Home ফিরে দেখা রানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথের শোকপ্রস্তাব: একটি শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি-নির্ভর পর্যালোচনা

রানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথের শোকপ্রস্তাব: একটি শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি-নির্ভর পর্যালোচনা

রানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথের শোকপ্রস্তাব: একটি শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি-নির্ভর পর্যালোচনা
1
অয়ন ব্যানার্জি

আধুনিক বাংলা তথা ভারতের ‘বিদগ্ধ’ মহলের সর্বজনগ্রাহ্য সর্বোজ্জ্বল নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ। এই করোনার আবহে লক ডাউনের জেরে মেহনতি মানুষের যখন রাস্তায়, রেললাইনে, গ্যাস লিক হয়ে প্রাণ যাচ্ছে তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির রবীন্দ্রপ্রীতির প্রদর্শন দেখে অসুস্থ বোধ করছিলাম। দুনিয়ার খ্যাতনামা বা বাজারের নিয়মে সফল শিল্পী-সাহিত্যিকদের ৯৯ শতাংশই এসেছেন সমাজের একেবারে উপরতলা কিংবা মধ্যবিত্তের উপরের অংশ থেকে, এখনও তাই আসছেন। তাদের সৃষ্টি দিয়ে তারা নিজেদের শ্রেণিরই সেবা করেছেন এবং চাহিদা মিটিয়েছেন। তাই তাদের মধ্যে যারা গুণমানে সেরা(যেমন রবীন্দ্রনাথ), তারাও নিজেদের শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতার মধ্যেই শ্রেষ্ঠ। এই সত্য এবারের অতিমারি ও লকডাউনে রবীন্দ্রস্মরণে যেন নতুন করে স্পষ্ট হয়ে উঠল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি নিয়ে আলোচনার জন্য এই নিবন্ধ নয়।

আরও দেখুন: করোনা নয়, ১৬ শ্রমিক সহ লকডাউনের ধাক্কায় এর মধ্যেই প্রাণ গেল ৩০০ মানুষের, ভিডিও

 আমরা যারা এই মধ্যবিত্ত সাংস্কৃতিক জগতে বড়ো হয়েছি, ছোটোবেলা থেকেই আমাদের সামনে রবীন্দ্রনাথকে জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমানে জাতীয়তাবাদী রবীন্দ্রনাথের ২২ জানুয়ারি ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যু উপলক্ষ্যে আনা একটি শোক প্রস্তাব আলোচনার বিষয় বস্তু। হঠাৎ আজকে রবীন্দ্রনাথের আনা নির্দিষ্ট একটি শোক প্রস্তাব কেন আলোচনার বিষয়বস্তু করছি, সেটা বলতে গেলে বলতে হয় ১৯০১ থেকে ২০২০ প্রায় একশ কুড়ি বছর অতিক্রান্ত হলেও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কর্তাভজা দৃষ্টিভঙ্গির একটুও পরিবর্তন হয়নি। এই শ্রেণিই রাষ্ট্রের সাথে সুর মিলিয়ে ‘সোশ্যাল ডিস্টেন্স’ পালন করে, ছাদে উঠে শঙ্খ বাজিয়ে ‘করোনা যা যা’ বলে গান করে, আর করোনার থেকেও ভয়ঙ্কর ভাইরাস না খেতে পেয়ে পরিযায়ী শ্রমিকরা মরতে থাকে। মা তার আসন্ন সন্তানকে নিয়ে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হাঁটতে থাকে। এবার একটু দেখে নেওয়া যাক জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন দেশের তথা ভূমিহীন কৃষক সহ শ্রমজীবী মানুষের জীবন যন্ত্রণার জন্য দায়ী যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাদের সাম্রাজ্যেশ্বরীর মৃত্যু উপলক্ষ্যে ঠিক কী ধরনের শোকপ্রস্তাব এনেছিলেন। আজকের সাথে সেদিনের মিলটাও দেখতে পাব।

