কোভিড-১৯-এর প্রতিষেধকের খোঁজে সাম্রাজ্যবাদীদের লড়াই চরমে
পিপলস ম্যাগাজিন ডেস্ক: চিন-আমেরিকা দ্বন্দ্ব নতুন এক ঠান্ডা যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করেছে গোটা দুনিয়ায়। সেই যুদ্ধের নানা দিক রয়েছে। তবে এই মুহূর্তে সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক। এই প্রতিষেধক তৈরির জন্য সকলেই শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে। মেধাস্বত্ব রক্ষা করে ওই প্রতিষেধক বেচে আগামী দিনে প্রচুর মুনাফা ঘরে তোলার লক্ষ্য তো রয়েছেই, তার চেয়েও বড়ো লক্ষ্য হল, দ্রুত সেই প্রতিষেধককে কাজে লাগিয়ে নিজেদের দেশের উৎপাদন ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনে প্রতিযোগী সাম্রাজ্যবাদীদের থেকে কয়েক কদম এগিয়ে যাওয়া। আর এই পরিস্থিতিতে নতুন করে একটা সত্য সামনে আসছে। তা হল, জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দুনিয়া জোড়া জরুরি অবস্থাতেও জনগণের স্বার্থ রক্ষোর কোনো ক্ষমতাই নেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার।
গত ১৮ মে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। করোনা প্রতিষেধক তৈরিতে বিভিন্ন দেশের অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে সেদিনের আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত কয়েকটি দেশের পেশ করা একটি প্রস্তাব। করোনা প্রতিষেধকের একটি ‘ভলান্টারি পেটেন্ট পুল’ তৈরির প্রস্তাব। এই প্রস্তাবের ঘোষিত লক্ষ্য একটাই, যাতে করোনার ওষুধ বা প্রতিষেধকে ধনী দেশগুলির একচেটিয়া অধিকার না থাকে। যাতে বিভিন্ন দেশ শর্ত মেনে যৌথ ভাবে সেই পেটেন্টের অধিকারী হতে পারে।
প্রতিষেধক বা ওষুধ দ্রুত তৈরি করতে হলে মানবসম্পদ, জ্ঞান ও অর্থের সমবায় তৈরি হওয়া দরকার। বুর্জোয়াদের স্বার্থে দ্রুত উৎপাদন বাড়ানোর জন্যই তা প্রয়োজন। কিন্তু তা বৃহৎ ওষুধ সংস্থাগুলির স্বার্থের পরিপন্থী। মানুষের প্রাণ বাঁচানোর থেকে তারা মেধাস্বত্ব রক্ষায় বেশি উৎসাহী। এ ব্যাপারে শাসক শ্রেণিও বিভাজিত। সম্মেলনে যে প্রস্তাবটি পেশ করা হয়, তার লক্ষ্যই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে ফেলা। কারণ গোটা দুনিয়া জানে তারাই প্রতিষেধক তৈরিতে সবার চেয়ে এগিয়ে আছে।
যদিও ওই বৈঠক শেষ হয় দুই বৃহৎ শক্তি চিন ও আমেরিকার দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার মাঝে আটকে পড়ে।
গবেষণা কোন পর্যায়ে
এই মুহূর্তে দুনিয়ায় ৭৬টি ওষুধ ও প্রতিষেধক নিয়ে কাজ চলছে। মানব শরীরের ওপর কাজ করার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে আমেরিকার মডার্না বায়োটেক সংস্থা। সব মিলিয়ে ওই সংস্থার তৈরি ওষুধ ৪৫টি পরীক্ষা পেরিয়েছে। দেখা গেছে বিষয়ীর শরীরে কোভিডের অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও নগণ্য। এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর মার্কিন শেয়ার বাজারে তার ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। মডার্নার শেয়ারের দামও যথেষ্ট বেড়ে যায়। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরবর্তী সব পরীক্ষার ফলাফল ইতিবাচক হলেও, খুব আশাবাদী হিসেব অনুযায়ী, সাধারণ মানুষের জন্য ওই প্রতিষেধক বাজারে আসতে বছর শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া, এত তাড়াতাড়ি কোনো প্রতিষেধক বাজারে আসার ঘটনা ইতিহাসে ঘটেনি। নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রতিষেধক বাজারে আসতে গেলে হাজারেরও বেশি রোগীর ওপর পরীক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। তা করতে অনেক মাস এমনকি অনেক বছরও লাগতে পারে।
এই প্রকল্পের জন্য মডার্নাকে ইতিমধ্যে ৪৮৩ মিলিয়ন ডলার সাহায্য করেছে মার্কিন সরকার। সংস্থার ডিরেক্টর মনসেফ স্লাওউনি নিজের পদাবনতি ঘটিয়ে সংস্থার মুখ্য বিজ্ঞানী হয়েছেন। তাতে নাকি গবেষণার কাজে গতি আসবে। যদিও আইনবিদরা বলছেন, এতে ‘স্বার্থের সংঘাত’-এর সম্ভাবনা রয়েছে। বিজ্ঞানের যুক্তির চেয়ে মুনাফার যুক্তি এক্ষেত্রে বেশি কাজ করবে।
অন্যদিকে মডার্নার পাশাপাশি প্রতিষেধক তৈরির ক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়েছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ও। অর্থাত এক্ষেত্রে আমেরিকার অন্যতম প্রতিযোগী ইংল্যান্ড। কিন্তু যারাই প্রতিষেধক আনুক, দ্রুত উৎপাদনের স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনার জন্য তাড়াহুড়ো করে প্রতিষেধক বাজারে আনলে নতুন এক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে মানব জাতি।
সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বন্দ্ব
