙে পুলিশ প্রতিবাদীদের ওপর বিনা প্ররোচনায় বিপুল পরিমাণ কাঁদানে গ্যাস ও ফ্ল্যাশব্যাং(জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য প্রচুর আলো ও শব্দ উৎপন্নকারী গ্রেনেড, যাতে শারীরিক আঘাত তেমন হয় না)প্রয়োগ করে। পরের দিন সিটি কাউন্সিলের সদস্যরা মেয়রের পদত্যাগ দাবি করেন। শহরের পূর্বাঞ্চলের থানা থেকে মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করে পুলিশ। শেষ অবধি গোটা পুলিশ ভবনটি খালি হয়ে যায়।
তারপরই প্রতিবাদীরা পুলিশের তৈরি করা ব্যারিকেডকে ঠিক বিপরীত ভাবে কাজে লাগায়। আশেপাশের অঞ্চলের ৬টি ব্লককে ব্যারিকেড ঘেরা ‘ক্যাপিটল হিল স্বশাসিত অঞ্চল’-এ পরিণত করে। পায়ে হেঁটে সেখানে ঢোকা গেলেও গাড়ি নিয়ে ওই অঞ্চলে ঢোকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটি একটি জরুরি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ কারণ গত দিন পনেরোর আন্দোলনের মধ্যে বেশ কয়েকবার সিয়াটল ও গোটা আমেরিকায় পুলিশ, শ্বেতাঙ্গ বর্ণবিদ্বেষী ও অন্যান্য প্রতিবাদ বিরোধী শক্তি প্রতিবাদী জনতার জমায়েতে গাড়ি চালিয়ে দিয়েছে।
ক্যাপিটল হিল স্বশাসিত অঞ্চল- ব্যাপারটা কী ?
সিয়াটল পুলিশ বিভাগের পূর্ব থানা এলাকার ঢিলেঢালা একটি নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠী এই স্বশাসিত অঞ্চলটি তৈরি করেছে। তারা সিয়াটল পুলিশ ডিপার্টমেন্টের হোর্ডিং পালটে ‘সিয়াটল পিপলস ডিপার্টমেন্ট’ করে দিয়েছে। জর্জ ফ্লয়েডের স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছে। যাদের প্রয়োজন তাদের বিনা পয়সায় খাদ্য, পানীয় ও ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক চর্চার জন্য জনগণের জমায়েত হওয়ার জায়গা ঠিক করা হয়েছে। ব্যারিকেডে লেখা হয়েছে, ‘মুক্ত ক্যাপিটল হিলে আপনাকে স্বাগত’। কিছু মানুষ তাঁবু খাটিয়ে ওই এলাকার মধ্যেই ঘুমোচ্ছেন। কাছাকাছি বাস করা গৃহহীনদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন প্রতিবাদীরা। সিয়াটল প্রশাসন এলাকা দখলের জন্য এখনও পুলিশ পাঠায়নি বরং পুরসভাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ওই এলাকায় পোর্টেবল বিশ্রামকক্ষের মতো কিছু পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
ক্যাপিটল হিল স্বশাসিত অঞ্চল ৩০ দফা দাবি সনদ প্রকাশ করেছে। তার প্রথম ১৯টিই বিচার ব্যবস্থা সংক্রান্ত। তাতে পুলিশ ও জেলখানা সম্পূর্ণ তুলে দেওয়ার দাবি করা হয়েছে। এমনকি এখন থেকে সম্পূর্ণ তুলে দেওয়ার মাঝের অন্তর্বর্তীকালীন পরিস্থিতির জন্যও নির্দিষ্ট দাবি করা হয়েছে। বাকি দাবিগুলির মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক দাবি(বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ ও বিনা পয়সায় কলেজেশিক্ষা), শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় জাতিবিদ্বেশী অসাম্য দূর করার কথা বলা হয়েছে। স্থানীয় নির্বাচন ব্যবস্থাকে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক করার দাবি করা হয়েছে যাতে শ্রমিক শ্রেণি তাতে সম্পূর্ণ ভাবে অংশ নিতে পারে।
তারপর…
৯ জুন, সিটি কাউন্সিলের মহিলা সদস্য কাশামা সাওয়ান্ত নিজের চাবি দিয়ে সিটি হল খুলে প্রতিবাদীদের তা সাময়িক ভাবে দখল করতে সাহায্য করেন। তিনি সোশালিস্ট অলটানেটিভ দলের সদস্য। কাউন্সিলের যেসব সদস্য মেয়রের পদত্যাগ দাবি করেছিলেন, তাদের মধ্যে কাশামা অন্যতম। আপাত ভাবে তিনি প্রতিবাদীদের প্রতি সহমর্মী বলে মনে হলেও, তাদের দাবি অনুযায়ী পুলিশি ব্যবস্থার বিলোপের পক্ষে দাঁড়াননি। শহরের বর্তমান পুলিশ প্রধানের নিয়োগেও তার সমর্থন ছিল(পুলিশ প্রধান কারমেন বেস্টের নেতৃত্বেই প্রতিবাদীদের ওপর যাবতীয় অত্যাচার হয়েছে)। বস্তুত পুলিশ প্রধানের পদটি সহজাত ভাবেই পুঁজিবাদের একটি জনগণের ওপর অত্যাচারের যন্ত্র। এখন স্বশাসিত অঞ্চলের সংগঠকরা নিজেদের ও স্থানীয় দুর্গত মানুষদের খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদা মেটানোর জন্য আর্থিক সাহায্য চাইছেন।
গত পনেরো দিনে আমেরিকায় জনগণের ব্যাপক আন্দোলনের মধ্যে যা যা ঘটনা ঘটেছে, সেগুলির মধ্যে এই ‘মুক্তাঞ্চল’ তৈরির ঘটনাটিই সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ও পরিবর্তনকামী। পুলিশের জাতিবিদ্বেষী নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে নতুন ধরনের এলাকা দখল ও গণতন্ত্র প্রয়োগের উদাহরণ। বিশেষত কালো শ্রমিক শ্রেণির ওপর বছরের পর বছর যে অত্যাচার চালানো হয়েছে, তার বিরুদ্ধে এটি জাতিসত্তার লড়াই হিসেবে উঠে এসেছে। সিয়াটলের পরিস্থিতি যে দিকেই মোড় নিক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিকল্প রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা কেমন হতে পারে, তা নিয়ে ব্যাপকতর চর্চা ও বিতর্কের ভিত্তি তৈরি করে দিচ্ছে ‘মুক্ত ক্যাপিটল হিল’।