১৯০১খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যু উপলক্ষে ‘সাম্রাজ্যেশ্বরী’ নাম দিয়ে বঙ্গাব্দ ১৩০৭-এর ফাল্গুন মাসে ‘ভারতী’ ও ‘তত্ববোধিনী’ পত্রিকায় শোকপ্রস্তাব প্রকাশিত হয় এবং ১১ মাঘ ব্রাহ্ম সমাজের বার্ষিক উৎসবে এই শোকপ্রস্তাব পাঠ করা হয়। এই শোকপ্রস্তাব শুরু হচ্ছে-“ভারত সম্রাজ্ঞী মহারানী ভিক্টরিয়া- যিনি সুদীর্ঘ কাল তাঁহার বিপুল সাম্রাজ্যের জননী পদে অধিষ্ঠাতা ছিলেন, যিনি তাঁহার রাজশক্তিকে মাতৃস্নেহের দ্বারা সুধাসিক্ত করিয়া তাঁহার প্রজাবৃন্দের নতমস্তকের উপরে প্রসারিত করিয়া রাখিয়াছিলেন, ক্ষমা শান্তি এবং কল্যাণ যাঁহার অকলঙ্ক রাজদন্ডকে পরিবেষ্টন করিয়াছিল….”।  প্রথমেই আমরা খুব জোরেসোরেই বলতে পারি ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের ভূমিহীন কৃষক- আদিবাসী(কোল-মুন্ডা-ওঁরাও), শ্রমিক কেউই ভিক্টোরিয়াকে মা বা জননী বলে মেনে নেয়নি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতবর্ষে তাদের শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য যে মিত্রর দল সৃষ্টি করেছিল, একমাত্র তারাই ভিক্টোরিয়াকে জননী বলে মেনে নেয়। এ প্রসঙ্গে ‘রাজকীয় অধিকার আইন’(the royals titels act of 1876) দ্বারা ইংল্যান্ডের রানিকে ভারত সম্রাজ্ঞী ঘোষণা করার পরের বছর ভারতের বড়লাট এই আইন ব্যাখ্যা করে যে ঘোষণা করেন সেটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য- “ইংল্যান্ডেশ্বরী যে ভারতের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী অভিজাত সম্প্রদায়ের আশা আকাঙ্ক্ষার একমাত্র রক্ষক, তাহাই এই আইনের দ্বারা সূচিত হইতেছে”(আর পি দত্ত, ইন্ডিয়া টুডে, পৃষ্ঠা ২৮৭)। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

এবার একটু ইতিহাসের পাতায় চোখ ফেরানো যাক। ইতিহাসের পাতায়  শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে চোখ বোলালেই “সাম্রাজ্যেশ্বরী” ভিক্টোরিয়ার প্রজাকল্যাণের রূপ আমাদের চোখে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বিভিন্ন সরকারি তথ্য থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ অর্ধে কৃষির যে ভয়ঙ্কর চিত্র উদ্ঘাটিত হয়, তার সংক্ষিপ্ত চিত্র সখারাম গণেশ দেউসকর- এর ‘দেশের কথা’(পৃষ্ঠা১১২) থেকে তুলে দিলাম- “ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে প্রথম যুগে বোম্বাই প্রদেশের কৃষকদের মোট রাজস্ব দিতে হত ৮লক্ষ টাকা, মহারানী ভিক্টরিয়ার রাজত্বকালে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে এই রাজস্বের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে হয় ২কোটি ৩লক্ষ টাকা। এই রাজস্বের অর্থ সংগ্রহ করবার জন্য কৃষক জনসাধারণকে মারওয়ারী, গুজরাটি ও ভাটিয়া সাউকার মহাজনদের কাছে চির দাসত্ব বরণ করতে হত।” ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ঐতিহাসিক উইলিয়াম হান্টার ইংল্যান্ডে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন ভারতবর্ষের কুড়ি কোটি মানুসের মধ্যে চার কোটিরও বেশি মানুষ আধপেটা খেয়ে দিন কাটায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বিশেষত আট ও নয়ের দশকে ‘সাম্রাজ্যেশ্বরী’র অতি ভয়ঙ্কর কৃষক শোষণের অনিবার্য পরিণতি হিসাবে যে মহাদূর্ভিক্ষগুলো ঘটার মধ্যে দিয়ে মানুষ(ভূমিহীন কৃষক এবং আদিবাসী মানুষ)-এর মৃত্যু ঘটেছিল তার হিসাবটা একটু দেখে নিই -“বেরার প্রদেশে ৫ লক্ষ৮০ হাজার, পাঞ্জাব প্রদেশে ৭লক্ষ ৫০হাজার, মধ্যপ্রদেশে ১৩লক্ষ ৭০ হাজার….সমগ্র ভারতবর্ষে ১৮৮০খ্রিস্টাব্দে ৩৯ লক্ষ ২৮হাজার এবং ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ৮৩লক্ষ ৩৪ হাজার ১৫৫জনের মৃত্যু ঘটেছিলো।”(ভারতের বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাস- সুপ্রকাশ রায়, পৃষ্ঠা-৩৯-৪০)। ব্রিটিশ শাসনকালের প্রথম দিন থেকেই ভারতবর্ষ স্থায়ী দুর্ভিক্ষের দেশে পরিণত হয়েছিল। কিন্ত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ত্রিশ বছর দুর্ভিক্ষের অবস্থা চরমে পৌঁছয় এবং প্রায় দুকোটি পঁচিশ লক্ষের মত মানুষ প্রাণ হারায়। বলার অপেক্ষা রাখে না এই দুকোটি মানুষ ভূমিহীন কৃষক আদিবাসী মানুষ ছাড়া আর কেউ না। আর এই সব মৃত্যু ‘সাম্রাজ্যেশ্বরী’র শাসনকালের সময় ‘আশীর্বাদ’ হিসাবেই নেমে আসে। সাম্রাজ্যেশ্বরীর শাসনকালের এটা একটা খণ্ডিত চিত্র যা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “…. মাতৃস্নেহের দ্বারা সুধাসিক্ত করিয়া তাঁহার অগণ্য প্রজাবৃন্দের নতমস্তকের উপর প্রসারিত করিয়া রাখিয়াছিলেন, ক্ষমা-শান্তি এবং কল্যাণ যাঁহার অকলঙ্ক রাজদন্ডকে পরিবেষ্টন করিয়াছিল…”।  এই শোকপ্রস্তাবে বলা হয়েছে “ভারতেরশ্বরী মহারানী যে পরমপুরুষের নিয়োগে এই পার্থিব রাজ্যভার গ্রহণ করেছিলেন এবং যাঁহার প্রসাদে সু-চিরকাল জীবিত থাকিয়া আনন্দিতা রাজশ্রীকে দেশে কালে এবং প্রকৃতিবর্গের হৃদয়ের সুদৃঢ়তর রূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন”…। বিধাতার দোহাই দিয়ে ব্রিটিশের ভারত দখল ও তার নির্লজ্জ লুন্ঠনকে লুকিয়ে রেখে ইতিহাসকে বিকৃত করার প্রকৃত উদেশ্য  কি হতে পারে?