করোনা পরিস্থিতি সামলাতে আমেরিকা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। সেদেশে ইতিমধ্যেই ৯২০০০-এরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তার থেকে নজর ঘোরাতে ট্রাম্প ঘনঘন হু এবং চিনকে দোষারোপ করেছেন। নিজের দেশের অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখার জন্য নানা নতুন নীতি গ্রহণ করেছেন। এর ফলে দুনিয়ায় চিনের প্রভাব বাড়ার সম্ভাবনা। হু-এর সম্মেলনেও তার ছাপ দেখা গেছে। আফ্রিকার যেসব দেশে চিনের প্রভাব রয়েছে, সেই দেশগুলির করোনা পরিস্থিতি সামলাতে চিনের পক্ষ থেকে আগামী ২ বছরে ২ বিলিয়ন ডলার সাহায্য করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিষেধকের অধিকারে আমেরিকার একচেটিয়া ক্ষমতা আটকাতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রস্তাবে চিন ব্যাপক সমর্থনও জানিয়েছে। সব মিলিয়ে আমেরিকা ইইউ-র সুপারিশ মানতে বাধ্য হয়েছে। এতে হু আগামী দিনে মার্কিন অর্থসাহায্য পাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অবশ্য সেই ঘাটতি মেটাতে ৭.৫ বিলিয়ন ডলার হু-কে দেবে বলে জানিয়েছে।
অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার মতো কয়েকটি দেশ(যাদের সঙ্গে চিনের বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব রয়েছে), চিন থেকে কীভাবে কোভিড১৯ ছড়ালো, তা নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে। আমেরিকা তাতে সমর্থন জানিয়েছে। সময়সীমা নিয়ে কিছু বিরোধ থাকলেও বিষয়টি চিন নীতিগত ভাবে মেনে নিয়েছে। তারা হয়তো মনে করছে, হু-এর সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায়, এতে তাদের তেমন কোনো অসুবিধায় পড়তে হবে না।
জনগণের স্বার্থ বনাম মেধাস্বত্ব
ইউরোপের বুর্জোয়ারা নিজেদের উৎপাদন বাড়ানোর স্বার্থে কোভিডের প্রতিষেধক তৈরিতে মার্কিন একচেটিয়া ক্ষমতার বিরোধিতা করলেও, তাদের ইতিহাসও মোটেই ভালো নয়। কিছুদিন আগেই তারা মহামারিতে কাবু নিজেদের সদস্য দেশ ইতালিকে মুখোশ ও হাতশুদ্ধি সরবরাহ করতে রাজি হয়নি।
আরও একটি জরুরি বিষয় হল, ২০০১–এর দোহা ঘোষণাপত্র। ওই ঘোষণাপত্রে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কোনো ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব আইন প্রযুক্ত হবে না বলে সব দেশ অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু ওই চুক্তি সই হওয়ার দিন থেকেই সব দেশ তা অমান্য করে এসেছে। এমনকি হু-তে পেশ হওয়া একচেটিয়া বিরোধী প্রস্তাবেও দোহা ঘোষণাপত্রের বিরোধিতা করা হয়েছে। ইউকে, সুইজারল্যান্ড, জাপানের মতো ওষুধ ব্যবসায় এগিয়ে থাকা দেশগুলির তরফে বলা হয়েছে, ‘স্বেচ্ছায় যুক্ত হওয়ার ব্যবস্থা অর্থাত গবেষণায় অংশীদারিত্ব ও আর্থিক অনুদানের’ মাধ্যমেই প্রতিষেধকের ওপর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সোজা কথায় তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রতিষেধকের ওপর অধিকার জনগণের থাকবে না, থাকবে একটি বৃহৎ শক্তির বদলে যৌথ ভাবে কয়েকটি বৃহৎ শক্তির হাতে।
সব মিলিয়ে বোঝাই যাচ্ছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, রাষ্ট্রপুঞ্জ, ইউরোপিয়ন ইউনিয়নের মতো কোনো সংগঠনই এই ধরনের আন্তর্জাতিক জরুরি অবস্থায় জনগণের স্বার্থে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় নেই। সেটা করতে গেলেই, তাদের পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিভিন্ন রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের মধ্য পড়ে যেতে হবে। বস্তুত সেই দেশগুলিই এই সংগঠনগুলি চালায়।
অন্যদিকে আমেরিকার ওষুধ সংস্থাগুলির পক্ষ থেকে হু-এ পেশ হওয়া সুপারিশের তীব্র বিরোধিতা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে মেধাস্বত্বকে কোনোমতেই দুর্বল করা উচিত নয়’। তাদের মতে মুনাফার লোভই একমাত্র ওষুধ ও প্রতিষেধক আবিষ্কারের কাজে গতি আনতে পারে।
এই গোটা ঘটনাক্রম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, কোনো প্রতিষেধকই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে যে রোগ বাসা বেঁধেছে, তা সারাতে অক্ষম। যখনই প্রতিষেধক তৈরি হোক, বৃহৎ শক্তি তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই করবে। অতিমারিকে কাজে লাগিয়ে পরস্পরকে পরাজিত করার চেষ্টা করবে। কারণ পুঁজিবাদ এই মুহূর্তে ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো সংকটে পড়েছে। বেশিরভাগ মানুষ পয়সার অভাবে প্রতিষেধকের নাগাল পাবেন না। যারা পাবেন, তারাও ভয়াবহ কর্মহীনতা ও দারিদ্র্যের কবলে পড়বেন। এই ধরনের সমস্ত সংকট থেকে মানবজাতিকে মুক্তি পেতে হলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকেই ছুঁড়ে ফেলতে হবে।