এই শোকপ্রস্তাবে আরো বলা হয়েছে “মৃত্যু প্রতিদিন এই সংসারে যাতায়াত করিতেছে, আমরা তাহার গোপন পদসঞ্চার লক্ষ্য করি না। সেই মৃত্যু যখন রাজ সিংহাসনের উপরেও অবহেলাভরে আপন অমোঘ কর প্রসারণ করে তখন মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুর বিরাট স্বরূপ কোটি কোটি লোকের নিকট পূর্ণ সূর্য গ্রহণের রাহু ছায়ার ন্যায় দৃষ্টিগোচর হয়।” ভিক্টোরিয়ার মৃত্যু সেই সময় গোটা দেশের মেহনতি জনতার মধ্যে এমন কোনো শোকের ছায়া ফেলেছিল বলে জানা যায়নি তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর সাতের দশকে (১৮৭৭) যখন গোটা দেশে দুর্ভিক্ষে প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাট লক্ষ ভারতবাসীর মৃত্যু হয়েছিল ঠিক তখনই একই সময় ইংল্যান্ডের রানিকে ‘ভারতেরশ্বরী’ বলে ঘোষণা উপলক্ষে দিল্লিতে অজস্র অর্থ ব্যয়ে এক দরবারের আয়োজন চলছিল। এর ফলে ভারতীয় কৃষক জনসাধারণের বিক্ষোভ শতগুনে বেড়ে যায়। এই বিক্ষোভ দমনের জন্য ব্রিটিশ শাসক শ্রেণি আম জনতার উপর কঠোর ব্যবস্থা নিতে থাকে( ভারতের বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাস- সুপ্রকাশ রায়, পৃষ্ঠা-৩২-৩৩)। এই সদ্য দুর্ভিক্ষপীড়িত বিক্ষুব্ধ জনতার কাছে ভিক্টোরিয়ার মৃত্যু (২২/০১/১৯০১) কোনো শোকের বার্তা আনতে পারে কি? আজ যেমন হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু উচ্চ মধ্যবিত্তের কোনো পদসঞ্চার সৃষ্টি করেনা যতটা না করে ঋষি কাপুরদের মৃত্যুতে, ঠিক তেমনি সেদিনও সিধু কানহ, বিরসা মুন্ডাদের জীবনে মৃত্যুর পদসঞ্চার চোখের আড়ালেই থেকে যায়। খুব সচেতন ভাবেই “পূর্ণ সূর্যগ্রহণের রাহুছায়ার ন্যায় দৃষ্টিগোচর” হয় রানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যু।

Share Now:

Comment(1)

  1. ভালো তথ্য এবং অতি প্রয়োজনীয় যুক্তি।

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *